ঐক্যফ্রন্ট : বিএনপির লাভ-ক্ষতি
- মোহাম্মদ শরীফ
- ২০ নভেম্বর ২০১৮, ১৩:৫৩
১৯৫৪ সালে শক্তিশালী মুসলিম লীগকে টেক্কা দিতে পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা ঐক্য হওয়ার কথা ভাবতে থাকেন। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমান আওয়ামী লীগ) জোট তৈরির জোর চেষ্টা চালায়। শেষমেশ চারটি দল মিলে তৈরি হয় যুক্তফ্রন্ট। ফলে একই মঞ্চে চলে আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের মতো জাঁদরেল নেতারা। সে সময় মওলানা বেশ জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন। এই সেই ভাসানী, যিনি ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে জেলে নেয়ার পর সেনা শাসক আইয়ুব খানকে বলেছিলেন, ‘আইয়ুব যদি মুজিবকে মুক্তি না দাও, তোমাকে দুই ঊরুতে ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলব আমি।’
১৯৫৪-তেও ভাসানীর জনপ্রিয়তা ছিল তার অন্যান্য পর্যায়ে। কৃষকের নেতা এ কে ফজলুল হক জনগণের কাছে ছিলেন ‘বাঘ’ হিসেবে পরিচিত। এমন সব বাঘা নেতার গড়া যুক্তফ্রন্ট শেষমেশ জয়ও পেয়েছিল। কিন্তু সেই নেতাদের গড়া সরকার অর্ধবছরও শাসন করতে পারেনি। জোটে থাকা দলের নেতাদের পদপ্রাপ্তি নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব, তা পৌঁছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ফলে নিজেরাই সংসদ ভেঙে দেয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। শেষমেশ ক্ষমতা চলে যায় পাকিস্তানের সামরিক সরকারের হাতে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। ভোট ৩০ ডিসেম্বর। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন বাছাই সম্পন্নের পথে। জোটগুলো আসন নিয়ে দরকষাকষির শেষ প্রান্তে। নির্বাচন কমিশন ব্যস্ত ব্যালট পেপার তৈরিতে। জনগণ চা দোকানে রঙ-বেরঙের রাজনৈতিক আলাপে বেশ উৎফুল্ল। কেবল যে উৎফুল্ল তা নয়, সাথে তারা শঙ্কিতও। এই নির্বাচনের একটি ভালো দিক হলো এটি ২০১৪ সালের মতো একতরফা হচ্ছে না। প্রধান বিরোধী জোট এবার নির্বাচনে আসছে। এই নির্বাচন সর্বশেষ গঠিত ঐক্যফ্রন্ট আরো গুরুত্ববহ করে তুলেছে। ঐক্যফ্রন্টে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর যোগদান জোটটিকে করেছে আরো প্রাণবন্ত। বঙ্গবীর একটা সময় বঙ্গবন্ধু পরিবারের খুব কাছের লোক ছিলেন। রাজনীতিতে এ লোকটির এখনো আদর্শ বঙ্গবন্ধু।
কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলে দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। তার গড়া ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ টাঙ্গাইলকে করেছে পাকমুক্ত। কাদের সিদ্দিকীর আরো একটি দিক হলো বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কেবল তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছিলেন। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে তার অনেক সহযোদ্ধা মারা গেছেন। অনেকে হয়েছেন আহত, অনেকে পঙ্গুত্ব নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করার অপরাধে তাকে অনেক বছর ভারতে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। ভারত থেকে ফিরে তিনি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন। অনেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে লাফালাফি করে ফায়দা নিচ্ছে। হচ্ছে ফায়দার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী।
এ ক্ষেত্রে বঙ্গবীর একেবারে ভিন্ন। দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবীর প্রধান একজন, যিনি এযাবৎকাল অনেক কঠিন সত্য বীরকণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন, এখনো করেন। পাকিস্তানি নেতারা আমেরিকার সাথে সামরিক চুক্তি করলে ভাসানী নিজ দলকে প্রতিবাদ জানাতে আহ্বান জানান। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ বিরত থাকে প্রতিবাদ করা থেকে। দেশবিরোধী সামরিক চুক্তির প্রতিবাদ করতে গিয়ে একসময় আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন ভাসানী। এ দিক থেকে মওলানা ভাসানীর সাথে বঙ্গবীরের বেশ মিল রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যায় আনন্দ প্রকাশকারী নেতাদের নিয়ে জোট করায় আওয়ামী লীগে যোগ দেননি বঙ্গবীর। ঐক্যফ্রন্টের আরো একটি ভালো দিক হলো, এখানে যুক্ত হয়েছেন ড. কামাল হোসেনের মতো পাকা আইনজীবী। ড. কামাল হোসেনের অতীতও বেশ দারুণ।
শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসায় আইয়ুব খান। মামলা এমন পর্যায়ে চলছিল, শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী প্রমাণিত করে ফাঁসিতে ঝুলানোর পথে নেয়া হয়। সেই মামলায় শেখ মুজিবের হয়ে তরুণ আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন কামাল হোসেন। শেখ মুজিবসহ তার সহপাঠী কারাবন্দীদের নির্দোষ প্রমাণে জোরালো ভূমিকা রাখেন ড. কামাল এবং শেষমেশ মুক্তিও পান তারা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু দু’টি আসন থেকে জয় পান। ঢাকার আসনটি বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনকে দিয়ে দেন। আজ যে সংবিধান সংশোধন নিয়ে দুই পক্ষ তর্কবিতর্কে লিপ্ত, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বেই সেই সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল। ঐক্যফ্রন্ট গড়ার পরপরই ড. কামালের বক্তব্য ছিলÑ সংবিধান সংশোধন দুই মিনিটের কাজ, যা ব্যাপক আলোচিত করেছিল ঐক্যফ্রন্টকে। মজার বিষয় হলো, যুক্তফ্রন্ট গড়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উত্তরাধিকারী হলেন ঐক্যফ্রন্ট গড়া ড. কামাল হোসেন।
পারিবারিক সূত্রে এ দুই পুরুষ আত্মীয়। এ ছাড়া ঐক্যফ্রন্টের অপর দুই নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না ও আ স ম আবদুর রব প্রথম দেশের পতাকা উত্তোলন করে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসে। ঠিক এই দিক থেকে ঐক্যফ্রন্ট বেশ শক্তিশালী। মুক্তিযুদ্ধের পরে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে জোট করে অসময়ে কিছুটা সুবিধায় আছে বিএনপি। দলের প্রধান নেতার অনুপস্থিতির ফাঁকা অবস্থান ঐক্যফ্রন্টের মাধ্যমে পুষিয়ে নিচ্ছে বিএনপি। তবে আশঙ্কাও আছে। কথায় আছে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হয়। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ক্ষমতায় গেলেও ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের অবস্থা হবে ঐক্যফ্রন্টের। ক্ষমতা আর পদের দ্বন্দ্বে সরকার গড়ার আগে ভেঙে পড়বেন তারা। সেটি নির্বাচন-পরবর্তী হিসাব। জয়-বিজয় এখন অনেক সূত্রে গাঁথা।
বর্তমান অবস্থা হলো, দেশ আবারো একটি শক্তিশালী বিরোধী জোট পেল, যেটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বড় একটি দিক। এতে সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব অনেকাংশে কমে আসবে। বিএনপির তৃণমূল সমর্থন বেশ ভালো, যেটা ঐক্যফ্রন্ট জোটের অন্য নেতাদের নেই। এ সঙ্কটে বিএনপির তৃণমূল জাগাতে দরকার ছিল এমন সব নেতার; যারা সরকারকে কথায় কাবু করবে, রাখবে চাপে। আপাতত সেটি বিএনপি পেয়েছে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, কুমিল্লা