জীবনের যে গল্প অন্ধকারেই থেকে যায়
- তাহফিম হাসান মেহেদী
- ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০৫
সাড়ে পাঁচ ফুট মানুষের ছায়া তখন এক ফুট। রাবি মেইনগেট থেকে সাহেব বাজার যাবো। আমি সাধারণত অটোর সামনের সিটে বসি। আজো ব্যতিক্রম হলো না। চালকের পাশে বসি মূলত টুকটাক কথা বলার জন্য। কোনো এক কারণে চুপচাপ বসে আছি, কোনো কথা বলছি না। ভদ্রলোকের বয়স ৪৫ থেকে ৫০-এর মধ্যে। গায়ে আকাশি রঙের হাতাকাটা শার্ট, গায়ের রঙ শ্যামলা। কাজলা পর্যন্ত আসার পর চালকের ফোনে একটি কল এলো। কল রিসিভ করে কথা বলছেন। কথা শুনে মনে হচ্ছে, জমি সংক্রান্ত কোনো ঝামেলা চলছে। ফোন রাখতেই জিজ্ঞেস করলাম-
‘মামা, গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন কোত্থেকে?’
উনি অবাক হয়ে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি আমার পরিচিত কেউ? আমি পড়াশোনা করেছি আপনাকে কে বলেছে?’
-কেউ বলেনি। আপনি যখন ফোনে কথা বলছিলেন আপনার শব্দচয়ন, উচ্চারণ ও কথা বলার ধরন শুনে মনে হয়েছে আপনি একজন গ্র্যাজুয়েট।
-ওহ আচ্ছা, আপনার অনুমান সত্য। পড়াশোনা করেছি অনেক টানাপড়েনের মধ্যে। বাবা পড়াশোনার খরচ দিতে পারতেন না। তার পরও কষ্ট করে রাজশাহী কলেজ থেকে অনার্স শেষ করেছি। কষ্ট করলে নাকি কেষ্ট মিলে, আমার ক্ষেত্রে সেটিও মিথ্যা হয়েছে। তার পর চাকরির জন্যও চেষ্টা করেছি, কোথাও হলো না। অবশেষে হাল ছেড়ে পেশার বিবর্তনে আজ অটোরিকশায়।
-আচ্ছা, সঙ্গীতচর্চাও করতেন বোধ হয়?
আমার কথা শুনে আবারো অবাক হয়ে একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিতেই, আমি বললাম-
-মানে মেইনগেইট থেকে আসার সময় আবদুল হাদির ‘কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিলো না’ গানের সুর গুনগুনিয়ে গাচ্ছিলেন, আমি চুপচাপ শুনছিলাম তাই আর কি জিজ্ঞেস করা।
-মামা, গানের প্রতি প্যাশন ছিল। একটা সময় সঙ্গীতচর্চা করতাম। আমি রাজশাহী বেতারেও গান করেছি। সঙ্গীত দিয়ে মন ভরে কিন্তু পেট তো ভরে না। তখন সবে বিয়ে করেছি। কিছু দিন পর বাবা মারা গেলেন। শেষ পর্যন্ত পেটের দায়ে কাজে নামতে হয়েছে। সমাজে টাকাওয়ালা মূর্খ মানুষের সামনে টাকা ছাড়া শিক্ষিত মানুষকে কেউ দাম দেয় না।
-পৃথিবীতে সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে অর্থের সমস্যা। মামার বাসায় কে কে আছেন?
-বাড়িতে সবাই আছে। আপনার মামী আর ছেলেমেয়ে। কিন্তু আমার কেউ নাই। কারণ আমি সংসার চালাতে পারি কিন্তু স্ত্রী-সন্তানদের শখ-আহ্লাদ পূরণ করতে পারি না। এখন আমার বাড়ি বলতে গেলে এই অটো, শহরের রাস্তা আর আমার প্যাসেঞ্জার। সুখ-শান্তিও এখানেই। ছেলেটাকে এডমিশন কোচিং করালাম, চান্স হলো না কোথাও। পরে বললাম সরকারি কোনো কলেজ থেকে পড়াশোনা করতে। তারা মা-ছেলে কেউ রাজি হলো না। আপনার মামী ছেলেকে ভর্তি করালেন প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে। এত টাকা আমি কোথায় থেকে দেবো! তার ভাইদের সাপোর্ট নিয়ে ছেলের পড়ার খরচ চালাচ্ছেন।
এতটুক বলতে বলতে তালাইমারি পর্যন্ত এসে ব্রেক করলেন। আরেকজন যাত্রী উঠল। আমি তার দিকে কান পেতে চুপচাপ বসে আছি। দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার শুরু করলেন।
-এগুলা কষ্টের কথা কাউকে বলা যায় না। আপনি শুনলে আপনারও মন খারাপ হয়ে যাবে।
-মামা আপনার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা না থাকলে বলতে পারেন, শুনি...
-শুনেন, গত শুক্রবার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বাড়িতে ফিরেছি। এসে দেখি আপনার মামী টিভি দেখছে আর ছেলেটা পাশে বসে ফোন চাপছে। বেশ ক্ষুধা লেগেছিল। একবারের জায়গা দুবার খাবার দিতে বললাম দেখে আপনার মামী চেঁচিয়ে বলছে, ‘তোমার একটু নিস্তার নেই, আমাকে আর শান্তি দিলে না।’ পাশ থেকে ছেলেটাও বলছে, ‘আম্মু, তুমিও না! এই লোকটার সাথে কেন যে কথা বলো! দেখছই তো এমন।’ ছেলের মুখে এমন কথা শুনে আমার কেমন কষ্ট লেগেছে এটি আপনি বাবা হয়ে ছেলের মুখে না শুনলে বুঝতে পারবেন না। আজকে যদি আমার অগাধ টাকাপয়সা থাকত তাহলে সংসারে কেউ এমন ফালায়া-চড়ায়া কথা বলতে পারত না। জীবনে অর্থসঙ্কট হচ্ছে সমস্যার গাছ, অন্য যত সমস্যা সেগুলো ওই গাছেরই ডালপালা। এত এত কষ্টের মধ্যে নিজেকে খুব একলা লাগে। কার জন্য বেঁচে আছি, কীসের আশায়, মনকে জিজ্ঞেস করলে প্রত্যুত্তরে কিছু আসে না। শুনতে শুনতে কখন যে জিরো পয়েন্ট চলে এসেছি, খেয়ালই ছিল না। মামা বললেন, ‘এখানেই নামবেন নাকি আরেকটু সামনে?’
আমি বললাম, ‘এখানেই রেখে যান’।
মানিব্যাগ থেকে ১০০ টাকার নোট বের করে দিলাম। তিনি টাকা রাখতে রাখতে বললেন, ‘মামা, জীবনে ভালো কিছু করিয়েন যাতে টাকার কষ্টে ভোগা না লাগে। আর একটি কথা, মা-বাবাকে কখনো কষ্ট দিয়েন না।’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, দোয়া করবেন, মামা।’
কথাগুলো শুনে গভীর বিষণœতা আমাকে পেয়ে বসেছে। চোখের সামনে অনেকগুলো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ভেতর, সেই অটোটা হারিয়ে গেল ব্যর্থ জীবনের গল্পের মতো। তখন মধ্যদুপুর, ফোনের নোটপ্যাড বের করে লেখলাম-
‘হেমন্তের পাতা ঝরা মধ্যদুপুরে-
নিজের ছায়াকেও খুঁজে পাই না পাশে
তখন নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে,
নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি-
দেহহীন আত্মা, নাকি আত্মাহীন দেহ?’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা