০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪২৩১, ৬ শাবান ১৪৪৬
`

আন্দোলনের সেকাল-একাল

-

যুগে যুগে আজকের বাংলাদেশ, অর্থাৎ এক সময়ের পূর্ব বাংলার অধিবাসীরা শোষণ, নির্যাতন আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সংগ্রামী জনতা এই ভূখণ্ডে গড়ে তুলেছেন গণ-আন্দোলনের নতুন নতুন উপাখ্যান। এ অঞ্চলের মানুষ নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ে রক্ত আর জীবন দিয়ে সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজেদের অধিকার। প্রিয় মাতৃভূমিকে বিদেশী শাসন, শোষণের হাত থেকে মুক্ত করতে কালে কালে বহু ব্যক্তিত্বের যেমন জন্ম হয়েছে; তেমনি বহু সংগ্রাম-আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্বাধীন বাংলা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যায়। তার পর থেকেই স্বদেশকে মুক্ত করতে কত বিদ্রোহ, কত আন্দোলন, কত বীর পুরুষের জন্ম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস সোনালি অক্ষর বয়ে বেড়াচ্ছে স্বমহিমায়। তাদের বদৌলতে আজকের এই বাংলাদেশ এক সময় বহুজাতিক সাংস্কৃতিক ধারায় সিক্ত হয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বৈচিত্র্যময় এক ভূখণ্ডে পরিণত হয়। আর্য, পাল, সেন, মোগল, পাঠান, পর্তুগিজ, ফরাসি, পারসিয়ান অবশেষে ইংরেজ শাসনের হাত থেকে অসংখ্য মানুষের জীবন উৎসর্গ, নীল বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, সন্ন্যাস বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদুমিয়ার সংগ্রাম, সিপাহী আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গসহ লক্ষ নারীর ইজ্জত-সম্ভ্রম হারিয়ে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে মুক্তি পেয়ে জন্ম নেয় ভারত-পাকিস্তান নামের দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র।
বাংলার পূর্বাংশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু আবারো ইতিহাসের নিষ্ঠুর আচরণের শিকারে পরিণত হলেন পূর্ব বাংলার মানুষ। বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে রচনা করতে শুরু করলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন ইতহাস। এই নতুন ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ভেতর দিয়ে। দেশ স্বাধীন হয়েছে সত্য, কিন্তু এ দেশের মানুষ আজো স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ নিতে পেরেছে কি? এখনো এই দেশের মানুষকে তার অধিকার আদায়ে রক্ত দিতে হয়, সংগ্রাম করতে হয়। দেশ স্বাধীনের পরও আমাদের গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করতে হয়। ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছিল বটে, কিন্তু সেই গণতন্ত্র এখন ভূলুণ্ঠিত। ১৯৫২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ অধিকার আদায়ে যত সংগ্রাম করেছে; তার সব কয়টিতেই সফলতা অর্জন করলেও এখন কোনো আন্দোলন-সংগ্রামেই মানুষের অধিকার আদায় সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু কেন?
আন্দোলনের মর্মকথা হচ্ছে, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে জনগণের কোনো-না-কোনো অংশের সামষ্টিক সচেতন আলোড়ন সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক (ক্ষেত্রবিশেষে অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক) কর্মকাণ্ড। আন্দোলন তখনই সফলতা পায়, যখন দেশের সবাই বা বেশির ভাগ মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সজাগ করে তোলা যায়। মানুষ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এ চেতনা সাধারণের চিন্তায় ছাড়িয়ে দিতে পারলে গণমানুষ অধিকার আদায়ে রাজপথে নেমে আসে। তখনই যেকোনো আন্দোলন সফলতার মুখ দেখে। তবে আন্দোলনের চেতনা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছানো নির্ভর করে কেন্দ্রের কৌশল নির্ধারণের ওপর। দুনিয়ায় যত আন্দোলন-সংগ্রাম সফল হয়েছে; এর সব ক’টিই কেন্দ্র থেকে শুরু হয়েছে এবং তা সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। আন্দোলনে সফলতা পেতে সুনির্দিষ্ট দাবি-দাওয়া, ইস্যু বা চূড়ান্ত লক্ষ্য; জনগণের অংশগ্রহণ; এর স্বরূপ; বৈধ ভিত্তি (সাংবিধানিক-আইনগত) এবং পরিধি নিরূপণ জরুরি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত এবং দেশ স্বাধীনের পর ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিটিতে সফলতার দিক বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর উপস্থিতির প্রতিফলন ঘটেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সাধারণের কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল যে, ‘ওরা আমাদের মায়ের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’ সব শ্রেণীর মানুষ এই চেতনায় আন্দোলিত হয়েছিল। ফলে সেদিন আমাদের ভাষা রক্ষা পেয়েছিল।
ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল ভূমি। এই আন্দোলন আমাদের গণচেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ ভূমিকা। ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এ আন্দোলন পর্যায়ক্রমে জাতিকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলাম, তা পরবর্তী আন্দোলনগুলোর জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা, ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলনের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল সুগভীর। যার কারণে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপ নেয়। এ যুদ্ধের বিজয় কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর একার সফলতা নয়; সবার বিজয়। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানেও সব শ্রেণীর মানুষকে সম্পৃক্ত করা গিয়েছিল। সেখানে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল গণমানুষের অধিকার আদায়। আমরা স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে অর্জন করতে চেয়েছিলাম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন, মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ দেশের আর্থ-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। সে লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কি না; তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। স্বৈরাচার পতন হয়েছে ঠিকই; কিন্তু এখনো গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিতে হয়, জেল খাটতে হয়।
গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, অবাধ-সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত সমাজ গঠন, নারীর অধিকার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা সময়ের দাবি। কিন্তু সেই আন্দোলন গড়ে উঠছে না কেন? মোটা দাগে এর উত্তর হলো, এখন যেসব আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়, সেখানে জনগণের বিন্দুমাত্র কোনো স্বার্থ থাকে না। ফলে সর্বসাধারণ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয় না। জনগণের অধিকারের চেয়ে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের অভিপ্রায় বেশি বিদ্যমান থাকে সাম্প্রতিক সময়ের আন্দোলনগুলোতে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কোনো আন্দোলন আর সফলতা পাচ্ছে না। এই সুযোগে সরকার সহজে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠায় সাম্প্রতিক সময়ে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ হয়ে পড়েছে সঙ্কুচিত।
অথচ নব্বইয়ে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে নূর হোসেন, সেলিম, জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালি, দেলোয়ার, তাজুল, জিহাদ, ময়েজউদ্দিন, বসুনিয়া, ডা: মিলনসহ অনেকে জীবন দেননি। আজকে গণতন্ত্রের নামে যা হচ্ছেÑ তা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ চেতনার পরিপন্থী। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যারা গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়েছেন, তাদের রক্তের সাথে বেঈমানি। আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে; কিন্তু সব মানুষের অধিকার এক ও অভিন্ন। তাই যে চেতনার জন্য অগণিত মানুষ জীবন দিয়েছেন, সেই চেতনা উজ্জীবিত করতে না পারলে এর দায় আমাদেরই বইতে হবে। গণতন্ত্র, ভোট-ভাতের অধিকার, সাম্য ও আইনের শাসন, আর্থিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার, বিচার বিভাগীয় পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া যুগে যুগে যে চেতনার জন্য রক্ত দেয়া হয়েছে; তা অধরাই থেকে যাবে।
যধৎঁহথ৯৮০@ুধযড়ড়.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement
সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ মির্জাপুরে ছিনতাই হওয়া ট্রাকসহ ১২ হাজার লিটার সয়াবিন উদ্ধার নবীনগরে তিতাস নদীতে ট্রলার ডুবিতে নিহত ১ বগুড়ায় ইজিবাইকচাপায় ভাই-বোন হতাহত একুশে পদকের জন্য মনোনীত ১৪ ব্যক্তি ও নারী ফুটবল দল চ্যাটজিপিটির বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো পাকিস্তান থেকে চিটাগুড় আমদানি করছে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে বিপদে অস্ট্রেলিয়া সিংগাইর থানার ফেসবুক আইডিতে শেখ হাসিনার বক্তব্য শেয়ার, দুঃখ প্রকাশ এলজিইডি ক্রিম-ক্রিলিকের কেএফডব্লিউ রিভিউ মিশন সম্পন্ন সিলেটে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারের পাশে জামায়াত

সকল