০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

যে দেশে যে সাপ আছে, সেখানে সেই সাপের বিষ দিয়েই অ্যান্টিভেনম তৈরি করতে হয় : অধ্যাপক ডা: আবুল ফয়েজ

-

স্বনামধন্য চিকিৎসাবিদ অধ্যাপক ডা: আবুল ফয়েজের জন্ম চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ গ্রামে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এফসিপিএস সম্পন্ন করে পিএইচডি করেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসল আপনটাইন থেকে। ১৯৯৩ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে যোগ দেন তিনি। সেখানে বছর দশেক থাকার পর আসেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নেন ২০০৮ সালে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন কিছু দিন। এখন টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। সাপের বিষের ওপর পিএইচডি করা এই চিকিৎসা বিজ্ঞানী সাপের বিষ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং সর্পদংশনে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেন। নয়া দিগন্তের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলোÑ
সাপের বিষের ওপর পিএইচডি আমার। মূলত চন্দ্রবোডা সাপ বা রাসেল ভাইপারের বিষের ওপর গবেষণা করি। পিএইচডির শিরোনামÑ অ্যাফেক্ট ফ্রম রাসেল ভাইপার অন মাসল নার্ভ। তখন আমি লন্ডনে। ভাবলাম, আমাদের দেশের মানুষদের সর্প দংশনের বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন করা দরকার।
পিএইচডি শেষে ১৯৯৩ সালে দেশে ফিরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগে যোগদান করি। এখানে চন্দ্রবোডা বা কোবরা, ক্রেইট, সবুজ সাপের ওপরও কাজ করেছি। প্রত্যেক রোগীর ইতিহাস আমরা রেকর্ড করেছি। সাপে কামড়ানো রোগীদের প্রত্যেকেরই গল্প আছে। কেউ হয়তো রাতে খালি পায়ে হাঁটতে গিয়ে সাপের কামড় খেয়েছেন, কেউ বা ঘরের মেঝেতে ঘুমিয়ে থাকার সময় সাপের কামড় খেয়েছেন। শিশুরা খেলতে গিয়ে গর্তের মধ্যে হাত দিয়েও অনেকসময় কামড় খাচ্ছে। অথচ সাপ দংশন করার পর যুগ যুগ ধরে মানুষ যাচ্ছে ওঝার কাছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যালে কাজ করেছি ১৯৯৩ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত— ১০ বছর। সেখানে সাপে কাটা কয়েক শ’ রোগীর চিকিৎসা করেছি। আমাদের এখানে ফণা তোলা কোবরা সাপের মাথার পেছনে একটা বলয় আছে, দু’টি বলয়ওয়ালা কোবরাও দেখা যায়। এই সাপের বিষের কী প্রভাব হতে পারে সেটি বিস্তারিত আগে জানা ছিল না। আগে শুধু বলা হতো, এই সাপের বিষে প্যারালাইসিস হতে পারে; কিন্তু এর পাশাপাশি যেখানে দংশন করে, সেখানে পচনও ধরে। আমরাই প্রথমবারের মতো ৭০ জন রোগীর ওপর পরীক্ষা করে এটা নিশ্চিত হয়েছি।
আগে মনে করা হতো, কালনাগিনী বা ক্রেইটের মধ্যে শুধু কমন ক্রেইট সচরাচর দেখা যায়; কিন্তু কমন ক্রেইট বাংলাদেশে একেবারে আনকমন। অথচ ব্ল্যাক ক্রেইট বা কালোসাপ (যেটা অনেকের কাছে কালো নাইজার নামেও পরিচিত), সম্পর্কে এ দেশের অনেকেই জানত না। এটার বিষের প্রতিক্রিয়া নিয়েও খুব একটা কাজ হয়নি।
আমরা গবেষণা করে দেখেছি, ক্রেইট যখন কামড় দেয়, তখন শুধু প্যারালিসিস নয়, রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হতে পারে, এমনকি কিডনিও নষ্ট হয়ে যায়। এই সাংঘাতিক বিষধর সাপ নিয়েও আমাদের প্রকাশনা আছে। সর্প দংশনের পর অনেকে গিঁট দিয়ে থাকেন। এটাও বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। আপনি যদি জোড়ায় শক্ত করে গিঁট দেন, তাহলে তো রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটে রোগীর নার্ভে চাপ পড়ে প্যারালাইসিস হতে পারে, গিঁট দেয়া স্থানে পচনও ধরতে পারে।
