সৌদিতে কাফালা পদ্ধতির পরিবর্তনের লাভক্ষতি
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৫ মার্চ ২০২১, ২৩:০৫
সৌদি আরবে রোববার থেকে পরিবর্তিত শ্রম আইন কার্যকর হয়েছে। তাতে কাফালা ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো সেখানে কর্মরত প্রবাসীরা নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়াই চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন।
এছাড়া তারা সৌদি আরবের বাইরে ভ্রমণ করতে পারবেন। নিয়োগকর্তাকে লিখিতভাবে সরাসরি বা ইমেইলে জানালেই চলবে। নিয়োগকারীর কোনো পূর্বানুমতি লাগবে না। আর চাকরির মেয়াদ শেষ হলেই তারা চাকরি ছেড়ে চলে যেতে পারবেন। শুধু অনলাইনে জানালেই হবে। কোনো অনুমতি নিতে হবে না।
সৌদি জনশক্তি উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ বিন নাসের সংস্কার প্রক্রিয়ার শুরুতে গত নভেম্বরে বলেছিলেন, ‘এর মাধ্যমে আমরা একটি আকর্ষণীয় শ্রমবাজার গড়ে তুলতে চাই, এখানে কাজের পরিবেশকে উন্নত করতে চাই।’
সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা সোমবার জানান, ‘আগে প্রবাসী কর্মীরা কাজ পরিবর্তন করতে পারতেন না। আর মেয়াদ শেষে তারা চাইলেও দেশে ফিরতে পারতেন না। নিয়োগকারীর অনুমতি লাগত। তবে এখন আর অনুমতি লাগবে না। তবে কোনো প্রতেষ্ঠানে কমপক্ষে এক বছর কাজ করতে হবে। তারপর পরিবর্তন করা যাবে। আর তারা ছুটিতে নিজেদের ইচ্ছায় অন্য দেশে বা নিজের দেশে ভ্রমণ করতে পারবেন।’
এসব সুবিধা পেতে বৈধ নিয়োগপত্র লাগবে বলে জানান তিনি। বৈধ নিয়োগপত্র না থাকলে তাদের জটিলতার কোনো অবসান এই আইনে ঘটবে না।
এই ব্যবস্থার সুবিধা বাংলাদেশের গৃহকর্মী বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে যারা গেছেন তারা পাবেন কিনা জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, বৈধ নিয়োগপত্র থাকলে সবাই পাবেন।
কিন্তু জনশক্তি রফতানিকারক ও বিশ্লেষক হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ‘গৃহকর্মীরা সরাসরি এই সুযোগ পাবেন না। কারণ তারা কোনো একটি এজেন্সির মাধ্যমে গৃহকর্মে নিযুক্ত হন। ওই এজেন্সি যদি মনে করে কোনো কারণে তার চাকরি পরিবর্তন করিয়ে দেবে তাহলে তারা করে দিতে পারবে।’
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসানও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘যারা কোনো প্রতিষ্ঠানের অধীনে নিয়োগপত্র নিয়ে সরাসরি কাজ করতে গেছেন তারা নতুন আইনের সুবিধা নিয়ে চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন।’
কিন্তু বাংলাদেশের যারা সৌদি আরবে কাজ করছেন তাদের বড় অংশ বিশেষ করে নারীরা গৃহকর্মী হিসেবেই সেখানে গেছেন। গাড়িচালকদের একটি অংশ যারা ব্যক্তিগত গাড়ি চালান তারাও এই সুবিধা পাবেন না বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
তবে সৌদি আরবে বাংলাদেশী দূতাবাসের কর্মকর্তা জানান, আইনটি মাত্র প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে সব বিষয় পরিষ্কার হবে। আর এখন থেকে ভিসা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আসবে। সিঙ্গেল এন্ট্রির পরিবর্তে প্রবাসী কর্মীদের মাল্টিপল ভিসা দেয়া হবে।
সৌদি আরবে এখন বিভিন্ন দেশের প্রায় এক কোটি প্রবাসী কর্মী রয়েছেন। তার মধ্যে ২০ লাখ বৈধ বাংলাদেশী আছেন। আর বাংলাদেশীদের মধ্যে তিন লাখ নারী কর্মী যারা গৃহকর্মী হিসেবে সেখানে কাজ করেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৪০ হাজার কর্মী যান সৌদি আরবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১০ হাজারের মতো বাংলাদেশী নাগরিক ডিপোর্টেশন সেন্টারে আছেন। তার অধিকাংশই সৌদি আরবে। ২০১৪ সালে আট লাখ বাংলাদেশী সেখানে সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়েছেন।
গৃহকর্মী হিসেবে যারা সৌদি আরবে কাজ করেন তারা ৯ ধরনের কাজ করেন মালিকের বাড়িতে। ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের হিসাব মতে, গত চার বছরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৪৭৩ জন বাংলাদেশী প্রবাসী নারী কর্মী মারা গেছেন। এরমধ্যে সৌদি আরবে মারা গেছেন ১৭৫ জন। ৮১ জন নারী কর্মী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আত্মহত্যা করেছেন। তার মধ্যে সৌদি আরবে ৫১ জন। গত দুই বছরে সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা ৬৩ জনকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৮ জনই নারী।
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, সৌদি আরব নিজেদের স্বার্থেই শ্রম আইনে পরিবর্তন এনেছে। কোভিড-এর কারণে শ্রমিকের স্বল্পতা এবং বাইরে থেকে শ্রমিক যাওয়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে সেখানে অবস্থানরত কর্মী বিশেষ করে বাংলাদেশীরা এখন চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন। বেশি বেতনে আরেক জায়গায় কাজ নিতে পারবেন। আগে যেটা হতো তাদের পাসপোর্ট আটকে রাখা হতো। তারা চাকরি পরিবর্তন তো দূরের কথা চাইলে দেশেও ফিরতে পারতেন না। এমনকি কেউ মারা গেলেও অনুমতি না মিললে লাশ দেশে পাঠানো যেত না।
শরিফুল হাসান বলেন, ‘আরেকটি আশঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশের প্রতারক চক্ররা এই আইনের সুযোগ নিতে পারে। তার ফ্রি ভিসার কথা বলে সৌদি আরবে লোক পাঠানোর প্রতারণা শুরু করতে পারে। এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’
এই চাকরি পরিবর্তনের সুযোগ দেয়া হয়েছে অঞ্চলভিত্তিক। আর অঞ্চলও ভাগ করে দেয়া হয়েছে। সেই অঞ্চলের বাইরে আবার চাকরি পরিবর্তন করে যাওয়ার সুযোগ থাকছে না বলে জানা গেছে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে