২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

যেভাবে জলদস্যুদের কবলে পড়ল বাংলাদেশী জাহাজটি

জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ - ফাইল ছবি

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুর কবলে পড়েছে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। জাহাজটি কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাচ্ছিল।

জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার তথ্য বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন জাহাজের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিম।

এ সময় জাহাজটিতে ২৩ জন ক্রু ছিলেন। জলদস্যুরা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর বর্তমানে জাহাজটির অবস্থান রয়েছে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের কাছাকাছি।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী মঙ্গলবার বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'এই খবর জানার পর থেকেই জাহাজের নাবিক ও ক্রুদের সাথে যোগাযোগ করেছি। এখন পর্যন্ত তাদের সবাই সুস্থ ও নিরাপদে আছেন। পরবর্তীতে উদ্ধারে কী করা যায় এজন্য আমরা আমাদের কূটনৈতিক চ্যানেল ও নৌবাহিনীর মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি।'

জাহাজটির মালিক বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপ। দুপুরেই জাহাজটি পণবন্দী করার খবর পায় মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান।

কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'আটককৃত জাহাজের ক্রুরা আমাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারছেন না।'

'ওনারা মোবাইলে হোয়াটঅ্যাপের মাধ্যমে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করছে। তবে জলদস্যুদের পক্ষ থেকে আমাদের সাথে এখনো পর্যন্ত সরাসরি কোনো যোগাযোগ করা হয় নাই।'

জাহাজে থাকা চিফ অফিসার মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ খানের ছোট ভাই আসিফ খানের সাথে মঙ্গলবার রাতে কথা হয় বিবিসি বাংলার।

তিনি জানান, 'দুপুরে জাহাজে জলদস্যুরা ওঠার পরও বেশ কয়েকবার আমাদের পরিবারের সাথে কথা হয়েছে। তখন পর্যন্ত জলদস্যুরা কোনো ধরনের ক্ষতি করেনি। কিন্তু বিকেলের দিকে ওরা মোবাইলগুলো নিয়ে যায়। এরপর তার সাথে আর আমাদের পরিবারের যোগাযোগ হয়নি'

যেভাবে জলদস্যুদের কবলে পড়ল জাহাজটি
কয়লাবাহী এম ভি আবদুল্লাহ আফ্রিকার মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছিল। ভারত মহাসাগর দিয়ে যাওয়ার সময় দুপুরের দিকে হঠাৎই ছোট ছোট বোট নিয়ে জাহাজের দিকে চলে আসে সোমালিয়ান জলদস্যুরা।

ওই জাহাজে থাকা একজন ক্রু ঘটনার সময় একটি ভিডিও ধারণ করেন। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার অ্যাসোসিয়েশন ওই ভিডিও দিয়েছে বিবিসি বাংলার কাছে।

ভিডিওতে দেখা যায় ছোট ছোট নৌকায় করে জাহাজটিতে ওঠার চেষ্টা করে জলদস্যুরা।

জলদস্যুরা জাহাজটিতে ওঠার সময় তাদের হাতে বন্দুক ছিল বলেও দেখা যায় ভিডিওটিতে। জাহাজে ওঠার পরই সবাইকে বন্দী করে জলদস্যুরা।

জাহাজের মালিকপক্ষ জানিয়েছে, জাহাজটিতে ক্যাপ্টেন ছিলেন আবদুর রশিদ।

জলদস্যুরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরই মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজের মাধ্যমে মালিক প্রতিষ্ঠানকে একটি বার্তা পাঠায় জাহাজের একজন নাবিক। যাতে বলা হয়, 'জলদস্যুরা জাহাজ দখল করে নিয়েছে। আমাদের নাবিকেরা আটকা পড়েছেন। আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।'

নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'এখন পর্যন্ত কী কারণে, কেন তারা এই জাহাজটিকে জিম্মি করলো বা তাদের দখলে নিল, তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য জানতে পারি নাই।'

'তবে মেরিটাইম সেক্টরে আমাদের যতগুলো চ্যানেল আছে সবগুলো চ্যানেল দিয়ে আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি', জানান তিনি।

জাহাজটিতে যারা আছেন
জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজটিতে যারা ছিলেন তাদের একটি তালিকা রয়েছে বিবিসির কাছে।

