২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘শয়তানের নিঃশ্বাস‘ নামের যে ড্রাগ প্রতারণায় ব্যবহার হচ্ছে

ধুতরা ফুল থেকে উপাদান নিয়ে তৈরি হয় স্কোপোলামিন - ছবি : বিবিসি

ঢাকার তাহমিনা বেগম (ছদ্মনাম) কিছুদিন আগে ‘অদ্ভূত’ এক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। বাজার থেকে বাড়িতে ফেরার সময় হঠাৎ তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলেন অপরিচিত এক নারী। তার প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেই নারী জানতে চান কোনো একটি ঠিকানা।

এরপরই সামনে আসে আরেক যুবক। মাত্র দুই-তিন মিনিট কথার পরই কী যেন হয়ে যায় তাহমিনার।

তাহমিনা বলছিলেন, ‘ব্যাপারটা অদ্ভূত এবং ভয়ঙ্কর। লোকটা আমার কাছে জানতে চায় এলাকায় পরিচিত কোনো গরিব কিংবা এতিম কেউ আছে কি না। সে তাকে সাহায্য করবে। এ রকম একটা গরিব পরিবার ছিল আমার বাড়ির কাছে। তাই আমি বিস্তারিত জানতে চাই। ওদের সাথে কথা বলি কয়েক মিনিট। এরপরই কী যেন হয়ে গেল, আমার আর বুদ্ধি কাজ করছিল না।’

একপর্যায়ে তাহমিনা বেগম অপরিচিত ওই নারী ও যুবকের কথা মতো তার কানের দুল, গলার চেইন এবং সাথে থাকা কয়েকহাজার নগদ টাকা তুলে দেন।

তাহমিনা বলেন, ‘ওরা বলল আন্টি আপনার গয়না আর টাকাগুলো ব্যাগে রাখেন। নইলে হারিয়ে যেতে পারে। আমি ঠিক সেটাই করলাম। আমার মাথায় এলো না যে কেন আমি এগুলো খুলব, কেন হারিয়ে যাবে বা কেন ব্যাগে রাখব? তারপর ছেলেটা বলল আমার সাথে আসেন। আমি তখন ব্যাগটা মেয়েটার কাছে দিয়ে ছেলেটার পেছনে হাঁটতে শুরু করি।’

কিছুদূর হাঁটার পরই তাহমিনা বেগমের সম্বিত ফিরে আসে। কিন্তু তখন ছেলেটাকে আর দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি। ফেরত এসে মেয়েটাকেও আর পাননি। সেদিনের সেই ঘটনায় তার সোয়া ভরি স্বর্ণের চেইন, কানের দুল, নগদ টাকা এবং মোবাইল খুইয়ে আসেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমি এখনো বুঝতে পারি না কীভাবে কী হয়ে গেলো। ওরা আমাকে কিছুই করেনি। শুধু কাছাকাছি ছিল এবং মেয়েটা মুখের সামনে হাত নেড়ে একটা ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিল।’

তাহমিনা বেগম যে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকেই এমন ঘটনার শিকার হচ্ছেন। এর পেছনে কারণ হিসেবে উঠে আসছে স্কোপোলামিন নামে একটি ড্রাগের কথা।

বলা হচ্ছে, এটা তরল কিংবা পাউডার দুই ধরনেই পাওয়া যায়। অপরাধের ক্ষেত্রে এই ড্রাগ কাগজ, কাপড়, হাত এমনকি মোবাইলের স্ক্রিনে লাগিয়েও এর ঘ্রাণ দিয়ে কিছু সময়ের জন্য যে কারো মানসিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া সম্ভব।

কিন্তু বাস্তবে মূলতই কি এমন কোনো ড্রাগ আছে? আর থাকলেও এটা বাংলাদেশে ব্যবহার হচ্ছে কি না সেটাই বা কতটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে?

বাংলাদেশে স্কোপোলামিন ব্যবহারের প্রমাণ কী?
বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি বেসরকারি বিশ্ববদ্যিালয়ের শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ওই হত্যার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করেছিল। পরে আরো একজনকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে।

এদের মধ্যে একজনের কাছে প্রথমবারের মতো স্কোপোলামিন পাওয়ার কথা জানায় পুলিশ।

বোতলের ভেতর সাদা পাউডার আকারে কয়েক গ্রাম স্কোপোলামিনসহ আরো কয়েক ধরনের মাদক জব্দ করা হয়।

পরে আদালতের আদেশ নিয়ে সিআইডি’র ল্যাবে টেস্ট করার পর সেখানে স্কোপোলামিন শনাক্ত হয়।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, শুরুতে এই স্কোপোলামিন সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না তাদের।

তিনি বলেন, ‘রাসায়নিক পরীক্ষার যে রিপোর্টটা আমরা পেয়েছি সেই রিপোর্টে কিন্তু স্কোপোলামিন, পটাশিয়াম সায়ানাইড ও ক্লোরোফর্ম শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে স্কোপোলামিন ছিল আমাদের কাছে একেবারেই নতুন। এই নাম, এর ব্যবহার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা কাজে লাগানো হতে পারে সেটা আমরা জানতাম না। পরে এটা নিয়ে স্টাডি করে আমরা জানতে পারি যে এটাকে আসলে ‘ডেভিলস ব্রেথ’ বা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ বলে অনেকে।’

মোস্তফা জানান, তারা এখনো পর্যন্ত তদন্তে যেটা পেয়েছেন সেটা হচ্ছে এই ড্রাগ কুরিয়ারের মাধ্যমে এবং বিভিন্নভাবে চোরাকারবারিরা দেশে আনছে।

ধুতরার ফুল থেকে স্কোপোলামিন বানায় কারা?
স্কোপোলামিন মূলত একটি সিনথেটিক ড্রাগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার আছে। বমি বমি ভাব, মোশন সিকনেস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন পরবর্তী রোগীর জন্য ওষুধের ব্যবহার আছে।

তবে এটা প্রাকৃতিক কোনো উপাদান নয়। বরং প্রাকৃতিক উপাদানের সাথে আরো কিছু যোগ করে কৃত্রিমভাবে স্কোপোলামিন তৈরি করা হয়। এটা তরল এবং পাউডার দুই রূপেই পাওয়া যায়।

তবে এর গুরুত্বপূর্ণ বা মূল উপাদান আসে ধুতরা ফল থেকে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘আমাদের দেশে একসময় মানুষকে পাগল করে দেয়ার জন্য দুধের মধ্যে ধুতরা বেটে খাইয়ে দেয়া হতো। ধুতরা ফুল কিন্তু একটা বিষ। ওই ধুতরা থেকে উপাদান নিয়ে সিনথেটিক্যালি এটা বানানো হয়েছে। মেক্সিকোর যে মাদক চক্র আছে, তারা এই মাদকটা বানিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে।’

স্কোপোলামিন কখন, কীভাবে কাজ করে?
স্কোপোলামিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে ব্যবহারের নজির আছে। তখন এর ব্যবহার হতো লিকুইড হিসেবে, ইনজেকশনের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সায়েদুর রহমান বলেন, ওষুধ হিসেবে স্কোপোলামিনের ব্যবহার এখনো আছে।

তিনি বলেন, ‘এটা এবং এর মতো আরো বেশ কিছু ওষুধ চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়। এটা সত্য। স্কোপোলামিন প্রথম দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা জ্ঞিাসাবাদের ক্ষেত্রে ‘ট্রুথ সেরাম’ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অর্থাৎ এটা যদি ইনজেক্ট করে দেয়া হয় তাহলে সে সত্য কথা বলতে শুরু করে। কারণ তার মগজের ওপর নিজস্ব যে নিয়ন্ত্রণ সেটা চলে যায়। সে তখন অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, অন্যের কথা শুনতে থাকে।’