এখন বিজ্ঞান বলে গিঁট নয়, আপনি অঙ্গটাকে অচল করে দিন। অর্থাৎ হাতে দংশন করলে হাতটা নাড়াবেন না, পায়ে দংশন করলে পা নড়াচড়া করবেন না।
ডা: ফয়েজ লিখেছেন, আমি সর্প দংশনের রোগী প্রথম দেখি ১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসে। সকালবেলা রোগী দেখার রাউন্ডে আছি। স্টুডেন্টরা বলল, ‘স্যার, এক মহিলা রোগী এসেছেন। হাত-পা নাড়াতে পারছেন না। ৮ বা ৯ মাসের গর্ভবতী।’ দেখার পর বুঝলাম, এটা সর্প দংশন ছাড়া আর কিছু নয়; কিন্তু রোগীর স্বামী আর আত্মীয়-স্বজনদের কেউই স্বীকার করছিলেন না। পরে মহিলার স্বামীকে আলাদা করে বুঝিয়ে রাজি করানোর পর মহিলাকে অ্যান্টিভেনম দিলাম। দেখা গেল, ঘণ্টা তিনেকের মাথায় রোগী ভালো হয়ে গেছে। তারপর তিনি জানালেন, রাতে প্রাকৃতিক কাজে সাড়া দেয়ার জন্য বাইরে গেলে তার পশ্চাৎদেশে সর্প দংশন করে। তিনি আগে এটা বলেননি, কারণ তার শাশুড়ি বলেছেন, ‘যদি তুমি সর্প দংশনের কথা বলো, তাহলে ডাক্তার এমন ওষুধ দেবেন যে তোমার পেটের বাচ্চা মারা যাবে।’
বাঁশখালীর একটা ঘটনা মনে আছে। ১০-১২ বছরের এক ছেলে বাড়িতে মার্বেল নিয়ে খেলছিল। গর্তে পড়া মার্বেলটি তুলতে গেলে সাপ তার হাতে দংশন করল। তাকে বাঁশখালী উপজেলা হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে আনা হয়। ধীরে ধীরে ওর হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। ওই সময় ডাক্তারদের ধর্মঘট চলছিল; কিন্তু জরুরি ব্যবস্থা সচল ছিল। আমরা কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করি। ৭২ ঘণ্টা পর সে সেরে ওঠে।
তিনি জানান, যে দেশে যে সাপ আছে, সে দেশে সেই সাপের বিষ দিয়েই অ্যান্টিভেনম তৈরি করতে হয়; কিন্তু আমাদের দেশে অ্যান্টিভেনম আনা হয় ভারত থেকে। যেটা আসলে ভারতে থাকা সাপের জন্য তৈরি করা। আমরা এখন চেষ্টা করছি দেশী সাপের বিষ সংগ্রহ করে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে, যাতে সরকারিভাবে অ্যান্টিভেনম তৈরি করা যায়। এ জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে একটি ভেনম রিসার্চ সেন্টার করেছি আমরা। সেখানে সাপ লালন-পালন করে, বিষ সংগ্রহ করে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা করা হবে।

নিজের লেখা সর্প দংশন ও এর চিকিৎসা বইটি ১৯৯৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ৬০ পৃষ্ঠার চার রঙা বইটিতে সাপে কাটা রোগীদের সচিত্র কেস স্টাডি আছে। আরো আছে বাংলাদেশে থাকা নানা প্রজাতির বিষধর ও অবিষধর সাপ নিয়ে চমৎকার বর্ণনা। বিষধর না অবিষধর কোন ধরনের সাপে কেটেছে তা বোঝার উপায় প্রাথমিক চিকিৎসাপদ্ধতি, প্রতিকার, স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসকদের ভূমিকা, অ্যান্টিভেনমের ব্যবহারবিধিসহ আরো নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে বইটিতে। বইয়ের শুরুতে আছে জনসাধারণের জন্য সাপ সম্পর্কে কিছু তথ্য ও উপদেশ, সাপ দেখলে কী করবেন, সর্প দংশন কিভাবে এড়ানো যায় সে বিষয়ে পরামর্শ। সাধারণ মানুষের বোধগম্য করেই সব কিছু তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে।


আরো সংবাদ



premium cement