২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চাগোস দ্বীপপুঞ্জে মরিশাসের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দাবিতে ব্যতিক্রমী সফর

চাগোস সফরের জন্য মরিশাসের ভাড়া করা ব্লু ডে নিমস জাহাজ - ছবি : সংগৃহীত

ভারত মহাসাগরের গভীরে প্রত্যন্ত এক দ্বীপপুঞ্জ চাগোসের ওপর দীর্ঘদিন থেকেই সার্বভৌমত্বের দাবি করে আসছে আফ্রিকার দ্বীপ দেশ মরিশাস। চাগোসের ওপর ব্রিটেনের দখলদারিত্বকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে অভিযোগ করে আসছে দেশটি।

সম্প্রতি চাগোস দ্বীপপুঞ্জের দখল ছেড়ে ব্রিটেনকে তা মরিশাসের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে মরিশাস সরকারের একটি দল সফর করে ওই দ্বীপপুঞ্জে। প্রায় ৫০ বছর আগে ওই দ্বীপপুঞ্জ থেকে উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দারা ছিলেন ওই প্রতিনিধি দলে।

অর্ধশতক পর ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি ছাড়াই নৌকায় করে দ্বীপপুঞ্জের পেরস বানহস দ্বীপে পা রাখে প্রতিনিধি দলটি।

দ্বীপে পা রাখার পর খুশিতে কেঁদে ফেলেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।

দলের এক সদস্য অলিভিয়া ব্যানকোল্ট বলেন, ‘এটি একটি দারুণ মুহূর্ত।’

ব্রিটিশ সরকারকে 'বর্ণবাদী' বলে তীব্র সমালোচনা করলেন তিনি চাগোসিয়ানদের এই দ্বীপপুঞ্জে ফিরতে না দেয়ার জন্য।

তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের জন্মভূমি। ওরা কীভাবে আমাদের এই অধিকার অস্বীকার করে?’

১৯৬৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে মরিশাস স্বাধীনতা পেলেও এই দ্বীপ দেশটির অংশ থাকা চাগোস দ্বীপপুঞ্জের দখল ছাড়তে অস্বীকার করে ব্রিটিশরা। পরে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে চাগোসের বাসিন্দাদের তাদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করে মরিশাসে পাঠায় ব্রিটেন।

জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত যদিও রায় দিয়েছে যে এই দ্বীপপুঞ্জে ব্রিটেনের দখলদারিত্ব 'অবৈধ', কিন্তু তারপরও চাগোস দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসের কাছে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে ব্রিটেন।

ভারত মহাসাগরে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ- ছবি : বিবিসি

তীরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই মরিশাসের সরকারি কর্মকর্তারা সেখানে একটি পতাকার খুঁটি গাড়ার জন্য কংক্রিট ঢালতে শুরু করলেন।

মরিশাসের প্রতিনিধিদলের নেতা জগদীশ কুনজাল বলেন, ‘এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। কোনো দেশ তার নিজের সীমানায় জাতীয় পতাকা ওড়ানোর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই।’

তিনি জাতিসংঘের বিভিন্ন শীর্ষ আদালতের একের পর এক রায়ের কথা উল্লেখ করছিলেন, যাতে এই দ্বীপের ওপর মরিশাসের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, এবং ব্রিটেনকে তার 'অবৈধ' দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে বলা হয়েছে।

পঞ্চাশ বছর আগে এই দ্বীপের মানুষদের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সেখান থেকে চলে যেতে বলা হয়েছিল। তারপর থেকে দ্বীপটি যে অবহেলার শিকার, তার চিহ্ণ ছড়িয়ে আছে একটি মরচে ধরা রেললাইন, ভাঙ্গাচোরা বাড়িঘর আর কংক্রিটের এক ঘাটের ধ্বংসাবশেষে। পুরনো গির্জাটির চারপাশে ঘন বাগান। ৬৮ বছর বয়স্ক লিসবি এলিসকে এই গির্জাতেই ব্যাপটাইজড করা হয়েছিল।

