২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

উচ্চ আদালতের বিচারকের ক্ষমতার অপব্যবহার ও যথেচ্ছ আচরণ

সুশাসন
-

একটি দেশ কতটুকু উন্নত ও সভ্য তা নিরূপণের মাপকাঠি হচ্ছে সে দেশের প্রধান বিচারপতিসহ উচ্চ ও অধস্তন আদালতের বিচারকরা সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে সুবিচারের মাধ্যমে মানুষের মর্যাদা সমুন্নত ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কতটুকু সচেষ্ট। পৃথিবীর সর্বত্র বিচার বিভাগকে বলা হয় মানুষের শেষ ভরসাস্থল। অন্যান্য দেশে মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে, তারা অপর সব স্থান থেকে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হলেও বিচারালয়ে গিয়ে কাক্সিক্ষত প্রতিকারপ্রাপ্ত হবেন। এ কারণে পৃথিবীর সর্বত্র বিচার বিভাগ মানুষের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কিছু বিচারকের সংবিধান ও আইনের ব্যত্যয়ে স্বেচ্ছাচারী আচরণে আমাদের বিচার বিভাগ বিচারবঞ্চিতসহ সচেতন নাগরিকদের একটি বড় অংশের কাছে মানুষের অধিকার হরণের প্রতিষ্ঠান। যেকোনো একজন বিচারকের আচরণ সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী হলে তা সমগ্র বিচার বিভাগের মর্যাদায় আঘাত হানে। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব এ ধরনের বিচারকের অশুভ ও হীন স্বার্থান্বেষী কার্যকলাপ বিষয়ে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক জনমানুষের কাছে বিচার বিভাগকে স্বীয় মর্যাদা ও মহিমায় সমুন্নত রাখার সর্বাত্মক প্রয়াস।
বিচার বিভাগে চাকরিকাল প্রায় চার বছর অবশিষ্ট থাকাবস্থায় আমাকে জ্যেষ্ঠতার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ পদায়ন করা হলে আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর সুবিচার প্রার্থনায় আবেদন করি। আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে আমি আত্মসম্মান রক্ষার্থে চাকরি পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমার চাকরি পরিত্যাগের আবেদনপত্র রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে গৃহীত হয়। তৎপরবর্তী আমার অবসরভাতাসহ অপরাপর আনুষঙ্গিক ভাতাদি প্রদান বিষয়ে প্রথমত ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে, অতঃপর ২০১৪ সালে এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে পুনঃআবেদন করি। বিগত সরকার ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় আমার আবেদন বিষয়ে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
চাকরিতে থাকাকালীন আমার লেখালেখির অভ্যাস ছিল, যদিও তখন আমি ছদ্ম নামে লিখতাম। চাকরি ত্যাগ-পরবর্তী অবসরভাতা ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি প্রদান না করায় আর্থিক সঙ্কট পরিহারে নিয়মিত তিনটি দৈনিক পত্রিকা যথা- যুগান্তর, নিউ এইজ ও নয়া দিগন্তে নিবন্ধ লেখায় মনোনিবেশ করতে হয়। তাছাড়াও আমি দু’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা ও টিভি টকশোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আর্থিক সঙ্কট লাঘবের প্রয়াস নেই। সর্বশেষ আরবিট্রেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট হলে অর্থের টানাপড়েনের সুরাহার পথ প্রশস্ত হয়।
বিচার বিভাগে ৩০ বছর চাকরি জীবনে আমি সবসময় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলাম। বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নতে আমার ভূমিকা বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ পর্যায়ে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সবাইসহ দেশবাসী দেখেছেন। বিচার বিভাগের প্রতি একজন নিবেদিতপ্রাণ বিচারক হওয়া সত্ত্বেও আমি বিচার বিভাগের জনৈক বিচারক শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক দ্বারা কিভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছি তা আমার জন্য গভীর মর্মবেদনা ও পীড়াদায়ক।
আমার বিরুদ্ধে ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও অন্য এক বিচারক সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ থেকে আদালত অবমাননা রুল জারি করে বলা হয় আমি ২৮ জানুয়ারি, ২০১৩ ‘দৈনিক নিরপেক্ষ’ নামক পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বেপরোয়া লোভ-লালসা, অন্যায় আচরণ রোধ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখে আদালত অবমাননা করেছি।
রুল বিষয়ে অবহিত হওয়ার পর আমি সর্বপ্রথম দৈনিক নিরপেক্ষ পত্রিকার নাম জানতে পারি। ইতঃপূর্বে এ পত্রিকার অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। দৈনিক নিরপেক্ষ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য আমি কখনো কোনো নিবন্ধ লিখিনি। ওই পত্রিকায় ছাপানোর জন্য পাঠাইনি।
আমার বিরুদ্ধে রুলটি জারি হওয়ার পর ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দৈনিক নিরপেক্ষ পত্রিকার সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক ও প্রকাশকের নাম ও ঠিকানা রুলের অনুলিপির বিতরণের তালিকা থেকে সংগ্রহপূর্বক ওই পত্রিকার উপরোক্ত পদধারীদের বরাবর চিঠি পাঠিয়ে আমার অনুমতি ছাড়া কী করে তাদের পত্রিকায় ‘বেপরোয়া লোভ-লালসা, অন্যায় আচরণ রোধ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ’ শিরোনামে লিখিত নিবন্ধটি ছেপেছেন সে বিষয়ে পত্র প্রাপ্তির দুই দিবসের মধ্যে তাদের পত্রিকায় দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করে সংবাদ প্রকাশ করতে চিঠি পাঠাই এবং এর অন্যথা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলি।
দৈনিক নিরপেক্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধটি ‘বেপরোয়া দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লোভ-লালসা রোধ ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ’ শিরোনামে দেশের অন্যতম বহুল প্রচারিত ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকায় ২৬ আগস্ট, ২০১২ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রখ্যাত পত্রিকায় প্রকাশের পাঁচ মাসাধিককাল অতিবাহিত হলেও কারো কাছে এটিতে আদালত অবমাননার উপাদান পাওয়া যায়নি। অথচ নামসর্বস্ব পত্রিকায় প্রকাশের পাঁচ দিনের মাথায় আদালত অবমাননার উপাদান পাওয়া গেল, এটি প্রণিধানযোগ্য। নিবন্ধটিতে বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা রক্ষায় আবশ্যিক বিষয়ের ওপর প্রসঙ্গক্রমে আলোকপাত করা হয়েছে।
বিগত দিনে বিচার বিভাগ সম্পর্কে সাবেক প্রধান বিচারপতি রুহুল আমিনের মন্তব্য ‘বিচারক নিয়োগ নিয়ে বিগত বছরগুলোতে মহাপ্রলয় ঘটে গেছে’। সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন তার এক মন্তব্যে বিচার বিভাগ সম্পর্কে বলেন, ‘এখন বিচার বিভাগ কাচের ঘর, এটি যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে।’ উচ্চ আদালতের বিচারক সম্পর্কে বরেণ্য আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিকুল হকের মন্তব্য ‘এখন বিচারকরা মুখ দেখে রায় দেন’। সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু উচ্চ আদালতের বিচারক সম্পর্কে তার এক মন্তব্যে বলেন, ‘যাদের কেরানি হওয়ার যোগ্যতা নেই, তাদের বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।’ উপরোক্ত মন্তব্যগুলো বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে আমার নিবন্ধে তার অনুসরণে বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদাকে সমুজ্জ্বল করতে করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছিল।
একজন সাবেক বিচারক ও দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা অটুট রাখার বিষয়ে আমার নিবন্ধে প্রসঙ্গক্রমে যতটুকু আলোচনা করা হয়েছে তা কোনোভাবে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে না।
২০১১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের সেবা খাতের দুর্নীতি-বিষয়ক প্রতিবেদনে বিচার বিভাগকে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে অভিহিত করে। ওই প্রতিবেদনটি যে ভুল ছিল এটি অদ্যাবধি নির্ণয় করা যায়নি।
বিচার বিভাগ থেকে সামগ্রিকভাবে সবাই সুবিচার পেয়ে থাকলে কেন আমাকে অবমাননাকর পদায়নে প্রতিকার না পেয়ে চাকরি ছাড়তে হলো এবং দীর্ঘ ১৫ বছরের অধিক সময় অন্যায়ভাবে অবসরভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত রাখা হলো? এর দায় কার।
নিবন্ধে বিচার বিভাগ নিয়ে আমার প্রাসঙ্গিক আলোচনায় কোনোভাবে দেশের বিশিষ্ট চারজন ব্যক্তির মন্তব্যে যে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তা অতিক্রম করে কোনো কিছু ব্যক্ত করা হয়নি। সে ক্ষেত্রে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল সংবিধানে ২৭ অনুচ্ছেদে বিবৃত ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’ এ বিধানটির পক্ষপাতমূলক প্রয়োগ নয় কি?
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে আইনের দ্বারা যে যোগ্যতা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে আমার নিবন্ধে তার আলোকে সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবীদের নিয়োগ দিয়ে বিচার বিভাগকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো জনগণের শেষ ভরসাস্থলের আস্থায় প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সে আস্থা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে যদি জ্যেষ্ঠদের সততা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও মেধার অবমূল্যায়নে কনিষ্ঠদের বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয়!
বিচারক নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, সততা ও মেধা অবমূল্যায়িত হয়েছে কি-না সে বিষয়ে উচ্চ কমিশন গঠন করা হলে আমার নিবন্ধে বিচার বিভাগ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনা এবং দেশের চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মতামত যথাযথ কি-না সে বিষয়ে সম্ভাব্য বিতর্কের অবসান হবে।
আদালত অবমাননা বিষয়ে যে নির্ধারিত বেঞ্চ রয়েছে সে বেঞ্চ ছাড়া আদালত কক্ষের বাইরে অবমাননাসংক্রান্ত কিছু ঘটে থাকলে ক্ষমতাবহির্ভূত বেঞ্চের এ ধরনের আবেদন গ্রহণ আইন দ্বারা সমর্থিত কি-না তা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের কোন কোন বিচারক সমন্বয়ে কোন বেঞ্চ গঠিত হবে এবং কোন কোন বিচারক কোন উদ্দেশ্যে আসন গ্রহণ করবেন সংবিধানের ১০৭(৩) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী তা নির্ধারণের একক দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির। প্রধান বিচারপতি এরূপ বেঞ্চ গঠনপূর্বক একটি নির্ধারিত বেঞ্চকে যে দায়িত্ব দিয়ে থাকেন অপর কোনো বেঞ্চ ওই নির্ধারিত বেঞ্চের দায়িত্বে হস্তক্ষেপ করলে সে ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির কর্তৃত্ব ও সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্বের ওপর আঘাত আসে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমার ওপর ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ যে বেঞ্চ থেকে রুল ইস্যু করা হয় ওই দিন ওই বেঞ্চের আদালত অবমাননাসংক্রান্ত মামলা গ্রহণ ও বিচারের ক্ষমতা ছিল না। অতএব, নির্দ্বিধায় বলা যায় এভাবে প্রধান বিচারপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা অবজ্ঞাপূর্বক কোনো বেঞ্চ থেকে যদি ভিন্নরূপ কোনো আদেশ দেয়া হয় তাতে কোনোভাবে সংবিধান প্রদত্ত প্রধান বিচারপতির কর্তৃত্ব ও সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন থাকে না।
হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জারিকৃত রুলটি আদালত অবমাননাসংক্রান্ত বেঞ্চ কর্তৃক জারি না হওয়ায় এটি আইনগত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ববহির্ভূত উল্লেখপূর্বক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলের অনুমতি চেয়ে ফৌজদারি সাময়িক দরখাস্ত দায়ের করে স্থগিতাদেশ চাওয়া হলে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিষয়টি শুনানিতে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পরবর্তী দিন শীর্ষ তালিকায় স্থান দেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু বিষয়টি তৎকালীন২০তম প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করা হলেও তিনি এটিকে শুনানি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত কেন করেননি এটি প্রশ্নবাণে আবদ্ধ।
হাইকোর্ট বিভাগ থেকে ইস্যুকৃত রুলে আমাকে ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সশরীরে আদালতে উপস্থিত হয়ে কারণ দর্শাতে বলা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ থেকে আমি মারাত্মকভাবে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ক্রিসেন্ট গ্যাস্ট্রোলিভার অ্যান্ড জেনারেল হসপিটাল লিমিটেডে সকাল ৯টায় উপস্থিত হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ডা: আবু হেনা আবিদ জাফর তাৎক্ষণিক আমার শরীর পরীক্ষাপূর্বক স্যালাইন দেয়ার ব্যবস্থা করেন। স্যালাইন গ্রহণ সমাপ্ত হলে বেলা আনুমানিক ২টায় আমি হাসপাতাল ছাড়ার সময় চিকিৎসক আমাকে মেডিক্যাল সার্টিফেকেট ও প্রেসক্রিপশন প্রদানপূর্বক তিন দিনের পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দেন।
১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ আমার নিয়োজিত আইনজীবী হাইকোর্ট বিভাগে অসুস্থতাজনিত কারণে সময়ের দরখাস্ত করলে আদালত দু’দিনের সময় মঞ্জুর করেন। অতঃপর আমি ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সশরীরে আদালতে উপস্থিত হলে বিচারক মানিক আমাকে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে (বেলা ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা বিরতি ব্যতীত) বিকেল ৪টা অবধি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখে এবং অসংযত ও অসংলগ্ন ভাষা ব্যবহার করে চরমভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেন। এমনকি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং জেলা জজ পদে পদায়ন কিভাবে হলো এরূপ তির্যক প্রশ্ন করেন।
আদালত অবমাননা মামলার প্রতিবাদীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ এবং ১৪৮ অনুচ্ছেদের অধীন একজন বিচারকের স্বপঠিত শপথের পরিপন্থী।
সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না, কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারো সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না।’ স্বপঠিত শপথে একজন বিচারককে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি উল্লেখ করতে হয় ‘তিনি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করবেন।’ আমার ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ এবং শপথের আলোচ্য অংশটুকুর প্রতিফলন ঘটেছে কি-না তা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন ছিল। এ ধরনের দাঁড় করিয়ে রাখা সংবিধানের পরিপন্থী বিধায় তা সংবিধানে নব সন্নিবেশিত ৭ক অনুচ্ছেদের বিধানকে আকৃষ্ট করে।
এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদের যতটুকু প্রাসঙ্গিক তা হলো কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়- এ সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা তা করতে উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে- তার এ কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবে। সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা বা বিশ্বাস তখনই পরাহত হয় যখন একজন বিচারক বা ব্যক্তি সংবিধান বা আইনের ব্যত্যয়ে কোনো কর্ম সম্পন্ন করেন।
বিচারক মানিকের নিয়োগের বৈধতা বিষয়ে তার নিয়োগ-পরবর্তী স্বপঠিত শপথ প্রাসঙ্গিক। শপথগ্রহণ করাকালীন তাকে সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করতে হয়েছিল যে, তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করবেন। শপথগ্রহণ করাকালীন এবং বিচারক পদে চাকরিকালীন তিনি তার যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব পরিহার না করায় তার বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে আনুগত্যের বিভাজনের হার কত এর কি কোনো জবাব আছে! জবাব না থেকে থাকলে তিনি বিচারক পদে থাকাকালীন যেসব রায় ও আদেশ দিয়েছেন তা কি বৈধ?
পরবর্তী দিন ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিচারক মানিক আদেশ না দিয়ে চিকিৎসকের প্রতি নোটিশ জারিপূর্বক তাকে ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ আদালতে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশ দেন।
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ডা: আবু হেনা আবিদ জাফর আইনজীবী ব্যতীত ব্যাখ্যা দিতে আদালতে উপস্থিত হলে আদালত তাকে ভর্ৎসনাপূর্বক আদালতের নির্দেশিত মতে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর কর্তৃক প্রস্তুতকৃত অ্যাফিডেভিটে স্বাক্ষর দিতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। অ্যাফিডেভিট কমিশনারের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে অ্যাফিডেভিটটি স্বাক্ষরের সময় কমিশনারের অনুমতি নিয়ে তাতে কিছু সংশোধন করা হয় এবং প্রতিটি সংশোধনীর বাম পাশে অ্যাফিডেভিট কমিশনার তার স্বাক্ষর করেন। পরবর্তী দিন ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ অ্যাফিডেভিট দাখিল করতে গেলে তাতে কাটাকাটি হওয়ায় বেঞ্চ অফিসার নতুনভাবে অ্যাফিডেভিট করার অনুমতি দেন।
অতঃপর ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ আইনজীবীর মাধ্যমে দ্বিতীয় অ্যাফিডেভিট দাখিল করা হলে বিচারক মানিক চিকিৎসককে কেন দু’টি অ্যাফিডেভিট দেয়া হলো এবং কেন প্রথম অ্যাফিডেভিটে কাটাকাটি করা হলো এ অভিযোগে অশ্রাব্য গালাগাল করেন। একইসাথে আদালতের বিচারক মানিকের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর কর্তৃক প্রস্তুতকৃত অ্যাফিডেভিটের অনুরূপ অ্যাফিডেভিট না করা হলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের হুমকি দেন।
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ চিকিৎসকের আইনজীবী চিকিৎসক আদালতের কার্যপদ্ধতি বিষয়ে অনভিজ্ঞ বিধায় তার পক্ষে কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক দরখাস্ত করলে বিচারক মানিক আগের মতো চাপ প্রয়োগ করে বলেন, প্রথম অ্যাফিডেভিটের অনুরূপ অ্যাফিডেভিট না করা হলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হবে।
আমি চিকিৎসকের কাছে উপস্থিত হওয়ার পর শুধু আমার নাম উল্লেখ করলেও আমি যে আগে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার ছিলাম চিকিৎসক তা জানতে পারেন। আমি কখনো চিকিৎসকের কাছে সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রেজিস্ট্রার ও বিচারপতি এ পরিচয় উল্লেখ করিনি। কিন্তু বিচারক মানিক চিকিৎসকের ওপর চাপ প্রয়োগ করে জোর করে বলাতে চেয়েছিল, আমি মিথ্যা পরিচয় উল্লেখপূর্বক প্রভাব বিস্তার করে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছি। মিথ্যা পরিচয় উল্লেখ করলে অবশ্যই মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ও প্রেসক্রিপশনে আমার নামের আগে জাস্টিস শব্দটি উল্লেখ থাকত। শুধু আমাকে হয়রানি, নাজেহাল, সামাজিকভাবে হেয় এবং আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দেয়ার অভিপ্রায়ে বিচারক মানিকের এ অপপ্রয়াস। উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের এ ধরনের অবৈধ ও অন্যায় আচরণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ না হলে সংবিধান ও আইন যে মূল্যহীন হয়ে পড়ে তার বহিঃপ্রকাশ সম্প্রতি বিচারক মানিকের অবৈধভাবে ভারতে পলায়নের সময় শৃঙ্খলা বাহিনী ও জনসাধারণ কর্তৃক সিলেট সীমান্তে আটক পরবর্তীঘটনাক্রম হতে দেশবাসীর প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটেছে। হ
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement