১০ হাজার টাকার চুক্তিতে খুন : নেপথ্যে ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৮ নভেম্বর ২০১৮, ১২:৪৬
পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে আশুলিয়ায় চলন্ত বাস থেকে বাবাকে ফেলে দিয়ে মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার মিশন সফল করতে খুনিদের সাথে ১০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় চারজন কিলার। গত ৯ নভেম্বর শুক্রবার রাতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিহত জরিনা খাতুনের মেয়ে রোজিনার সাথে তার স্বামী নূর ইসলাম ও তার পরিবারের দীর্ঘ দিন ধরে কলহ চলছিল, যা সাম্প্রতিক সময়ে প্রকট আকার ধারণ করে। এই কলহ দূর করতে সিরাজগঞ্জের চৌহালী থেকে আশুলিয়ার মুন্সিপাড়ায় বিয়াই বাড়িতে প্রায়ই আসতেন জরিনা খাতুন ও তার বাবা আকবর আলী মণ্ডল। কিন্তু বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি রোজিনার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তারা চেয়েছিলেন রোজিনার বাড়ির লোকজন যেন আর তাদের বাড়িতে না আসে। এজন্য তারা জরিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ৯ নভেম্বর জরিনা আবার তাদের বাড়িতে এলে তাদের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ওই দিন বিকেলে জামাই নূর ইসলাম একটি মিনি বাসের চালক ও হেলপারকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে ওই বাসে শাশুড়ি জরিনা ও নানা শ্বশুর আকবর আলী মণ্ডল তুলে দেন। এর একটু পরই বাস থেকে আকবর আলীকে ফেলে দিয়ে জরিনাকে নিয়ে বাসটি চলে যায়।
আকবর আলী বিষয়টি স্থানীয় লোকজন ও পুলিশকে জানালে রাত সাড়ে ৮টার দিকে টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের আশুলিয়ার মরাগাং এলাকার রাস্তার পাশ থেকে নিহত জরিনার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের মেয়ে জামাই নূর ইসলাম বাদি হয়ে আশুলিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরদিন রাতে আশুলিয়া থানা থেকে নথিপত্রসহ মামলার তদন্ত গোয়েন্দা পুলিশে (উত্তর) হস্তান্তর করা হয়। পরে তা পুলিশ সদর দফতরের আদেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা জেলা তদন্ত শুরু করে। ঘটনার সাত দিন পরে চাঞ্চল্যকর এ হত্যার রহস্য উন্মোচন করে পিবিআই।
মামলার বাদি ও নিহতের মেয়ে জামাই নূর ইসলাম ও অন্য দুই পরিকল্পনাকারী রোজিনার শাশুড়ি আমেনা বেগম এবং মামা শ্বশুর স্বপনকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই ঢাকা জেলা পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মিনিবাসটিও আটক করা হয়। তবে হত্যাকাণ্ড ঘটানো চালক, কন্ডাক্টার ও দুই হেল্পারকে গ্রেফতার করতে পারেনি তারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পাঁচ বছর আগে মামা স্বপনের মধ্যস্থতায় রোজিনা ও নূর ইসলামের বিয়ে হয়। এর পর থেকে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ লেগেই থাকত। এই বিবাদ মেটাতে প্রায়ই জরিনা আশুলিয়ায় আসতেন। সম্প্রতি কলহ প্রকট আকার ধারণ করে। নূর ইসলাম তার মা আমেনা বেগম ও মামা স্বপনের সাথে বিষয়টি আলোচনা করেন। তারা পরিকল্পনা করেন জরিনাকে এমন শিক্ষা দেয়ার যেন তিনি আর তাদের বাড়িতে না আসেন।
ঘটনার দিন দুপুরে সিরাজগঞ্জ থেকে মেয়ের বাড়ি আশুলিয়ায় আসেন জরিনা ও তার বাবা আকবর আলী মণ্ডল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিকেল ৫টার দিকে তারা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী জামাই নূর ইসলাম তাদের টাঙ্গাইলগামী একটি মিনিবাসে তুলে দেন। বাসটি স্বপন ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। কিছুক্ষণ পরই বাসের হেলপার ও সুপারভাইজাররা আকবর আলীকে মারধর করে বাস থেকে ফেলে দিয়ে জরিনাকে হত্যা করে। পরে আকবর আলী বিষয়টি নূর ইসলামকে জানালে তিনি পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে ৫০০ গজ দূরে জরিনার লাশ উদ্ধার করেন।
গতকাল ধানমন্ডির পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদর দফতরে সংবাদ সম্মলনে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, পারিবারিক কলহ ও দ্বন্দ্ব নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। একপর্যায়ে ভিকটিমের মেয়ে রোজিনাকে তার স্বামী নূর ইসলাম ব্যাপক মারধর শুরু করে। নূর ইসলাম এবং তার মা তাদের পরিবারে কলহের জন্য রোজিনার মা জরিনাকেই দায়ী করেন এবং তারা পরিকল্পনা করেন জরিনাকে উচিত শিক্ষা দেয়ার। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মা আমেনার পরামর্শে মামা স্বপনকে বেছে নেন নূর ইসলাম। পরে স্বপন ১০ হাজার টাকার চুক্তিতে একটি মিনিবাস ও ওই বাসের চালক, কন্ডাক্টর এবং দুই হেলপারকে ভাড়া করেন।
বনজ কুমার বলেন, ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় স্বপন শিমুলতলা বাসস্ট্যান্ডে মিনি বাসটিকে রেখে দেন। পরে গাড়িটি টাঙ্গাইল যাবে বলে স্বপন, জরিনা ও আকবরকে বাসে তুলে দেন। বাসটিতে জরিনা এবং তার বাবা ছাড়া আর কোনো যাত্রী না থাকায় বাসটি আশুলিয়ার বিভিন্ন রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে রাত সাড়ে ৭টার দিকে আশুলিয়া থানার মরাগাং ব্রিজের উত্তর পাশে প্রথমে নিহতের বাবাকে মারধর করে চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় কন্ডাক্টর ও হেল্পার। পরে মরাগাং ব্রিজের ৫০০ গজ সামনে জরিনাকে মারধর করে হত্যা করে গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। বাসের ভেতরে জরিনাকে কিভাবে হত্যা করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এখনো আমরা হাতে পাইনি। এছাড়া সরাসরি হত্যায় অংশ নেয়া চারজনকে গ্রেফতার করা যায়নি। শিগগিরই বাকি চার আসামিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শ্বাস রোধ করে জরিনাকে হত্যা করা হয়েছে।