সেখানে ঢুকেই চাগোসিয়ানরা জমে থাকা ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে শুরু করলেন।

এলিস বলেন, ‘আমি এখানে ফিরে আসতে পেরে খুশি। কিন্তু আমার কষ্ট লাগছে যে আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে। আমি এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে চাই।’

এক অশ্রুসিক্ত ভ্রমণ

রোজামন্ড বার্টিন দিগন্তরেখার দিকে তাকিয়ে আছেন ক’দিন ধরে।

গাংচিলের মতো একটি বড় পাখি যখন নৌকার ওপর এসে বসলো, যেটিকে তাদের ক্রিওল ভাষায় বলে 'ফৌ', খুশিতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘এর মানে হচ্ছে আমরা স্থলভাগের কাছে চলে এসেছি।’

নৌকার এক পাশে সাগরের ঢেউ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো এক তিমি, এরপর পানি থেকে রূপালি ঝিলিক দিয়ে লাফিয়ে উঠলো কিছু মাছ।

এর কয়েক ঘণ্টা পর, শুক্রবার বিকেলে ভেঁপু বাজিয়ে উল্লাস করে ঘোষণা করা হলো, যে নৌকায় চড়ে তারা চার দিন ধরে সাগর পাড়ি দিয়ে পূর্বদিকে চলেছেন, সেটি ভারত মহাসাগরের গভীরে এক অদৃশ্য রেখা অতিক্রম করে প্রত্যন্ত চাগোস দ্বীপপুঞ্জের চারপাশের সীমানায় ঢুকে পড়েছে।

চাগোসে যেতে প্রস্তুত সাবেক বাসিন্দারা- ছবি : টুইটার

প্রায় চিৎকার করে আকাশের দিকে দুই হাত ছড়িয়ে বার্টিন বললেন, ‘আমি এখন স্বাধীন।’

১৯৭২ সালে যখন ব্রিটেন তাকে এবং তার পরিবারকে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে জোর করে বের করে দিয়েছিল, তারপর এই প্রথম বার্টিন সেখানে কোন অনুমতি ছাড়া ফিরতে পেরেছেন, তাকে সারাক্ষণ পাহারা দিচ্ছে না কোন সৈনিক।

চাগোস দ্বীপপুঞ্জে এর আগে তাদেরকে যেতে দেয়া হত 'হেরিটেজ ভিজিটের' নামে, যেটির আয়োজন করতো ব্রিটিশ সরকার।

নৌকায় যখন সবাই আনন্দে নাচছে, উল্লাস করছে, তখন তার মতোই চাগোস দ্বীপের আরেক সাবেক বাসিন্দা ৫৭ বছর বয়সী সুজেল ব্যাপটিস্ট ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘এটি যে আমার কাছে কীরকম একটি ব্যাপার, বুঝিয়ে বলতে পারবো না।’

নৌকায় এই দুই নারীর সঙ্গে আছেন চাগোস দ্বীপের আরও তিনজন মানুষ। মরিশাসের সরকারের ভাড়া করা নৌকাটি শনিবার যখন চাগোস দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছালো এবং এরা যখন ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর পাহারা বা অনুমতি ছাড়াই দ্বীপের মাটিতে পা দিলেন , সেটি এক নতুন ইতিহাসের সূচনা করলো।

বার্টিন বলেন, ‘আমি যে কী গর্ব অনুভব করছি, আমাকে এখানে আসার জন্য কারও অনুমতি নিতে হয়নি।’

অর্ধশত বছর আগে, বার্টিনের বয়স ছিল ১৭। তখন তার মাত্র বিয়ে হয়েছে, এবং কোলে ছয় মাস বয়সী শিশু সন্তান। তখন প্রতি কয়েক মাসে তাদের দ্বীপে মরিশাস থেকে একটা রসদবাহী জাহাজ আসতো। একদিন চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট এক দ্বীপ সালোমনে এসে নোঙর করলো নোডভের নামের এই জাহাজ, কিন্তু বলা হলো জাহাজে কোন খাবার নেই।

cagos 2
রোজামন্ড বার্টিন- ছবি : বিবিসি

বার্টিন বলেন, ‘ওরা যে আমাদের দ্বীপ ছাড়া করতে চায়, এটি ছিল তার প্রথম সংকেত।’

তার সঙ্গীরা যখন বর্ণনা করছিলেন ব্রিটেন কীভাবে এই দ্বীপপুঞ্জ থেকে দু হাজার মানুষকে জোর করে উচ্ছেদ করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, এবং এই খালি জাহাজটি তার প্রমাণ, তখন জোরে জোরে মাথা নাড়ছিলেন বার্টিন।

এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বার্টিন, তার আত্মীয়-স্বজন এবং সালোমন দ্বীপের তিনশজনের মতো অধিবাসীর সবাইকে তাদের জিনিসপত্র কাঠের ট্রাংকে ভরে, বিছানাপত্র নিয়ে নডভের জাহাজটিতে উঠতে হলো। পেছনে ফেলে গেলেন এই দ্বীপের এক সহজ, সরল এবং সুখী জীবন।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, এই পরিবারগুলো আর কখনোই তাদের দ্বীপে ফিরতে পারবে না। কারণ তারা গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে একটি দ্বীপ তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল সামরিক ঘাঁটি করার জন্য, আর দ্বীপপুঞ্জের নামও পাল্টে রাখা হয়েছিল, 'ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ওশেন টেরিটরিজ।'

আদালতের রায় জেতার পর উল্লাস

স্বাধীন দ্বীপরাষ্ট্র মরিশাস এ সপ্তাহে প্রথমবারের মতো চাগোস দ্বীপপুঞ্জের দিকে একটি নৌকা পাঠিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে। মরিশাস নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করে, চাগোস দ্বীপপুঞ্জে তাদের যাওয়ার অধিকার আছে, কারণ এটির ওপর তাদের সার্বভৌমত্ব আছে।

চাগোস দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে মরিশাসের আইনি লড়াই চলছে বহু বছর ধরে। তারই এক পর্যায়ে এসে মরিশাস এই দ্বীপে এরকম একটি অভিযাত্রার আয়োজন করলো।

ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আপত্তি এবং বিরোধিতা সত্ত্বেও, মরিশাস এই আইনি লড়াইয়ে একের পর এক বিজয় পেয়েছে- প্রথম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে, এরপর জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতে। সর্বশেষ জাতিসংঘের যে ট্রাইব্যুনাল সমূদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিস্পত্তি করে, সেখানকার রায়ও মরিশাসের পক্ষে গেছে।

জাতিসংঘের মানচিত্রে এখন এই দ্বীপপুঞ্জকে মরিশাসের বলে দেখানো হয়। দুটি আন্তর্জাতিক আদালত সম্প্রতি ব্রিটেনকে নির্দেশ দিয়েছে চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ওপর তাদের সার্বভৌমত্বের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটিয়ে যেন তারা সেখানে দখলদারিত্বের ইতি টানে।

ব্রিটিশ ব্যারিস্টার ফিলিপ স্যান্ডস বলেন, ‘আমরা যে এখানে এসেছি এটা একদম অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে। মরিশাসের সরকারের জন্য এটি একটি বিরাট ব্যাপার বলে মনে হয়। স্বাধীনতার পর থেকে মরিশাস এই দ্বীপগুলো ফেরত পাওয়ার জন্য লড়ছে।’

তিনি এই মামলায় মরিশাসের পক্ষ হয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছেন।

মরিশাসের সরকারের ভাড়া করা নৌকা, ব্লু ডে নিমস, যখন দ্বীপের চারপাশের বিতর্কিত সমূদ্রসীমায় ঢুকলো, যা কোন কোন মানচিত্রে এখনো ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ওশেন টেরিটরিজ বলে দেখানো হয়, মরিশাসের প্রতিনিধিদল শ্যাম্পেনের বোতল খুললেন এই মুহূর্তটি উদযাপনের জন্য।

জাতিসংঘে মরিশাসের রাষ্ট্রদূত জগদীশ কুনজুল বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমরা অবন্ধুসুলভ কিছু করছি না। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। আমরা বিশ্বাস করি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সামনে এগুনোর পথ এটাই, যাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ওপর মরিশাসেরই সার্বভৌমত্ব আছে।"

বিবিসির সঙ্গে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ যাগনাথ বলেন, ব্রিটেনকে 'বিব্রত' করার কোন ইচ্ছে তার নেই, কিন্তু বলেন ব্রিটেনের ‘কোন অধিকার নেই চাগোস দ্বীপপুঞ্জ নিজেদের বলে দাবি করার।’

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, চাগোস দ্বীপপুঞ্জের মানুষের সঙ্গে কয়েক দশক ধরে ব্রিটেন যে ব্যবহার করেছে এবং এখনো করছে, তা স্পষ্টতই ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ন্যায় বিচারের পক্ষে, আইনের পক্ষে, এবং ব্রিটেনই আসলে এখানে আইন ভঙ্গ করছে।’

মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী নিজেও চাগোস দ্বীপপুঞ্জের এই সফরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু একটি সাইক্লোন মরিশাসে আঘাত হানার পর তাকে সেই পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়।

নৌকায় আরও যেসব চাগোস দ্বীপের মানুষ যোগ দেন তাদের মধ্যে আছেন ৫৭ বছর বয়সী অলিভিয়ের ব্যানকোল্ট, যিনি চার বছর বয়সে পেরোস ব্যানহস ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। কয়েক দশক করে তিনি ব্রিটেনের আদালতে আইনি লড়াই চালিয়েছেন সেখানে ফিরে যাওয়ার অধিকার দাবি করে।

তিনি বলেন, ’ব্রিটিশ সরকার কীভাবে আমাকে আমার জন্মস্থানে যেতে বাধা দেয়? আমাদের সেখানে ফিরে যাওয়ার অধিকার আছে। তাদের কোনো অধিকার নেই আমাদের আটকানোর। আমরা সন্ত্রাসবাদী নই। আমরা এখানে থাকতে চাই, বসবাস করতে চাই।’

১৯৭১ চাগোসের দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ ছেড়ে যাওয়া সুজেল ব্যাপটিস্ট বলেন, ‘আমাদের সবার জন্য এটা খুবই আবেগের একটা বিষয়। আমি কোনো একদিন এখানেই স্থায়ীভাবে থাকতে চাই।’

দিয়েগো গার্সিয়ায় নিজেদের বাড়ি যখন ছাড়েন, তখন সুজেল ব্যাপটিস্ট ছিলেন শিশু। দ্বীপ ছাড়ার সময় তার যমজ ভাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

সেই দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

চাগোসের সমুদ্রসীমায় প্রবেশের পর উল্লাস- ছবি : বিবিসি

মরিশাসের এই নৌকার অনেকের মধ্যে এরকম জল্পনা চলছিল যে, কোনো ব্রিটিশ বা মার্কিন রণতরী এসে তাদের পথ আটকে দেয় কীনা। তবে ব্রিটিশ সরকার মরিশাসের এই সফরটির ব্যাপারে সমঝোতার পথই নিয়েছে। তবে এরকম প্রমাণ যথেষ্ট আছে যে, ব্রিটিশ সরকার শুরুতে এই সফর আটকে দেয়ার চেষ্টা করেছিল, বা অন্তত আন্তর্জাতিক সাংবাদিকরা যেন এই নৌকায় যেতে না পারে, সেরকম চেষ্টা করেছিল।

ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দফতর এক বিবৃতিতে চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ওপর আগের মতো সার্বভৌমত্বের দাবির পুনরাবৃত্তি আর করেনি। তারা বলছে, এই সফরের ব্যাপারে তাদেরকে যেহেতু আগে থেকেই জানানো হয়েছে, তাই তারা এতে বাধা দেবে না।

তবে পররাষ্ট্র দফতর আবার এরকম একটা দাবি করেছে যে, মরিশাসের এই সফরের উদ্দেশ্য ‘পরিবেশ রক্ষা’। কিন্তু পররাষ্ট্র দফতরের এই কথা সঠিক নয়, কারণ মরিশাস এরকম কোনো উদ্দেশ্যের কথা অস্বীকার করেছে। তারা বলছে, তাদের এই সফরের উদ্দেশ্যে ব্লেনহেইম রিফের মানচিত্র তৈরি করা, যেটি নিয়ে প্রতিবেশী মালদ্বীপের সঙ্গে তাদের সীমানা বিরোধ আছে।

সুইডেনের ৬৯ বছর বয়সী মেরিন সার্ভেয়র ওলা ওসকারসন তার মাপ-জোকের যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত। তিনি বলেন, ‘নতুন স্থলভাগ দাবি করার ব্যাপারটি সবসময় বেশ মজার।’

ওলা ওসকারসন ব্লেনহেইম রিফের ওপর যন্ত্রপাতি বসিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন এটির কোন অংশ স্থায়ীভাবে সাগরের পানির ওপর জেগে আছে কিনা।

তিনি বলেন, ‘যদি এটি পানির ওপর জেগে থাকে, তাহলে মরিশাস এটিকে ভিত্তি ধরে সমুদ্রসীমা দাবি করতে পারবে।’

তখন মরিশাস বলতে পারবে, এই রিফটিও আসলে একটি দ্বীপ, এবং তখন মরিশাস সাগরের আরও হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিজেদের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল বলে দাবি করতে পারবে।

চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সব মানুষকে ব্রিটেন ১৯৭০ এর দশকে সেখান থেকে অপসারণ করেছিল। তারা দেখাতে চেয়েছিল, সেখানে স্থায়ীভাবে থাকে এমন কোনো জনবসতির অংশ নয় স্থানীয় বাসিন্দারা। অথচ এরা সেখানে কয়েক প্রজন্ম ধরে বাস করেছে।
ব্রিটিশ কূটনীতিকরা জানতেন যে, এই কাজটি আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ। বিশেষ করে একটি দেশকে স্বাধীনতা দেয়ার আগে সেটিকে এভাবে ভাগ করে ফেলা। কিন্তু তারা ভেবেছিলেন, জনবসতি নেই এমন কিছু দ্বীপকে আলাদা করে ফেললে সেটা কারও নজরে পড়বে না।

ব্রিটেন তখন গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা চুক্তি করে ফেলেছে দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপটি তাদের কাছে লিজ দেয়ার জন্য। মরিশাসের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্রিটেন তখন তাদেরকে রীতিমত ব্ল্যাকমেইল করেছিল এতে রাজী হতে। ব্রিটেন বলেছিল, হয় এসব দ্বীপ দিয়ে দিতে হবে, নয়তো স্বাধীনতা পাওয়ার কথা ভুলে যেতে হবে। মরিশাস স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৬৮ সালে।

বিভক্ত কমিউনিটি

চাগোস দ্বীপপুঞ্জের বেশিরভাগ মানুষকে কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়েই এক হাজার মাইল দক্ষিণে মরিশাস নিয়ে ফেলে দেয়া হয়। অনেকে সিচেলিসে বা ব্রিটেনে চলে যান। এদের অনেকে ব্রিটেনের সারের একটি শহর ক্রলিতে থাকেন।

তবে ব্রিটেনের এই ছোট চাগোসিয়ান কমিউনিটি মরিশাসের এই সফর নিয়ে বিভক্ত। কেউ কেউ এটিকে 'মিডিয়া সার্কাস' বলে বর্ণনা করছেন। তারা বলছেন, মরিশাস আসলে চাগোসিয়ানদের প্রতি দরদের চাইতে বরং তার সীমানা বাড়ানোর আকাঙ্খা থেকেই এই কাজ করছে।

টুইটারে একদল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ওভারসিজ টেরিটরিজ নাগরিক বলছেন, ‘চাগোসিয়ানরাই আসল ক্ষতির শিকার হয়েছেন। চাগোসিয়ানরা মরিশাসের লোক নন। আমরা ব্রিটিশ।’

মরিশাসেও একদল এই বলে এই সফরের সমালোচনা করেছেন যে, এটি অর্থের অপচয়। তারা বলছেন, এই সফরের জন্য সরকার একটি বিলাসবহুল প্রমোদতরী ভাড়া করে অর্থের অপচয় ঘটিয়েছে।

তবে এসব সমালোচনার কড়া জবাব দিয়েছেন এর আরোহীরা।

রোজমন্ড বার্টিন বলেন, ‘আমি চাগোসের আদি বাসিন্দা, আমি জানি আমি কতটা ভুগেছি।’

তিনি বলেন, ‘যারা এই সফরের বিরুদ্ধে বলছেন, তারা তো এখানে জন্মাননি। আমি মনে কষ্ট পাই, তাদের উচিৎ আমাদের সমর্থন করা।’

জাতিসংঘে মরিশাসের রাষ্ট্রদূত জগদীশ কুনজুল বলেন, যারা এই সফরের বিরোধিতা করছেন, তারা আসলে বিভ্রান্ত।

চাগোসিয়ানদের আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা ক্রীতদাসদের বংশধর বলে মনে করা হয়। তাদের এখানে আনা হয়েছিল নারিকেল বাগানে কাজ করতে। কিন্তু তাদেরকে শোষণ করেছে অনেক দেশ, তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এখন এই দ্বীপে তাদের এই অধিকারের দাবি তাদের জীবনে কোন পরিবর্তন আনে কীনা সেটা দেখার বিষয়।

মরিশাসের সরকার চাগোসিয়ানদের সাহায্য করবে বলে অঙ্গীকার করেছে। তাদেরকে এই দ্বীপে পুনর্বাসন এবং দ্বীপের উন্নয়নের কথাও দিয়েছে। এ সপ্তাহান্তে তারা পেরোস বানহস এবং সালোমন দ্বীপে মরিশাসের জাতীয় পতাকা উত্তোলনেরও পরিকল্পনা করছে।

এটিকে অনেকেই আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতীয় সার্বভেৌমত্ব প্রতিষ্ঠার একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখবেন, এই ঘটনাকে উদযাপন করবেন। কিন্তু ব্রিটেন অন্য কিছু মানুষ এটিকে হয়তো দেখবেন ভূমি দখলের লক্ষ্যে একটি উসকানিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
সালাহর জোড়া গোলে জিতল লিভারপুল ১০ সাংবাদিকসহ ১১ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের ৬ দফা মেনে নেয়ার আহবান হাসিনা-কন্যা পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক লেনদেন স্থগিত বুটেক্স-পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হবে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে : প্রেস উইং ব্যর্থ টপ অর্ডার, মুমিনুলের ফিফটির পর পথ দেখাচ্ছেন লিটন তেজগাঁওয়ে বুটেক্স ও ঢাকা পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেলজিয়ামের উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়ছে এসডিজি কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে ড. ইউনূসের ‘থ্রি জিরো তত্ত্ব’ গুমের ঘটনা তদন্তে কাউকে বরখাস্ত করা হয়নি : কমিশন প্রধান

সকল