রহমান বলেন, ‘যখন আপনি কথা বলানোর জন্য ব্যবহার করছেন তখন এটা ট্রুথ সেরাম। যখন আপনি পাউডার ফর্মে নিঃশ্বাসের জন্য ব্যবহার করছেন তখন এটা ‘ডেভিলস ব্রেথ’। আর যখন এটা বমি অথবা মোশন সিকনেসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন তখন এটা আসলে মেডিসিন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।’

স্কোপোলামিন মূলত পাউডার হিসেবে প্রতারণার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ভিজিটিং কার্ড, কাগজ, কাপড় কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনে এটি লাগিয়ে কৌশলে টার্গেট করা ব্যক্তিদের নিঃশ্বাসের কাছাকাছি আনা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলছিলেন, ‘স্কোপোলামিন মানুষের নাকের চার থেকে ছয় ইঞ্চি কাছাকাছি এলেই নিঃশ্বাসের আওতায় আসে। এটা নিঃশ্বাসের সাথে ঢুকলেই মাত্র ১০ মিনিট বা তারও আগে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। মেমোরি আর ব্রেন তখন সচেতনভাবে কাজ করতে পারে না। কারো ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতে এক ঘণ্টা লাগে। আবার কেউ তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেও স্বাভাবিক হতে পারে না।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করছে?
বাংলাদেশে শুরুতে ঢাকায় পাওয়া গেলেও পরে স্কোপোলামিন ব্যবহার করে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও।

যদিও এমন ঘটনার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে মাদক কারবারিরা স্কোপোলামিন আনছে সেটিও একটা বড় প্রশ্ন।

নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর গোয়েন্দারা তথ্য পান স্কোপোলামিন অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। মূলত যে দু’জন আটক হয় তারা অনলাইনে বিক্রির সাথেই জড়িত বলে জানাচ্ছে পুলিশ। আর এগুলো আসছে মূলত দেশের বাইরে থেকে।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিস। তবে ওষুধের কাঁচামাল হিসেবেও আইনের ফাঁক গলিয়ে কেউ স্কোপোলামিন আনছে কি না সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, যারা এমন অপরাধের সাথে যুক্ত তাদের গ্রেফতারে কাজ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছি। নারায়ণগঞ্জেও এর আগে গ্রেফতার হয়েছে। তাদের কাছে যে তথ্য পেয়েছি, সেগুলো আমরা বিশ্লেষণ করছি। তাদের সাথে আরো কারা জড়িত সেগুলো বের করা এবং আইনের আওতায় আনার জন্য চেষ্টা চলছে।’

তবে এর মধ্যেও স্কোপোলামিন ব্যবহার করে প্রতারণার অভিযোগ আসছে, যেখানে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকেই। ভয়ের জায়গা এটাই।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকদের দাবির যৌক্তিকতা রয়েছে : ধর্ম উপদেষ্টা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের ইস্যু তুলেও ঝাড়খণ্ডে জিততে পারেনি বিজেপি ‘নতুন বাংলাদেশে কোনো চাঁদাবাজি চলবে না’ বাঘায় কৃষকের গলাকাটা লাশ উদ্ধার মানুষ যাতে বৈষম্যের শিকার না হয় সেই প্র্যাকটিস আমরা গড়ে তুলতে চাই : তারেক দিনের শুরুতে স্বস্তি এনে দিলেন হাসান মাহমুদ কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয় : আইজিপি সাটুরিয়ায় তেলের পাম্পে আগুন দেশের মানুষ শুধু নির্বাচনের জন্য জীবন দেয়নি : মুফতি ফয়জুল করিম দুই দিনের ব্যবধানে আবারো বাড়ল স্বর্ণের দাম শহীদ আব্দুল্লাহর পরিবারের পাশে থাকার অঙ্গীকার জামায়াত আমিরের

সকল