২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

এখনো পুরো সক্রিয় হতে পারেনি পুলিশ

এখনো পুরো সক্রিয় হতে পারেনি পুলিশ - প্রতীকী ছবি

সরকার পতনের পর দেশের থানা ও মহানগর এলাকায় পুলিশ সদস্যদের এখনো পুরো মাত্রায় সক্রিয় করা যায়নি। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠের পুলিশ সদস্যরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমান্ডও মানছেন না বলে জানা গেছে।

আন্দোলনের সময় থানায় হামলা, আগুন, পুলিশ হত্যা ও অস্ত্র লুটের কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে আরো অনেক সময় লাগবে বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকেরা।

কিন্তু এই সময়ে সাধারণ মানুষ নানা ফৌজদারি ও অপরাধমূলক সমস্যার প্রতিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি অনেক মামলার নথি পুড়ে যাওয়ায় সেই নথি আবার আদালত ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করাও সময় সাপেক্ষ হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওই সময়ে ঢাকাসহ সারাদেশে ৪৫০টি থানা আক্রান্ত হয়েছে। সারাদেশে মোট থানার সংখ্যা ৬৫০টির মতো। ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে বেশিরভাগই আক্রান্ত হয়েছে।

পুলিশ সদরদফতরের তথ্য মতে, ওই সময়ে সারাদেশে ৪৬ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।

১৮৭ পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দেননি

পুলিশ সদরদফতর জানিয়েছে, সারাদেশে এখনো কাজে যোগ দেননি পুলিশের ১৮৭ সদস্য। তাদের মধ্যে ডিআইজি একজন, অতিরিক্ত ডিআইজি সাতজন, পুলিশ সুপার দুই জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একজন, সহকারী পুলিশ সুপার পাঁচজন, পুলিশ পরিদর্শক পাঁচজন, এসআই ও সার্জেন্ট ১৪ জন, এএসআই নয়জন, নায়েক সাতজন এবং কনস্টেবল ১৩৬ জন। তাদেরকে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে। তাদের আর কাজে যোগ দেয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

অস্ত্র উদ্ধারের সংখ্যা

অন্যদিকে লুট হওয়া পাঁচ হাজার ৮২৯টি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে তিন হাজার ৮৬৩টি। এখনো উদ্ধার হয়নি দুই হাজার ৬৬টি। এসব অস্ত্রের মধ্যে আছে এলএমজি, এসএমজি, রাইফেল, শটগান, পিস্তল রয়েছে।

গুলি লুট হয়েছে ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৪২টি। উদ্ধার হয়েছে দুই লাখ ৮৬ হাজার ৮২ রাউন্ড। এখনো উদ্ধার হয়নি তিন লাখ ২০ হাজার ৬৬০টি। এছাড়া সাউন্ড গ্রেনেড, গ্যাস গ্রেনেড, টিয়ারগ্যাস সেলও লুট হয়েছে। তার অর্ধেকও এখনো উদ্ধার হয়নি।

তবে ৫ আগস্টের পর থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবস্থান নেয়া একজন সাব-ইন্সপেক্টর বলেন, ‘পুলিশ সদরদফতর যে হিসাব দিচ্ছে সেটা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। আশা করি ধীরে ধীরে নিহত ও অনুপস্থিত পুলিশ সদস্যদের তালিকা আরো স্পষ্ট হবে। পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগ দিলেও তাদের মনোবল ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে। আমাদের কর্মস্থলই এখনো কাজের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত হয়নি। এর বাইরে আমাদের বাসাও নিরাপদ নয়। বাসা পরিবর্তন করেও কোনো লাভ নাই। কারণ পুলিশের পোশাক দেখলেই মানুষ নানা মন্তব্য করে।’

তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের পুলিশ সদস্যরা মিছিল সমাবেশ হলে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সবসময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ মানেন না। তারা আর মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা করতে চায় না। অতীতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ পালন করেই আমরা আজ এই সমস্যায় পড়েছি।’

পুলিশ সদস্যরা তাদের নানা দাবি-দাওয়ার কথা বলছেন। তবে তারা এখন আর সেটা প্রকাশ্যে বলছেন না। কারণ সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলতে গিয়ে দুই পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হয়েছেন। পুলিশ সদরদফতর অবশ্য বলছে তারা পুলিশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।

এখনো সংস্কার চলছে

ঢাকার সেসব থানা আন্দোলনের সময় হামলা ও আগুনের শিকার হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো পল্টন থানা। ওই থানার সংস্কার কাজ এখনো শেষ হয়নি। পুলিশ সদস্যরা এখনো ঠিকমতো বসতে পারেন না। সবার অফিস কক্ষ নেই। ভবনে পুলিশ সদস্যদের থাকার যে জায়গা ছিলো তাও পুড়ে গেছে। তাদের এখনো বাইরে থাকতে হচ্ছে। থানার জরুরি নাম্বারগুলো এখনো সচল হয়নি। একই অবস্থা ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে কমপক্ষে ২২টি থানার।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, ‘ঢাকার ২২টি থানা হামলা ও আগুনে সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো সংস্কারের কাজ চলছে। সংস্কার শেষ হলে থানাগুলোতে আর সমস্যা হবে না। পুরোদমে কাজ হবে।’