এতে ছিলেন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ, চিফ অফিসার মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ খান, দ্বিতীয় কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী, তৃতীয় কর্মকর্তা মো. তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসেন, প্রধান প্রকৌশলী এএসএম সাইদুজ্জামান, দ্বিতীয় প্রকৌশলী মো. তৌফিকুল ইসলাম, তৃতীয় প্রকৌশলী মো. রোকন উদ্দিন, চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ, এবি মো. আনোয়ারুল হক, এবি মো. আসিফুর রহমান, এবি সাজ্জাদ হোসেন, ওএস জয় মাহমুদ, ওএস মো. নাজমুল হক, ওএস আইনুল হক, অয়েলার মোহাম্মদ শামসউদ্দিন, মো. আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশারফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম, জিএস মো. নূর উদ্দিন ও ফিটার মো. সালেহ আহমেদ।

‘গোল্ডেন হক’ নামের জাহাজটি কেএসআরএম গ্রুপের বহরে যুক্ত হওয়ার পরে এর নাম দেয়া হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’। গত বছর এটি সংগ্রহ করে সাধারণ পণ্য পরিবহন করতে থাকে কেএসআরএম গ্রুপ।

কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'এখন পর্যন্ত তাদের মোবাইলগুলো এখনো তারা সিজ করেনি। ক্রু-দের কাছ থেকে তাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারছি। এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক আছে। তবে মাঝে মধ্যে তারা একটু ডিস্টার্বও করছে।'

নৌ পরিবহনমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'এখন আমাদের প্রাথমিক কাজ নাগরিকদের নিরাপদ রাখা। পরবর্তী পদক্ষেগুলো আমরা পরবর্তীতে নিব সবার সাথে যোগাযোগ করার পর। এখন পর্যন্ত মুক্তিপণের বিষয়টি আমাদেরকে কেউ বলেনি। তবে এসব ক্ষেত্রে এগুলোই হয়।'

যেভাবে জাহাজগুলো জলদস্যুর কবলে পড়ে
গভীর সমুদ্রে পণ্যবাহী জাহাজগুলো কিভাবে জলদস্যুদের কবলে পড়ে তা নিয়ে বিবিসি কথা বলেছে বিশেষজ্ঞ ও জাহাজের দুজন সাবেক ক্যাপ্টেনের সাথে।

তারা বলছেন, পণ্য বোঝাই থাকায় জাহাজগুলো সাধারণত ধীরে চলে আর্ন্তজাতিক নৌ রুটে। এমভি আব্দুল্লাহর মতো আকারের জাহাজগুলোতে ৩০ থেকে ৪০ টন পণ্য বোঝাই থাকে। বেশি পণ্য বোঝাই থাকায় বেশির ভাগ জাহাজের গতি থাকে ১৮ থেকে ২০ নটিক্যাল মাইল।

এ কারণেই গতি থাকে কম। জলদস্যুরা যখন কোন জাহাজকে টার্গেট করে তখন তারা ছোট ছোট বোটে অস্ত্র নিয়ে তিন থেকে চারদিক থেকে আক্রমণ করে। তিন চারদিক থেকে যখন আক্রমণ করে তখন সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যায়।

সোমালিয়ান জলদস্যুর হাতে মঙ্গলবার আটক হওয়া জাহাজটির বেলায়ও তাই দেখা গেছে।

জাহাজের সাবেক ক্যাপ্টেন ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'জলদস্যুরা যখন জাহাজ দখলে নিতে আসে তখন তাদের কাছে হুক থাকে, অস্ত্র থাকে, টেলিস্কোপ ও ল্যাডার থাকে। তিন চারদিক থেকে ৩০-৪০ জন অস্ত্রসহ এসে জাহাজে উঠে পড়ে।'

চৌধুরী বলেন, 'ওঠার পরই তাদের কেউ জাহাজের ইঞ্জিন রুমে, কেউ লোকদের জিম্মি করে। কেউ জাহাজ স্লো ডাউন করে। কখনো প্রয়োজনে জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধও করে দেয়।'

সাধারণত জলদস্যুরা জাহাজটিতে ওঠার পরই কমিউনিকেশনের সব পথগুলো তারা বন্ধ করে দেয়। এরপর ডাকাতি শুরু করে।

যাদের কাছে টাকা পয়সা আছে, অন্য দামি জিনিসপত্র যা আছে সেগুলো নিয়ে নেয়। মোবাইল নিয়ে নেয়। টোটাল কমিউনিকেশন অফ করে দেয় বহির্বিশ্বের সাথে।

'তারপর জাহাজে থাকা ক্রুদের সাহায্যে এই জলদস্যুরা তাদের নিয়ন্ত্রিত এরিয়ার কাছাকাছি যে কোন একটি পোর্টে নিয়ে যায়। সেখানে নোঙ্গর করে দুয়েক দিন পর গিয়ে তারা মুক্তিপণ দাবি করে। এই মুক্তিপণ দাবি করা হয় মালিক কোম্পানির কাছে', জানান ক্যাপ্টেম আনাম চৌধুরী।

তারা কিভাবে যোগাযোগ করে মালিকানা প্রতিষ্ঠানের কাছে?

এর জবাবে ক্যাপ্টেম আনাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'প্রত্যেকটা জাহাজেই মালিকানা প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য থাকে। কার সাথে যোগাযোগ করবে, তার নাম নম্বর, সিকিউরিটি অফিসার যে থাকে তার নাম ও নম্বর লেখা থাকে জাহাজে। প্রত্যেকটি জাহাজে স্যাটেলাইট ফোন আছে। সেটা দিয়ে তারা মালিককে ফোন দিবে।'

কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'নরমালি এ সমস্ত ক্ষেত্রে যেটা হবে আল্টিমেটলি জলদস্যুরা জাহাজের ফুল কন্ট্রোল নেয়ার পর তারা তাদের সুবিধামতো সময় আমাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করবে। তারপর আমরা জানতে পারবো আসলে তাদের চাহিদা কী!'

সেটা হতে এখনো দেড় থেকে দুই দিন সময় লাগতে পারে বলে জানান করিম।

একই কোম্পানির জাহাজ জাহান মনিতে যা ঘটেছিল
এখন থেকে প্রায় ১৪ বছর আগে ২০১০ সালে ৫ ডিসেম্বর এই কেএসআরএম এর মালিকানাধীন এসআর শিপিং গ্রুপের আরেকটি জাহাজও জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল।

জাহান মনি নামের জাহাজ দস্যুরা আটক করেছিল। পরে সেটি উদ্ধার করা হয়। তখন ঐ জাহাজটিও পড়েছিল সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে।

নিকেলভর্তি ওই জাহাজের ২৫ জন নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে আটক করা হয়েছিল।

দীর্ঘ চেষ্টার পর ১০০ দিনের মাথায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা। পরে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

তখনও ঐ জাহাজটি ছাড়িয়ে আনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম।

মেহেরুল করিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'এর আগে যখন তারা আমাদের আমাদের ঐ জাহাজটাকে দখলে নিয়েছিল সেটা ছিল সোমালিয়া থেকে অনেক দূরে।'

'সে অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এতটুকু বলতে পারি এরকম ক্ষেত্রে কী হয় তা নিয়ে আমাদের মোটামুটি এদিক থেকে অভিজ্ঞতা আছে। তবে এসব ক্ষেত্রে ক্রু-দের কিছুই করার থাকে না।'

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, '২০১০ সালে জাহান মনি সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল ইন্ডিয়া থেকে মাত্র দুই থেকে তিন শ' মাইল দুরে। কিন্তু ওটা সোমালিয়া থেকে দেড় দুই হাজার মাইল দুরে'।

কেএসআরএম এর জাহান মনি মুক্ত করতে সময় লেগেছিলো ৯৯ দিন।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা উইংকে জানিয়েছি। নৌবাহিনীর মাধ্যমে ভারতের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছি আমরা। প্রাথমিকভাবে ক্রু-দের জীবন যেন নিরাপদ থাকে সেই চেষ্টাটাই আমরা করছি।'

নৌ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, পরিবেশ দূষণ-সহ নানা কারণে সোমালিয়ার মাছ ধরা পেশার সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের অনেকে বেকার হয়ে গেছে। এছাড়াও নানা কারণে এই দেশের অনেকেই দস্যুতার সাথে জড়িয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, নৌ সার্ভেলেন্স বাড়ানোর কারণে এই পথে জলদস্যুতা অনেক কমে এসেছিল।

'কিন্তু গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ ও হুথির আক্রমণের কারণে লোহিত সাগর এখন হটস্পট। ফলে সবার মনোযোগ, নেভাল সার্ভেলেন্স ওদিকে বেড়ে গেছে। এই সুযোগটা সোমালিয়ান জলদস্যুরা কাজে লাগাচ্ছে', জানাচ্ছেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement