০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১, ৭ শাবান ১৪৪৬
`

শিক্ষকদের বেতন কর্তন ও কমিশন গঠন

-

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের তিনটি ক্যাটাগরি রয়েছে। প্রথমটিÑ সাধারণ শিক্ষা ক্যাটাগরি; যেমন-স্কুল ও কলেজ; দ্বিতীয় ক্যাটাগরিÑ ধর্মীয় শিক্ষা, যেমন-মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আলিয়া নেসাব; তৃতীয়টি হলো কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা। এই তিন ভাগের মধ্যে সরকার সর্বপ্রথম কারিগরি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা বাবদ দুই ভাগ আর কল্যাণ ট্রাস্ট বাবদ দুই ভাগসহ মোট চারভাগ বেতন অতিরিক্ত কেটেছে; যা জানুয়ারি ১৯ থেকে কার্যকর হয়েছে। এরপর মাদরাসার আলিয়া নেসাবের শিক্ষকদের বেতন থেকে একই হারে কাটা হয়। সবশেষে সাধারণ শিক্ষা ক্যাটাগরির শিক্ষকদের বেতন থেকে অতিরিক্ত চার ভাগ বেতন কাটা হয়েছে। ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে। সরকার ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্র দু’টি শিক্ষক শ্রেণীর বেতন অতিরিক্ত কেটে সবশেষে শিক্ষকদের বড় শ্রেণীগোষ্ঠীর বেতন কাটে। এতে প্রতীয়মান হয়, সরকার পরীক্ষামূলকভাবে আগে ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর বেতন কাটে। সরকার লক্ষ্য করেছে, অন্য বড় শিক্ষক সম্প্রদায় কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয় কি না। প্রথম দুই শিক্ষক শ্রেণী সংখ্যায় এত লঘিষ্ঠ, তাদের পক্ষে কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সাধারণ শিক্ষা ক্যাটাগরির বড় শিক্ষক গোষ্ঠী তাদের পাশে এসে দাঁড়াননি। হয় বড় শিক্ষকগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিত্বকারী নেতারা তাদের অনুসারীদের বেতন কাটা হবে এমন ধারণা করতে পারেননি; কিংবা সরকারের ভয়ে কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেননি। অথবা এতদসংক্রান্ত ব্যাপারে তারা নীরব থাকা ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না। এ ক্ষেত্রে প্রথমটি হবে তাদের অজ্ঞতা আর দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি ভিরুতা বা কাপুরুষতা। উভয় ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দানে অযোগ্যতা প্রমাণিত হয়। তবে নেতার যোগ্য কী অযোগ্য, ওই বিতর্কে না গিয়ে এখানে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, এ অতিরিক্ত চার ভাগ না কেটে কী করা যায়।
বেতন থেকে চার ভাগ কাটার বিষয়ের সাথে জড়িত মূল বেতনের পাঁচ ভাগ ইনক্রিমেন্ট। সরকারি কর্মজীবীরা দুই বছর আগে এ পরিমাণ ইনক্রিমেন্ট পান। এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার থেকে ইনক্রিমেন্ট প্রাপ্তির সুসংবাদ পান। কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ায় পরের মাসে অর্থাৎ ইনক্রিমেন্ট প্রাপ্তির প্রথম মাসে সবার আগে এমপিওভুক্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ শিক্ষক শ্রেণী কারিগরি শিক্ষকদের বেতনের সাথে যুক্ত পাঁচ ভাগ ইনক্রিমেন্ট হতে অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট বাবদ চার ভাগ অতিরিক্ত টাকা কেটে রাখে সরকার। ফলে যারা জানুয়ারি ’১৯ থেকে ৫ ভাগ ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন; তাদের বেতন কমে গেছে। একজন প্রভাষক ২২,০০০/- বেতন স্কেলে পাঁচ ভাগ ইনক্রিমেন্ট পেয়ে অন্যান্য ভাতাসহ পান ২৩,২১৪/- টাকা। কিন্তু অতিরিক্ত চার ভাগ বেতন কর্তন করায় তিনি বর্তমানে বেতন পান ২২,২৯০/- টাকা; এতে করে বেতন কমে গেল। এটি একটি খারাপ নজির স্থাপন করল সরকার; যা শুভ হতে পারে না। বেসরকারি শিক্ষকদের পাঁচ ভাগ ইনক্রিমেন্ট দিয়ে চার ভাগ অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টে অতিরিক্ত কেটে দেশের ব্যাপক উন্নতি করতে পারবে না সরকার। বরং শিক্ষার উন্নতি করতে হলে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা দিয়ে তা করতে পারে।
সরকার এবং কোনো কোনো শিক্ষক নেতা অবসর সুবিধা এবং কল্যাণ ট্রাস্টে অতিরিক্ত চার ভাগ কাটার পক্ষে। কর্তনের পক্ষগোষ্ঠীর বক্তব্যÑ বর্তমানে যারা অবসরে যাচ্ছেন, তাদের পাওনা অর্থাৎ অবসর এবং কল্যাণ ট্রাস্টে জমা বাবদ তাদের যে পাওনা রয়েছে; তা পরিশোধে এ অতিরিক্ত টাকা বেতন থেকে কাটা হচ্ছে। অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের বেতন থেকে ছয় ভাগ হিসেবে কাটা হয়েছে। এছাড়া তাদের ব্যাপক সংখ্যক নতুন পে-স্কেল প্রাপ্তির এক বা দুই বছরের মধ্যে অবসরে যান। ফলে তাদের কাছে থেকে টাকার অংশ বেশি টাকা অল্প সময় কাটা হয়। কিন্তু নতুন পে-স্কেলের কারণে তিনি টাকা পাবেন বেশি। তাই এ বেশি পরিমাণ টাকা দিতে অর্থ সঙ্কট দেখা দেয়। অতিরিক্ত চার ভাগ টাকা কেটে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পাওনা পরিশোধ করতে চায় সরকার। সেজন্য সরকার চাকরিরত শিক্ষকদের বেতন থেকে চার ভাগ কাটে। কিন্তু বর্তমান চাকরিজীবীরা নিজেদের অর্থ থেকে চার ভাগ কেটে অন্যের টাকা পরিশোধের পক্ষে নন। এখানে সরকার যে ভুলটি করে, তা হলো জানুয়ারি এবং সর্বশেষ এপ্রিল ’১৯ থেকে চার ভাগ অতিরিক্ত কাটা। একজন প্রধান শিক্ষক সপ্তম কোডে বেতন পেতেন ২৮ হাজার ৭৬০ টাকা (৬ ভাগ কর্তন, বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা যোগ করে)। জানুয়ারিতে পাঁচ ভাগ ইনক্রিমেন্ট বেতনের সাথে যুক্ত হলে সপ্তম গ্রেডের একজন শিক্ষকের বেতন বেড়ে হয় ৩০ হাজার ১২৩ টাকা। কিন্তু এপ্রিলে অতিরিক্ত চার ভাগ বেতন কাটায় কমে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৯০৫। এতে করে বেতন কমে ১ হাজার ২১৮ টাকা। শুধু প্রধান শিক্ষক নন, কলেজ পর্যায়ে সিলেকশন গ্রেডের সহকারী অধ্যাপকেরাও একই বেতন পান। অথচ এ বেতন কোডধারী শিক্ষকেরা জুলাইয়ের বেতনের সাথে দশ ভাগ কাটার পরও পাবেন ৩১ হাজার ১৭৫ টাকা। সরকার যদি অতিরিক্ত চার ভাগ তখনই কাটত; তাহলে শিক্ষকদের মনে আঘাত লাগত না। কারণ, বেতন কমলেও তাদের প্রাপ্তির ১ হাজার ৫২ টাকা বেশি হতো (৩১ হাজার ১৭৫, ৩০ হাজার ১২৩)। এ ক্ষেত্রে সরকার হিসাবে ভুল করেছে। তাই সরকার অতিরিক্ত চার ভাগ কর্তনের টাকা ফেরত দিয়ে জুলাইয়ের বেতন থেকে কাটার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে পারে।
অবসর সুবিধা ও কল্যাণ তহবিল বাবদ আগে ৬ ভাগ বেতন কেটে সর্বশেষ মূল বেতনের ১০০ মাসের সমপরিমাণ অর্থ সুবিধা পেয়ে আসছিলেন শিক্ষকেরা। কিন্তু বর্তমানে অবসর সুবিধায় ও কল্যাণ ট্রাস্টে ১০ ভাগ কাটার পরও সরকার আগের মতো ১০০ মাসের সর্বশেষ মূল বেতনের সমান অর্থ শিক্ষকদের দিচ্ছে। কিন্তু গাণিতিক হিসাবে শিক্ষকসমাজ ১৬২.৫ মাসের সর্বশেষ মূল বেতনের সমান অর্থ দাবিদার। এ লেখায় সরকারের প্রতি আবেদন ১৬২.৫ মাসের সর্বশেষ মূল বেতন শিক্ষকদের দেয়া হোক নতুবা অতিরিক্ত ৪ ভাগ বেতন কাটা বন্ধ করতে হবে।
সমস্যা যেভাবে দূর করা সম্ভব : বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন থেকে যে টাকা অবসর এবং কল্যাণ তহবিলে কাটা হয়, প্রতি বছর তা কিন্তু ওই বছরই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পাওনা পরিশোধ করে শেষ করা হয় না। অবশিষ্ট অংশ কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে একটি নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ পায়। এ লভ্যাংশের স্বচ্ছ কোনো হিসাব নেই। এ নিয়ে শিক্ষকসমাজ নানা কথা বলে থাকেন। আমরা এ বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে কাটা টাকা উন্নয়ন খাতে লাগিয়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করা যায়। সেজন্য বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী উন্নয়ন কমিশন গঠন করে অবসর ও কল্যাণে কাটা অর্থ কোনো খাতে বিনিয়োগ করে তহবিল বাড়ানো যায়। বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যেভাবে বিনিয়োগ করে অর্থের পরিমাণ বাড়ানো হয় এ ধরনের বিনিয়োগকে বলা যায় লেজি ইনভেস্টমেন্ট। বিনিয়োগ যদি কর্মী বাহিনী নিয়োগ করে করা হয় তখন তাকে বলা হবে অ্যাকটিভ ইনভেস্টমেন্ট বা সচল বিনিয়োগ। মিল-কারখানা স্থাপন, পরিবহন ব্যবসা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা, পণ্য উৎপাদন ক্রয়-বিক্রয় প্রভৃতি করতে যে বিনিয়োগ করা হয় তা হলো অ্যাকটিভ ইনভেস্টমেন্ট। তাই লেজি ইনভেস্টমেন্ট বা মৃত বা অচল বিনিয়োগ পরিহার করে সচল বিনিয়োগে নন-গভার্নমেন্ট টিচারস অ্যান্ড এমপ্লয়িস ডেভেলপমেন্ট কমিশন গঠন করা যেতে পারে। কোনো অবসরপ্রাপ্ত জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষক নেতা অথবা সিনিয়র সচিব যার বয়স পঞ্চান্নোর্ধ্ব, এমন কাউকে এর প্রধান করে নয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। অন্য সদস্যরা বিসিএস (প্রশাসন) থেকে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার দুইজন, বিসিএস (রেলপথ) থেকে নিয়োগ পাওয়া যুগ্মসচিব একজন, সড়ক ও পরিবহন বিভাগে নিয়োগ পাওয়া যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন সদস্য, শিক্ষক নেতা উচ্চ শিক্ষাপর্যায়ের দুইজন, কারিগরি একজন, মাদরাসার একজন এবং এফবিসিসিআইর একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সদস্য যিনি ওই সংগঠনের কোনো উচ্চপর্যায়ের পদ ধারণ করেন। এসব সদস্যের বয়স ৫০ ঊর্ধ্ব হতে হবে; তবে শিক্ষক নেতাদের ক্ষেত্রে বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব ও জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষক নেতা হতে হবে এবং এমপিওভুক্তি থেকে চাকরির অভিজ্ঞতা হতে হবে ২০ বছর।
এই কমিশনের প্রধানের পদবির নাম দেয়া যেতে পারে চেয়ারম্যান। অন্যরা হবেন সদস্য। এ কমিশন প্রাথমিক পর্যায়ে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থে ঢাকা থেকে দেশের কয়েকটি বড় শহরে রেল সার্ভিস, সড়ক ও পরিবহন সার্ভিস চালু করে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থ বাড়াতে পারে। অথবা কোনো শিল্প-কারখানা চালু করে বেকারত্ব যেমন কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে পারে। এসব পদক্ষেপ হাতে নিলে অবসর ও কল্যাণ তহবিল বাড়িয়ে শিক্ষক কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো সম্ভব। অজ্ঞতা ও অনিয়ম বা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে অতিরিক্ত চার ভাগ বেতন কেটে সরকার লাভের মুখ দেখতে পারবে না। বরং শিক্ষকদের আর্থিক ক্ষতি করে সার্বিকভাবে রাষ্ট্রেরই ক্ষতি হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া বেতন কাটা বাতিল করা বাস্তবসম্মত বলে আমরা মনে করি। হ
লেখক : প্রেসিডিয়াম মেম্বার, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি
ই-মেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement