ধূমপান একটি সামাজিক ব্যাধি
- সালমান মাসউদ
- ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০
ধূমপানের বহুমাত্রিক ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আমরা সবাই কম-বেশি জানি। এরপরও দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১৯৫০ সাল থেকে নিয়ে ২০০০ সাল পর্যন্ত শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ধূমপানে সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় প্রায় ছয় কোটি মানুষ, যাদের বেশির ভাগই ছিল যুবক। এ ছাড়া ধূমপান নিঃসন্দেহে অর্থের অপচয়। অপচয়ের ব্যাপারে ঐশী গ্রন্থ আল কুরআনের বাণীÑ ‘তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় প্রভুর অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা ইসরা, আয়াত ২৬-২৭০)। সুতরাং কাজটি যে কদর্য ও নিন্দনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাস্তব প্রেক্ষাপটে নেশাগ্রস্ত একজন ধূমপায়ী গড়ে দৈনিক ৮-১০টি শলার ধোঁয়া হজম করেন। বর্তমান বাজারে সর্বনি¤œ এক শলা সিগারেটের দাম চার টাকা এবং সাধারণ্যে প্রচলিত দামি সিগারেট বেনসনের এক শলা পেতে গুনতে হয় ১৩ টাকা। চার টাকার শলা সিগারেট কিনতে প্রতিদিন ব্যয় ৪´১০=৪০ টাকা। মাসে ৪০´৩০= ১২০০ টাকা। বছরান্তে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৪০০ টাকা। ঠিক এমনিভাবে যদি তার অর্থের দাপট ১৩ টাকা মূল্যের বেনসনের ঝাল সহনীয় করে নিতে পারে। তবে বছর ঘুরলে অযথা ব্যয়ের খাতে যুক্ত হবে ৪৬ হাজার ৮০০ টাকা। এ বিপুল অঙ্কের অর্থ অপচয়, যা আমাদের এ দরিদ্র দেশে বহু পরিবারের বার্ষিক আয়েরও বেশি। যদি তা এই অযাচিত উপায়ে ব্যয় না করে ইতিবাচক সমাজ বিনির্মাণে ব্যয় করা হতো, তবে তা আমাদের জন্য প্রভূত কল্যাণ বয়ে আনত। পবিত্র কুরআনের ভাষায়Ñ ‘তিনি তাদের সৎকাজের আদেশ করেন ও অসৎ কাজে নিষেধ করেন এবং তিনি তাদের জন্য হালাল করেছেন ভালো ও উত্তম বস্তু আর হারাম করেছেন মন্দ ও নিকৃষ্ট বস্তু।’ (সূরা আরাফ, আয়াত ১৫৭)। অন্যত্র আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেনÑ ‘তোমরা ব্যয় করো আল্লাহর পথে আর নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে ফেলে দিও না।’ (বাকারা, আয়াত-১৯৫)। বদ অভ্যাসে পরিণত হওয়া ধূমপানের সৃষ্টিই ধ্বংসের জন্য; কল্যাণের জন্য নয়। আল কুরআনের আরেক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘(জাহান্নামের খাদ্য) না পুষ্টি জোগাবে না ক্ষুধা নিবারণ করবে।’ (সূরা গশিয়াহ, আয়াত ৭)। বিড়ি, সিগারেট, চুরুট কিংবা তামাক, জর্দা, গুল ইত্যাদি সেবনকারীকে কোনো ধরনের পুষ্টির জোগান দেয় না এবং ক্ষুধাও নিবৃত্ত করে না।
সামাজিক জীবনে একজন ধূমপায়ীকে অনেক সময় লজ্জাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের সমাজে ধূমপায়ীকে সর্বমহলে ভালো চোখে দেখা হয় না। আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, একজন ধূমপায়ী আক্রান্ত হতে পারেন কঠিন ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে। যেমনÑ ধূমপানকারী পুরুষের ফুসফুস, মূত্রথলি, ঠোঁট, মুখ, জিহ্বা, কণ্ঠনালী, কিডনি ইত্যাদির ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। নারী ধূমপায়ীর ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে ১২ দশমিক ২ শতাংশ। ধূমপানের কারণে রক্তনালীগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে অনেক সময় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ধূমপান স্মরণশক্তি কমিয়ে দেয়াসহ ইন্দ্রিয় ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। বিশেষ করে শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। ধূমপায়ীর শরীরে প্রদাহ ও জ্বালাপোড়া ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি রোগ দেখা দিতে পারে। ধূমপানের কারণে হার্টের সাথে সম্পৃক্ত ধমনিগুলো ব্লক হয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। ধূমপান উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে এবং যৌনক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ করে দেয়। ধূমপানের ফলে পাকস্থলী ক্ষত হতে থাকে এবং যকৃত শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ধূমপানের ফলে মূত্রথলির যক্ষ্মা হতে পারে। প্রস্রাব বিষাক্ত হয়ে যায়। এ ছাড়া ধূমপায়ী হজমশক্তির দুর্বলতা, চোখে ছানি পড়া, মাথায় টাক পড়ে যাওয়া, ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়াসহ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে।
পরিবর্তন এসেছে তামাকদ্রব্য ধূমপানের ব্যবহারে। এক সময় তামাক সেবনের ছিল হুকা। কিন্তু সময়ের আবর্তনে ধূমপানে এসেছে তামাকভর্তি শলার ব্যবহার। এখন আধুনিক ঘরানার তরুণেরা ধূমপানে ব্যবহার করছেন ফিল্টার। তাদের ধারণায় যা তাদের ভয়াবহ রোগব্যাধি থেকে সুরক্ষা দেবে। বাস্তবতা হচ্ছে, ধূমপান যেভাবেই করা হোক না কেন, তা সব সময়ই ক্ষতিকর। দেশ আজ মাদকের কালো থাবায় ক্ষতবিক্ষত। একজন মাদকসেবী প্রথমেই ইয়াবা সেবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে না। প্রথম দিনেই সে ফেনসিডিলের বোতলে চুমুক দেয়ার দুঃসাহস দেখায় না। এক দিনেই কেউ গাঁজা বা হেরোইনসেবী হয়ে যায় নাÑ যে সিগারেটের ধোঁয়াই গলাধঃকরণ করতে সক্ষম নয়, কিভাবে সে সইবে ইয়াবার ঝাঁজ? কিভাবে তার কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে গাঁজার অগ্নিধোঁয়া? মাদকের হাতেখড়ি ধূমপান ও তামাকজাতীয় দ্রব্যের খাদ্যাভ্যাস থেকে। সুতরাং মাদককে নিরুৎসাহিত করতে হলে প্রথমে তরুণ ও যুবসমাজকে বাঁচাতে হবে ধূমপানের মরণ ছোবল থেকে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাপনায় ধূমপান সামাজিক অবক্ষয় বলে বিবেচিত নয়। সভ্য সুন্দর মাদকমুক্ত সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে প্রথমে চাই ধূমপানমুক্ত পরিবেশ। সচেতনতার আহ্বান ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরে। সচেতনতার আহ্বান থাকতে হবে প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষার প্রতিটি স্তরে। আহ্বান জানাতে হবে ধর্মীয় ব্যক্তিদের অবস্থান অনুযায়ী নিজ নিজ জায়গা থেকে। তবেই সম্ভব হতে পারে ধূমপান ও মাদকের তীব্র ছোবল থেকে জাতিকে বাঁচানো। সম্ভব হতে পারে নির্মল ও মাদকমুক্ত শুভ্র পরিবেশে আমাদের আগামী প্রজন্মের স্বস্তির নিঃশ্বাস গ্রহণÑ আল্লাহ আমাদের মাদক ও ধূমপানমুক্ত সুশৃঙ্খল একটি সমাজ গড়ার তৌফিক দান করুন। হ
লেখক : শিক্ষার্থী, কওমি মাদরাসা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা