কোনো ভবন নিরাপদ কি না বোঝা যাবে যে ১০টি বিষয় দেখে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০২ মার্চ ২০২৪, ১৭:১৯
বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বেইলি রোডের গ্রিন কজি কটেজ নামক সাত তলা একটি ভবনে আগুন লেগে প্রায় অর্ধশত মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছে বহু মানুষ।
গতবছরও ঢাকায় একাধিক বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। উদারহরণস্বরূপ, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঈদের আগে আগে রাজধানীর বঙ্গবাজারের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, যাতে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং অনেক ব্যবসায়ী সর্বশান্ত হয়ে যায়।
এই ঘটনার কিছুদিন আগে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজার এবং বছর শেষে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে সারা দেশে মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে দেশে ৭৭টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে কয়েকশত মানুষ আহত ও নিহত হয়েছেন।
কোনো আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবনে আগুন লাগার পর ঘুরে ফিরে প্রায়ই একটা বিষয় আলোচনায় আসে যে আগুন নেভানোর জন্য সেখানে কোনো পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না।
বেইলি রোডের গ্রিন কজি কটেজে আগুন লাগার পরও এই প্রশ্ন সামনে এসেছে। ফায়ার সার্ভিস থেকে বলা হয়েছে, ভবনটিতে আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থাই ছিল না।
আগুন নেভানোর জন্য ‘পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ সমূহ কী কী বা, নিজের প্রিয়জনদের নিয়ে কোনো ভবনে প্রবেশের আগে একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে বুঝবেন যে ভবনটি তাদের জন্য নিরাপদ কি-না; এই বিষয়গুলো সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।
কারণ, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ এবং আগুন নেভানোর জন্য সেসব ভবনে কোনোপ্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।
তাই, খাওয়া-দাওয়া বা ঘোরাঘুরি, যেকোনো প্রয়োজনেই কোনো ভবনে প্রবেশ করার আগে ওই ভবনটি কতটা নিরাপদ, তা যতটা সম্ভব যাচাই করে নেয়ার পরামর্শ দেন তারা।
প্রকাশ্যে ‘সার্টিফিকেট’ প্রদর্শন
একটা ভবন কতটা নিরাপদ বা ভবনের ত্রুটিগুলো কোথায়, একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে খালি চোখে সেটা যাচাই-বাছাই করা প্রায় অসম্ভব। কারণ এটি বিশেষজ্ঞদের কাজ।
কিন্তু কিছু বিষয় আছে, যা দেখে যেকোনো সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবেন যে ভবনটি তার জন্য কতটুকু নিরাপদ। সেসবের মাঝে সবচেয়ে সহজ হলো, ভবনের সামনে নিরাপত্তা সনদ বা সার্টিফিকেট প্রদর্শন করা আছে কি-না, তা দেখে ওই ভবনে প্রবেশ করা।
এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘একটা ভবন নিরাপদ কিনা, সেটা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না; রাষ্ট্র এখানে সবচেয়ে বড় অপরাধ করছে।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু রাষ্ট্র এখনো শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছে না যে তার রাষ্ট্রের সকল ভবন নিরাপদ; সেহেতু একটি ভবন যে নিরাপদ, সেটার অনুমোদন প্রকাশ্যে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা জরুরি। এটিকে একটি উন্মুক্ত স্থানে সাধারণের জন্য প্রদর্শন করতে হবে।’
অর্থাৎ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের আইন ও বিধিমালা মেনে যে ওই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে এবং নির্মাণের পর সেখানকার সমস্ত কাজও যে আইন মেনেই হচ্ছে, সেই মর্মে একটা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভবন মালিককে একটি সার্টিফিকেট তথা সনদ দেবে।
সনদ প্রাপ্তির পর ভবন মালিক সেটিকে ফলক বা নোটিশ আকারে ভবনের সামনে টাঙ্গিয়ে রাখবে।
যদিও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। এর কারণ হিসেবে এই স্থপতি বলেন, ‘এই সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য একক কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নাই।’
বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডকে ‘অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে সঙ্গায়িত করে তিনি আরো বলনে, ‘আমাদের এখানে একটা ভবন করা হলে ধরেই নেয়া হয় যে সব সংস্থার অনুমোদন নিয়ে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ঘটনা ঘটার পর কর্তৃপক্ষ হাত গুটিয়ে বলছে যে আমার অনুমোদন নেয় নাই। কেউ বলছে, নিয়েছিলো কিন্তু ব্যত্যয় করেছে।’
‘সার্টিফিকেশন’-এর নিয়ম বিশ্বের সব দেশে আছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই একটা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন সার্টিফিকেশন দেয় এবং সেটা প্রকাশ্যে লাগিয়ে রাখতে হয় যে এই ভবনটি সমস্ত আইন কানুন মেনে পরিচালনা করা হয়েছে।’
তবে শুধু সার্টিফিকেট প্রাপ্তি-ই শেষ কথা না, প্রতিবছর সেটির নবায়ন করার কথাও তিনি বলেন।
সেই সার্টিফিকেট বা সনদে এটাও লেখা থাকবে যে ‘এটার সর্বশেষ অনুমোদন কত তারিখ হয়েছে এবং পরবর্তী অনুমোদন কত তারিখের মাঝে নিতে হবে’।
প্রবেশদ্বার তিন মিটারের কম না হওয়া
হাবিব জানান, কোনো জনাকীর্ণ ভবনের প্রবেশদ্বার যদি তিন মিটারের কম হয়, তাহলে সেখানে প্রবেশ করার আগে ভাবা উচিৎ।
জনাকীর্ণ স্থানসমূহের মাঝে আছে রেস্টুরেন্ট, মসজিদ, গীর্জা, হাসপাতাল, এমনকি স্কুলও। এই ধরনের স্থানে একসাথে একসাথে অনেক মানুষ প্রবেশ করে এবং বের হয়।
তিনি আরো জানান, ‘বাণিজ্যিক ভবনে বিভিন্ন অফিস থাকায় সেসব স্থানও সবসময় লোকে লোকারণ্য থাকে। তাই, এগুলোর ‘প্রবেশদ্বার অবশ্যই তিন মিটারের চেয়ে কম হতে পারবে না’।
পর্যাপ্ত সিঁড়ি ও অ্যালার্ম সিস্টেম
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক মেজর একেএম শাকিল নওয়াজ বলেন, ‘মনে রাখবেন, আগুন লাগার পর একটা মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য ভবনে মূলত দুইটা জিনিস থাকা দরকার। পর্যাপ্ত সিঁড়ি এবং অ্যালার্ম সিস্টেম। আর কিছুর দরকার নাই।’
তিনি জানান, কোনো আবাসিক ভবন যদি ছয় তলার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আইন অনুযায়ী সেখানে চলাচলের জন্য দু’টি সিঁড়ি থাকতে হবে।
তবে যেগুলো বাণিজ্যিক ভবন বা কারখানা, সেখানে সিঁড়ি সংখ্যা আরো বেশি হবে।
তিনি বলেন,‘কমার্শিয়াল বিল্ডিং বা ফ্যাক্টরি যদি এক তলাও হয়, কিন্তু লোকসংখ্যা যদি দুই-৩০০ থাকে, তাহলে সেখানে ২৩ মিটার পরপর সিঁড়ি দিতে হবে।’
এছাড়া, আগুন লাগার পর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার উপায় হলো ভবনে ফায়ার এবং স্মোক অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো। কারণ অ্যালার্ম সিস্টেম যদি কার্যকর থাকে, তাহলে কোথাও আগুন লাগার সাথে সাথে (ধোঁয়া হলেই) এটি তা চিহ্নিত করতে পারে এবং বিকট শব্দ করে।
তখন পুরো ভবনের প্রত্যেক তলার বাসিন্দাররাই আগুন সম্পর্কে জানতে পারে এবং দ্রুত ভবন খালি করে নিচে নেমে আসতে পারে। এতে মৃত্যু অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়।
সাধারণ মানুষের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘কোনো শপিংমল, হসপিটাল বা রেস্টুরেন্টে পর্যাপ্ত সিঁড়ি এবং ফায়ার অ্যালার্ম না থাকলে সেখানে যাবেন না।’
জরুরী বহির্গমন পথ
একটি আদর্শ ভবনে দুই ধরনের সিঁড়ি থাকে। একটি দিয়ে সবসময় চলাচল করা হয়।
অন্যটি দিয়ে জরুরি অবস্থায় আত্মরক্ষার জন্য বের হওয়া যায়। সেজন্য একে বলা হয় জরুরি বহির্গমন পথ। আগুন লাগলে একে অগ্নি নির্গমন পথও বলা হয়।
জরুরি বহির্গমনের সিঁড়ির নির্মাণশৈলী সাধারণ সিঁড়ির চাইতে আলাদা হয় এবং এর অবস্থানও সাধারণ সিঁড়ির সাথে না হয়ে ভিন্ন জায়গায় হয় সাধারণত।
এই বিশেষায়িত সিঁড়ি বা জরুরি বহির্গমন পথ এমন স্থানে করা হয়, যেন ভবনে আগুন লাগলে সেখানে কোনো আগুন এবং ধোঁয়া প্রবেশ করতে না পারে।
এছাড়া ভবনের যে অংশে এই সিঁড়ি থাকে, সেই অংশের দেয়ালের গঠনও অনেকটা ভিন্ন হয়।
স্থপতি ইকবাল হাবিব অগ্নি নির্গমন পথের বিষয়ে বলেন, ‘আবাসিক ভবন ছাড়া অন্য কিছু হলে সেই ভবনের প্রত্যেক তলায় অগ্নি নির্গমন পথ থাকতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভবনটি কাঁচঘেরা আবদ্ধ জায়গায় হলেও তার কোনো না কোনো ধরনের উন্মুক্ত ব্যবস্থাপনা (জরুরি বহির্গমন পথ) থাকতে হবে। ভবনে এই ব্যবস্থাপনা না থাকলে আমার সন্তানকে নিয়ে আমি সেখানে ঢুকব না, যাব না, অফিস করব না, খাব না।’
অগ্নি চলাকালে ‘এক্সিট সাইন’ জ্বলা
ধরা যাক, কোনো ভবনে আগুন লেগেছে এবং সেই ভবনে পর্যাপ্ত সিঁড়ি এবং আলাদা অগ্নি নির্গমন পথও রয়েছে।
কিন্তু সব থাকার পরও আগুনের মাঝে পড়লে সাধারণত মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। তাড়াহুড়োর কারণে ঘটনাস্থল থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পায় না।
সেজন্য ভবনে আগুন লাগলে (বিদ্যুৎ থাকুক বা না থাকুক) জরুরি বহির্গমনের দিকে যাওয়ার পথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলো জ্বলে ওঠার ব্যবস্থা থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেন হাবিব।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘অগ্নি চলাকালীন সময়ে জ্বলে উঠে, এমন এক্সিট সাইন এবং ডিরেকশন থাকতে হবে। সিনেমা হলে যেরকম এক্সিট এবং এন্ট্রি চিহ্ন থাকে, ঠিক সেরকম।’
স্থপতি হাবিব বলেন, কোনো ভবনে আগুন লাগলে (বিদ্যুৎ থাকুক বা না থাকুক) জরুরি বহির্গমনের দিকে যাওয়ার পথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলো জ্বলে ওঠার ব্যবস্থা থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেন ।
ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র
আগুন নেভানো বা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেটিকে ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বলা হয়।
অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলোতে উচ্চচাপে রক্ষিত তরল কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকে। আগুন লাগলে এই যন্ত্র থেকে স্প্রে আকারে কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করে আগুন নেভানো হয়।
একটি নিরাপদ ভবনে অন্য অনুষঙ্গের সাথে বাধ্যতামূলকভাবে অগ্নি নির্বাপন সিলিণ্ডার বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
কারণ কোনো একটি ভবনে আগুন লাগার পর সেটি ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা হলেও সময় লাগে। আগুন লাগার পর প্রথম দুই মিনিটকে বলা হয় প্লাটিনাম আওয়ার বা সবচেয়ে মূল্যবান সময়।
নওয়াজ জানান, ‘এই সময়ে মাথা ঠান্ডা রেখে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করলে অনেকক্ষেত্রেই আগুন নিভিয়ে ফেলা যায় এবং আগুনকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়’।
তাই, কোনো ভবনে প্রবেশের আগে সেই ভবনে ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আছে কিনা এবং থাকলে সেটি আদৌ কাজ করছে না, সেটি দেখে নিতে বলেন তিনি।
মিশ্র ব্যবহারের ভবনে না যাওয়া
একই ভবনকে একাধিক কাজে ব্যবহার করাকে ‘ভবনের মিশ্র ব্যবহার’ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
যেমন, একটি ভবনে যদি মানুষের বাসাবাড়ি, অফিস, এমনকি রেস্টুরেন্ট থাকে; তাহলে সেটিকে বহু কাজে ব্যবহৃত ভবন হিসেবে ধরা হয়।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলছেন,‘রাজউক ‘মিশ্র ব্যবহার’ নাম দিয়ে মানুষের সাথে এই অন্যায়টা করছে…এর জন্য রাজউক এককভাবে দায়ী।’
রাজউক মিশ্র ব্যবহারের ব্যাখ্যা যথাযথভাবে করছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মিশ্র ব্যবহার মানে হলো, অফিস এবং আবাসিক একসাথে থাকতে পারবে। কিন্তু রেস্টুরেন্ট থাকতে পারবে না। কারণ রেস্টুরেন্ট একটা বিশেষায়িত ব্যবহার। রেস্টুরেন্টের কিচেনকে (রান্নাঘর) বাণিজ্যিক কিচেন বলা হয়। এটির ডিজাইন করা অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল কাজ। এই যে এত এত রেস্টুরেন্ট বানানো হচ্ছে, সেগুলোর কিচেন নিয়মকানুন মেনে করা হচ্ছে না। কিন্তু সেটা দেখার জন্যও কেউ নাই।’
বাসাবাড়ি এবং রেস্টুরেন্টের রান্নাঘর সম্পূর্ণ আলাদা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘বাণিজ্যিক রান্নাঘর করতে হলে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ভেন্টিলেশনসহ সবকিছু বিশেষ যত্নে ডিজাইন করতে হয়।’
ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোল সিল করা
উপরের বিষয়গুলো সাদা চোখে দেখে বুঝে নেয়া যায় যে ভবনটি নিরাপদ কি-না। কিন্তু কিছু বিষয় আছে, যা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে পড়বে না। কিন্তু ভবনের নিরাপত্তার জন্য সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার অব. আলী আহমেদ খান বলেন, ভবনের ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোল সিল করা গুরুপূর্ণ।
আধুনিক বহুতল ভবনগুলিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, হিটিং, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগের জন্য যে পাইপগুলো টানা হয়, সেগুলো যায় ডাক্ট লাইন এবং ক্যাবল হোলের ভেতর দিয়ে। এই লাইন ও গর্ত দিয়ে ধোঁয়া এবং আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ধোঁয়া এবং আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তাই ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোলগুলো আগুন প্রতিরোধক উপাদান দিয়ে ভালো করে বন্ধ করার কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এখন ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার কোড মানা হয় না। আর মানা হচ্ছে কিনা, সেটা মনিটর করার মতো সক্ষমতাও আমাদের ফায়ার সার্ভিসের নাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সবসময় আগুন লাগার পরে কিভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সেটা বলি। কিন্তু আগুন লাগবেই না, আমাদেরকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেজন্য ভবন নির্মাণের সময়ই ইলেকট্রিক্যাল লাইনসহ অন্য বিষয়গুলো মানতে হবে।’
স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম
আগুন নেভানোর জন্য একটা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা হচ্ছে স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম। এটি একটি ভবনের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে যুক্ত থাকে।
কোনো স্থানের তাপমাত্রা ৫৭ ডিগ্রির বেশি হলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে পানি ছিটিয়ে দেয়। ফলে আগুন নিভে যায়।
সাধারণত বড় বড় বাণিজ্যিক বা কারখানা ভবনে সাধারণত এগুলো ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে কিছু কিছু আবাসিক ভবনেও এগুলোর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
নওয়াজ এ বিষয়ে বলেন, ‘ভবনে আগুন লাগার পর মানুষকে বাঁচানোর জন্য সেখানে সিঁড়ি এবং অ্যালার্ম সিস্টেম সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু সম্পত্তি রক্ষার জন্য সেখানে পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। বা, স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম থাকা লাগবে।’
ভবনের ডিজাইন ও উদ্দেশে পরিবর্তন
বেইলি রোডের যে ভবনে আগুন লাগে, শুরুতে সেটি একটি আবাসিক ভবন ছিলো বলে জানান নওয়াজ।
তিনি বলেন, ‘এই ভবনটা প্রাথমিকভাবে আবাসিক ভবন ছিল। কিন্তু পরে এর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন চেঞ্জ করলে রাজউক, আবাসিক ভবনে রেস্টুরেন্টকে ব্যবসা করার লাইসেন্স দিলে সিটি কর্পোরেশন, সামনের দিকে কাঁচ বসালে সেই ইঞ্জিনিয়ার; এরা এই ঘটনার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।’
যদিও কিছু গণমাধ্যমে রাজউকের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে এই ভবনের পাঁচতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক এবং এই ভবনে শুধুমাত্র বাসাবাড়ি ও অফিস করার অনুমোদন ছিল।
নওয়াজ আরো বলেন যে ভবনের সামনের অংশে কাঁচ থাকায় মৃতের সংখ্যা বেশি হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কোনো ভবনে গ্লাস দিতে হলে সেটার ড্রয়িং এবং ডিজাইন পরিবর্তন করতে হবে…স্মোক এলে যেন তা অটোমেটিক্যালি বের হয়ে যেতে পারে। এই ভবনের ওই গ্লাসের জন্য ভেতরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। ধোঁয়া ভেতরে ঢুকে গেছে, আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। এখানে কোনো ভেন্টিলেশন ছিল না।’
এ বিষয়ে হাবিবও বলেন, ‘ভবন বানানোর পর তার উদ্দেশ্য পরিবর্তন করাটা গর্হিত অপরাধ।’ কারণ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের নকশা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা একদমই আলাদা।
তাই, কোনো ভবনে প্রবেশের আগে তার শুরুর ইতিহাস এবং উদ্দেশ্য জেনে নেয়া গেলে নিজেকে অনেকাংশে নিরাপদে রাখা সম্ভব।
সূত্র : বিবিসি