সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প
- কাজী আশফিক রাসেল
- ০৩ নভেম্বর ২০২০, ০০:০২
ধর্মপ্রাণ প্রতিটি মানুষের কাছে ধর্ম একটি আবেগ অনুভূতির স্থল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, রেষারেষি, খুন-খারাবি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা এমনকি যুদ্ধ-বিগ্রহ পর্যন্ত আমরা অতীতের বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ করেছি এবং এখনো করছি। এখানে প্রশ্ন হতে পারে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কি তাহলে ধর্মের শিক্ষা? বিষয়টি মোটেও তা নয়। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে শান্তির বার্তা। সহিংসতার সাথে ধর্মের কোনোরূপ সম্পর্ক নেই। সংক্ষেপে বলতে গেলে, মুসলিম সম্প্রদায়ের মহাগ্রন্থ আল কুরআনে রয়েছেÑ ‘অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার চালায় এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা আশশুরা, ৪২:৪২) ‘অবশ্যই অত্যাচারীদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে।’ (সূরা ইবরাহিম, ১৪ : ২২) ‘আল্লাহ অত্যাচারীদের পছন্দ করেন না’। (সূরা আলে ইমরান, ০৩ : ১৪০) উপরের আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা মানুষের ওপর অত্যাচার করতে নিষেধ করেছেন। আর এখানে মানুষ বলতে নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ নয়, সমস্ত মানব জাতিকেই বোঝানো হয়েছে।
হিন্দুধর্মের গীতায় রয়েছেÑ ‘যে যথা মাং প্রপদ্যান্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম, মম বর্ত্মানুবর্তস্তে মনুষ্যা : পার্থ সর্বশঃ (গীতা, জ্ঞানযোগ, শ্লোক-১১, পৃষ্ঠা-১২৮) যে আমাকে যেভাবে উপাসনা করে, আমি তাকে সেভাবেই তুষ্ট করি। মনষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে। অর্থাৎ মানুষ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সব পথেই আমাতে পৌঁছাতে পারে। এ শ্লোকে যে হিন্দুধর্মের সম্প্রীতি বার্তা রয়েছে, তা অত্যন্ত স্পষ্ট। গীতা শাস্ত্রী জগদীশ চন্দ্র ঘোষ উপরোক্ত শ্লোকের ভাষ্যে বলেন, ‘গীতার এই একটি শ্লোকের তাৎপর্য বুঝলে প্রকৃতপক্ষে ধর্মগত পার্থক্য থাকে না। হিন্দুর হৃদয়ে ধর্মবিদ্বেষ থাকিতে পারে না।’
বৌদ্ধধর্মের মূলনীতি হলো অহিংসা। বৌদ্ধধর্মের ত্রিপিটকে আটটি সৎ পথের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলোÑ ১. সৎ দর্শন; ২. সৎ আকাক্সক্ষা; ৩. সৎ কথন; ৪. সৎ আচরণ; ৫. সৎ জীবনযাপন; ৬. সৎ প্রচেষ্টা; ৭. সৎ মনোযোগ; ৮. সৎ ধ্যান। কেউ যদি এই আট পথের পথিক হয়, তা হলে তো তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও হিংসাবিদ্বেষের কথা থাকতে পারে না। খ্রিষ্টধর্মে প্রেমকে বড় করে দেখানো হয়েছে। খ্রিষ্টধর্ম প্রেমের ধর্ম। খ্রিষ্টানরা মনে করেন, প্রত্যেকের মধ্যেই খ্রিষ্ট বিরাজ করছেন। ক্ষুদ্রতমের মধ্যেও তিনি আছেন। বাইবেলের মথি পুস্তকের ২৫তম অধ্যায়ের ৩৫ থেকে ৪৫ নং শ্লোকগুলোর ভাষ্যে তা পাওয়া যাবে।
ধর্ম মানুষকে বিপথগামী করে না বরং নিজস্ব অজ্ঞতার জন্য মানুষ ধর্মান্ধ হচ্ছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি বিঘিœত হচ্ছে। মানব সভ্যতার অভিজ্ঞতায় বলে, এক বিরাটসংখ্যক মানুষ নিজ ধর্ম সম্পর্কে জানেন না। অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানার বিষয় তো আরো দূরের ব্যাপার। সত্যিকার অর্থে মানুষ ধার্মিক হলে বিশ্বে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটার কথা নয়।
ইহুদি ধর্মের ১০টি নির্দেশের মধ্যে ষষ্ঠ নির্দেশ হচ্ছে, ‘কাউকে হত্যা করো না’। ইহুদিরা যদি তাদের ধর্মের এ বাণী মানত, তা হলে ফিলিস্তিনে মানুষ হত্যা করতে পারত না। প্রতিটি ধর্মেই ধর্ম প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, কিন্তু কোথাও সহিংসতার মাধ্যমে এ কাজ করতে বলা হয়নি।
নানা ফুল, নানা রূপ, নানা গন্ধ সব মিলিয়ে হয় বাগান। একইভাবে নানা ধর্ম, নানা বর্ণ, নানা সম্প্রদায়ের মানুষের নিজ নিজ বিশ্বাস নিয়ে পারস্পরিক সহাবস্থানই মানবসভ্যতার মূল কথা। এই বৈচিত্র্যের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমেই উন্নতি ও প্রগতি সাধন সম্ভব। নানা বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ের মাঝে সৌহার্দ্য বজায় না থাকলে ধ্বংস অনিবার্য। ভিন্ন ধর্ম বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিষেদাগার, বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ, অশ্রদ্ধা কখনো নিজ ধর্মের মাহাত্ম্য বাড়ায় না। বরং এর মাধ্যমে আপন ধর্মেরই সম্মানহানি হয়। একজন প্রকৃত ধার্মিক কখনো ভিন্নধর্মকে অশ্রদ্ধা করতে পারেন না। কোনো ব্যক্তি নিজ ধর্মের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল তা পরিমাপের সবচেয়ে সহজ মানদণ্ড হলো তিনি ব্যক্তি পরধর্মের প্রতি কতটা উদার মানসিকতাসম্পন্ন।
সব শেষে বরেণ্য শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি : ‘মানুষের জন্য যাহা কল্যাণকর, তাহাই ধর্ম। যে ধর্ম যাপন করিতে গিয়া মানুষের অকল্যাণ করিতে হয়, তাহা ধর্মের কুসংস্কার মাত্র। মানুষের জন্য ধর্ম। ধর্মের জন্য মানুষ নয়।’ হ
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা