২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জীবন সংগ্রাম

জীবন সংগ্রাম -

সময় তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। চারদিকে আজানের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আজানের সুমধুর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত, পাহাড়-পর্বত প্রকম্পিত। কর্মময় মানুষ ফিরছে আপন আপন নীড়ে। পাখিদের ডানা ঝাপটানি, কবুতরের বাকবাকুম শব্দ, পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্তের রক্তিম আভা রাতের শুভাগমনের সংবাদ জানাচ্ছিল। ঠিক ওই সময় সুন্দর, ফুটফুটে নিষ্পাপ এক শিশু আগমন করল সোহরাবের ঘরে।
সোহরাব আলি খান একজন সরল, সাদাসিধে গ্রাম্যমানুষ। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল না থাকায় ছোটবেলা থেকেই অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করতে হয়।
পিতা শাহাবুদ্দিন খান অতিশয় বৃদ্ধ হওয়ায় ছোটবেলায়ই সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। ফলে লেখাপড়া আর ভাগ্যে জুটেনি। মা মমতাজ বেগম ছেলে সোহরাব আলীর দিনমজুরের টাকা দিয়ে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছিলেন।
বালক সোহরাব আলী ছিল খুবই উদ্যমী ও কর্মঠ ছেলে। এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা, বখাটে ছেলেদের মতো বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আড্ডা মারা ছিল তার ভীষণ অপছন্দ। ফলে বালক সোহরাব আলীর নিরবচ্ছিন্ন শ্রম ও চেষ্টায় কিছু দিনের মধ্যেই এ অভাবী ছোট্ট সংসারটি হয়ে ওঠে স্বাবলম্বী ও সুখীময়।
পিতা শাহাবুদ্দিন খান ভাবতে লাগলেন নতুন কথা। ছেলে বড় হয়েছে, কর্মঠও বটে। তাই তিনি আর বিলম্ব না করে ছেলের জন্য যোগ্য কনে খুঁজতে লাগলেন, যাকে পুত্রবধূ করে নিজের বাড়িতে আনবেন। পেয়েও গেলেন পাশের গ্রামের বাহাউদ্দীন তালুকদারের রূপবতী, গুণবতী দ্বীনদার পছন্দের মেয়েকে। ঠিক হলো বিয়ের দিন-তারিখ। একমাত্র ছেলেকে বিয়ে করাবেন বলে তিনি আজ মহাখুশি। এই খুশিতে তিনি সমাজের পরিচিত সবাইকে দাওয়াত দিলেন।
জমকালো এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো সোহরাবের শুভবিবাহ। সোহরাব নববধূকে নিয়ে ফিরছেন নিজ বাসগৃহে। আজ সোহরাবের এক অন্যরকম আনন্দ ও ভালোলাগার দিন। কারণ আজ সে নতুন জীবনে পদার্পণ করছে।
শুরু হলো নবজীবনের পথচলা। প্রেম-ভালোবাসা ও সুখময়তার মধ্য দিয়ে বেশ ভালোই কাটছিল তাদের যুগল জীবন। এক বছর যেতে না যেতেই সোহরাবের ঘরে আগমন করল নতুন এক মেহমান! সোহরাব হলেন পুত্রসন্তানের বাবা। স্ত্রী সালমা বেগম স্বামী সোহরাব আলী খানের নামের সাথে মিলিয়ে আদরের সন্তানের নাম রাখলেন সাখাওয়াত হুসাইন সাকী। সবাই তাকে সাকী বলেই ডাকে।
মা সালমা বেগম আশায় বুক বেধেছেন যে, আদরের ছেলে সাকীকে দেশখ্যাত হাফেজ আলেম বানাবেন। সাকীর বয়স তিন কিংবা চার । সাকী হাঁটতে শিখেছে , আব্বু আম্মু বলতে শিখছে, শিখেছে আলিফ, বা, তা, ছা, পড়তে। সালমা বেগম ছেলেকে নিয়ে সুখস্বপ্ন দেখছিলেন যে, ছোটবেলা থেকেই ছেলেকে আদর্শবান করে গড়ে তুলবেন।
কিন্তু হঠাৎই সোহরাবের ঘরে অবর্ণনীয় এক মহাবিপদ নেমে এলো! সাকীর আম্মু খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু এতক্ষণে তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। হাসপাতালে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করলেন। সোহরাবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! হাসপাতালের জানালার গ্রিল ধরে অশ্রুসিক্ত চোখে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সোহরাব। অপলক দৃষ্টিতে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আছেন। আর ভাবছেন এ কী ঘটে গেল!
মুহূর্তেই সাকীর আম্মুর সব স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে গেল। সাকীকে এতিম করে তিনি পরপারে পাড়ি জমালেন। দু’বছর কেটে গেল। সাকীর বয়স ছয়। মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য সাকীর দাদু সাকীকে গ্রামের বড় মাদরাসায় নূরানি বিভাগে ভর্তি করে দিলেন। মাত্র এক বছরে সাকী নূরানি-নাজেরা সম্পন্ন করে ফেলল। সাকী এখন হিফজ বিভাগের ছাত্র, সাকী শেষ রজনীতে উঠে কুরআন তিলাওয়াত করে মায়ের জন্য দোয়া করে। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই হিফজও সম্পন্ন করে ফেলল সাকী। মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে সাকীকে পাগড়ি প্রদানের মাধ্যমে সম্মাননা দেয়া হলো। যদি আজ সাকীর আম্মু বেঁচে থাকত, তবে নিজের চোখে ছেলের সফলতা দেখতে পেত! দেখতে পেত নিজের কাক্সিক্ষত বাসনা! মুগ্ধ হতো বারবার।
সাকী এখন কিতাব বিভাগে ভর্তি হয়েছে। শুরু হয়েছে তার জীবনের নতুন পাঠ। কিন্তু এরই মধ্যে তার জীবনে এক মহাবিপর্যয় নেমে এলো! দু’মাস হলো তার আব্বু দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, প্রিয় সন্তানের দেখাশোনা ও ভাঙা সংসারটি নতুন করে সাজাতে। কিন্তু ভাগ্য তার সঙ্গ দিলো না, উল্টো হয়ে দাঁড়াল! সৎমা তাকে দেখতে পারে না। আর স্বাভাবিকভাবেই সৎমায়েরা এমনই হয়ে থাকে। তারা সৎসন্তানেরদের দেখতে পারে না। এমনকি সে আস্তে আস্তে তার আব্বুকেও নিজের কব্জা করে নেয়। ফলে সাকীর আব্বু সাকীর থেকে অনেক দূরে সরে যায় এবং সাকীকে ভুলে যায়। এখন সে আগের মতো সাকীর খোঁজখবর রাখে না। লেখাপড়ার খরচও ঠিকঠাক মতো দেয় না। কিন্তু সাকী মায়ের স্বপ্ন পূরণে বদ্ধপরিকর। কোনো সমস্যা তাকে কাবু করতে পারেনি। শত সমস্যা মোকাবেলা করে সে তার লেখাপড়া অব্যাহত রেখেছে।
আজ সাকী মেশকাত জামাতের ছাত্র। প্রায় মায়ের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথে! কিন্তু প্রতিবন্ধকতা যেন তার সঙ্গ ছাড়ছে না। ইদানীং সাকী শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চিকিৎসায় ব্যয়বহুল খরচ হয়ে যাওয়ায় আর্থিকভাবে খুবই সঙ্কটে পড়ে গেছে। বর্তমানে সে শারীরিক ও মানসিকভাবে খুবই দুরবস্থা নিয়ে দিন গুজরান করছে। তার লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। কিন্তু এখনো সে হাল ছাড়েনি। সংগ্রাম করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য।

 


আরো সংবাদ



premium cement