আদাবর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ‘আসলে আমরা এখন রুটিন ওয়ার্ক করছি। মামলার তদন্ত এবং অপারেশনে তেমন যাচ্ছি না। আর মামলাও কম হচ্ছে। বেশিরভাগই হচ্ছে জিডি।’

পুলিশকে এখন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মিছিল সমাবেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় বেশি কাজ করতে হচ্ছে। কারণ এখন মানুষ নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামছেন। তারা ওইসব এলাকায় নিয়োজিত থাকলেও আগের মতো মিছিল সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে তাদের তৎপর দেখা যায় না।

রোববার ঢাকার কাকরাইলে অডিট ভবনের সামনের সড়ক বন্ধ করে দাবি-দাওয়ার এক সমাবেশে পুলিশ অনেকটাই নিস্ক্রিয় ছিল। তারা সমাবেশ রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য কমান্ডিং অফিসারদের নির্দেশও মানেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে, মব জাস্টিসও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এখানেও পুলিশের নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ আছে।

‘পুলিশকে সহায়তা করতে হবে’

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘আসলে পুলিশকে এর আগে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা জনবিরোধী ভূমিকা পালন করে গণরোষের শিকার হয়েছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা মানসিক এবং নৈতিকভাবে দুর্বল আছে। এখন তাদের উদ্বুদ্ধ করা দরকার। সেজন্য তাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, তারা আইনগত দায়িত্ব পালনে বাধ্য এবং সেটা করলে তারা কোনো ক্ষতির মুখে পড়বেন না। আর সাধারণ মানুষেরও দায়িত্ব আছে। তাদেরও উচিত এখন পুলিশকে তাদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা। এবার পুলিশ সদস্যরা যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দ্রুত দেয়া উচিত। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া তাদের পরিবারকে দ্রুত বুঝিয়ে দেয়া উচিত। আহতদের চিকিৎসা ব্যয় এবং ক্ষতিপূরণ দেয়া দরকার।’

মাঠে সেনাবাহিনী থাকা এবং তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়া প্রসঙ্গে নূর খান বলেন, ‘পুলিশের কাজ সেনাবাহিনী দিয়ে হয় না। কারণ সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছেই যেতে চায়। তারা সেনাবাহিনীর কাছে যেতে চায় না। আর সেনাবাহিনীরও এই পরিস্থিতিতে ভয় আছে।’

মনোবল বাড়ানোর উদ্যোগ

ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে পুলিশের মনোবল বাড়াতে আমরা নানা উদ্যোগ নিচ্ছি। তাদের জন্য ফুটবল টুর্নামেন্টসহ নানা খেলাধুলাসহ আরো কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। আর তাদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার দিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। তারা যাতে নতুন করে কোনো সঙ্কটে না পড়ে সেদিকে আমাদের নজর আছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আহত ও নিহত পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের বিষয় যার যার বিভাগ দেখছে।’

পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘আসলে পুলিশকেও বুঝতে হবে তারা অতীতে কী ভূমিকা পালন করেছে। আর সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে তাদের রাজনৈতিক নেতারা ব্যবহার করেছে।’

তার কথা, ‘পুলিশকে যেকোনো পরিস্থিতিতে আইনসম্মতভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। রাস্তা বন্ধ করে কেউ তো সমাবেশ করতে পারে না। কাকরাইলে অডিট ভবনের সামনে রাস্তা অবরোধ করা বেআইনি। তাদের সরিয়ে দেয়া তো পুলিশের কাজ। সেটা তাদের করতে হবে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তাদের ফোর্সদের বোঝাতে হবে যে, আইনগত দায়িত্ব পালনে তারা বাধ্য। তাদের এখনকার নিস্ক্রিয়তার ভিতরে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা তাও দেখতে হবে।’

পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদা বলেন, ‘নাগরিকদেরও বুঝতে হবে কোনোটা আইনসম্মত আর কোনোটা বেআইনি কাজ। আরেকটি বিষয়। আপনি পুলিশের সহায়তা ছাড়া চলতে পারবেন না। আবার পুলিশকে অপমান অপদস্থ করবেন এই মানসিকতা থেকেও বের হয়ে আসতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘পুলিশকেই এখন তার ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। সেটা তাদের নিস্ক্রিয়তার মধ্য দিয়ে সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের পাশে থাকলেই সেটা সম্ভব।’

সূত্র : ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement