নীলনকশার একতরফা নির্বাচন : অন্য ভাবনা
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ১৫ নভেম্বর ২০১৮, ১২:৩৭
‘পলিটিক্স’ এবং ‘পলি-ট্রিক্সের’ পার্থক্যটি আবার প্রমাণিত হলো। পলিটিক্সের ধারকেরা আস্থা-বিশ্বাস, সৌজন্য-শুভেচ্ছা, নিয়মতান্ত্রিকতা-গণতান্ত্রিকতা নিয়ে এগোতে চাচ্ছিলেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ের আশ্বাস-লৌকিকতায় তারা আশ্বস্ত হচ্ছিলেন। হয়তো তারা পলিটিক্স এবং পলি-ট্রিক্সের পার্থক্যটি ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়েছিলেন। তারা বিস্মৃত হয়েছিলেন যে, রাজনীতির অর্থ এখন আর নীতি-নৈতিকতা, আইনকানুন ও সভ্যতা সংস্কৃতিতে আবদ্ধ নেই। এখন রাজনীতির বাহন হচ্ছে- প্রতারণা, প্রচারণা, অনাচার-মিথ্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতন এবং অর্থসম্পদের ভাগ-বাঁটোয়ারা। বার্টান্ড রাসেলের সেই পুরনো কথা- ‘রাজনীতি হচ্ছে বদমাইশদের শেষ আশ্রয়স্থল’ নতুন করে বাংলাদেশে ভালোভাবেই অনুভূত হচ্ছে। বাংলাদেশে বিশেষত বিগত এক দশকে ইতিবাচক রাজনীতির ইতি ঘটেছে। নীতিকথা বা গতানুগতিক রাজনৈতিক দর্শন পরিত্যক্ত হয়েছে। এর পরিবর্তে মেকিয়াভেলি এবং কৌটিল্য বা চাণক্যবাদ জেঁকে বসেছে। মেকিয়াভেলি মনে করতেন রাজার স্বার্থ সাধনের জন্য বিশেষ কোনো নীতি-নৈতিকতায় আবদ্ধ না থেকে অনাচার-অত্যাচার, পাপাচার-মিথ্যাচার সবই সিদ্ধ। তিনি কূটকৌশল ও শক্তি প্রয়োগকেই রাজার কৌশল হিসেবে অনুমোদন করেন।
তিনি আরো মনে করেন, রাষ্ট্রে সেই উত্তম শাসক যে ভয় ও সমীহের ভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। তার সেই বিখ্যাত উক্তি আজো অনেকে উদ্ধৃত করেন- ‘রাজা হবে সিংহের মতো সাহসী এবং শিয়ালের মতো ধূর্ত।’ আর ভারতীয় কূটকৌশলী কৌটিল্যও উপদেশ দেন, রাষ্ট্র ও নিজের শাসনকে রক্ষার করার জন্য, শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য শাসককে প্রয়োজনে নির্মম হতে হবে। এই লক্ষ্যে কোনো কৌশল গ্রহণেই শাসককে দ্বিধা করলে চলবে না। বাংলাদেশের শাসকদের গতি-প্রকৃতি, লক্ষ্য ও কৌশল বারবার মেকিয়াভেলি বা কৌটিল্যকে মনে করিয়ে দেয়। বিশেষত সংলাপ-পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাক্রম ওই অপকৌশলের প্রতিরূপ বলে প্রতীয়মান হয়।
নির্বাচনী দ্বৈধতা : প্রাথমিক সফলতার কথা এই যে, সব মত, সব পথের রাজনৈতিক দল, ব্যক্তিবর্গ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বড় ধরনের দ্বৈধতার বিষয় ছিল। জাতীয়তাবাদী শক্তির মূল নেতৃত্বকে জেলে বা দূরে রেখে নির্বাচন করা একটি বিরাট আবেগময় বিষয়। বেগম খালেদা জিয়া তার মানসিক, শারীরিক ও পারিপাশির্^ক দুরবস্থা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তাকে জেলে রেখে নির্বাচন কেউই করতে রাজি নয়। অথচ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে আগের মতো তারা খালি মাঠে গোল দেবে। তা ছাড়া, নির্বাচনমুখী গণতন্ত্রকামী দল হিসেবে দীর্ঘকাল নির্বাচনীপ্রক্রিয়ার বাইরে থাকাও বাস্তবসম্মত নয়। বাংলাদেশের গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও দুঃখ-কষ্টের কথা প্রকাশের একমাত্র যথার্থ মাধ্যম বিএনপি। মানুষ চায় বিগত এক দশকে তাদের ওপর যে রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সাংস্কৃতিক গোলামি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে- বিএনপি যেন তার প্রতিবাদ করে।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার : সম্প্রতি ড. কামাল হোসেনসহ এ জাতির দায়িত্বশীল নেতৃবর্গ জাতীয় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধন করেছেন, তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। সবাই বোঝে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ব্যতীত গণতন্ত্রের ভাগ্য নির্ধারণের আর বৈধ কোনো পন্থা নেই। সমাগত নির্বাচন গণতন্ত্রের বিপরীত শক্তির পক্ষ থেকে গণতন্ত্রের লেবাস ধারণের একটি পাতানো প্রক্রিয়া। গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ। পৃথিবীর অন্যান্য স্বৈরাচারের মতো নির্বাচনবিহীনভাবে অথবা ছলে-বলে-কলে-কৌশলে, গায়ের জোরে তারা তাদের অবৈধ শাসনকে বৈধ করতে পারত। কিন্তু তারা সংবিধানে সময়ান্তরে নির্বাচনের ব্যবস্থা রেখে বিপদে পড়েছেন। অতীত উত্তরাধিকারের মতো তারা বাকশাল সহজেই প্রবর্তন করতে পারতেন। তবে বাংলাদেশের জনগণের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেই বোধহয় তাদের সংযত হতে হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, অতীতের বাকশালের চেয়েও নিকৃষ্টতর শাসনব্যবস্থা বর্তমানে বহাল রয়েছে। জনগণের জন্য বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম ভালোবাসা ছিল। তিনি এদের মতো নির্বিচারে জুলুম করেননি। একদলীয় শাসনব্যবস্থার নেতিবাচক কুফল জনগণ ভোগ করলেও জীবন দুর্বিষহ ছিল না।
আওয়ামী অপকৌশল : বর্তমান শাসকেরা জনগণের জীবনই শুধু দুর্বিষহ করেনি, বরং রাষ্ট্রের সব ইনস্টিটিউশনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিচার বিভাগ দখল, আমলাতন্ত্র দলীয়করণ এবং আইনসভা তথা জাতীয় সংসদকে অকার্যকর করার সব ব্যবস্থাই তারা সম্পন্ন করেছে। বিশেষ করে যে প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থাপনা তথা নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভা গঠিত হয়, সেই নির্বাচনব্যবস্থাকে তারা তামাশায় পরিণত করেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বোগাস নির্বাচন থেকে সাম্প্রতিক সমাপ্ত খুলনা, বরিশাল ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন এর নিকৃষ্ট উদাহরণ। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তাদের কূটকৌশলটি ছিল জটিল ও বিভেদক। বহির্বিশে^র চাপে বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন ঘরে-বাইরে গ্রহণযোগ্য করা ছিল একরকম অসম্ভব। সুতরাং তাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।
বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে বিএনপিকে ভোট দিয়ে দিতে পারে। শাসক আওয়ামী লীগের জন্য বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা-না-করা ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রশ্ন। তারা চাচ্ছিল বিএনপিকে ভাগ করে নকল বিএনপি বানিয়ে সুবিধা নিতে পারবে অথবা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মতো শিখণ্ডি দ্বারা বিএনএফ এবং ধানের শীষের পরিবর্তে গমের শীষ প্রতীক নির্ধারণ করে জনগণের চোখকে ধোঁকা দিতে পারবে। তাদের সেই রণকৌশল মাঠে মারা যাওয়ার পর তারা চেষ্টা করছিল যাতে বিএনপি বা ২০ দলীয় জোট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে। কিন্তু এরা নির্বাচনকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে তথা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম হিসেবে গ্রহণ করায় আওয়ামী অপকৌশল ভেস্তে গেছে। তাদের সাধারণ লোকদের মুখে একতরফা নির্বাচনের হাসি থাকলেও অসাধারণ লোকদের ম্লান মুখ সহজেই বোঝা যায়।
সংলাপ ও বাস্তবতা : বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের মতে, ‘বল এখন সরকারি দলের কোর্টে।’ এটি একটি অপ্রিয় সত্য কথা। যে রাজনৈতিক সংলাপ দীর্ঘকাল ধরে অস্বীকার করে আসছিল তারা, বিরোধী দলের কুশলতায় তা অতিক্রান্ত হয়েছে। যদিও ফলাফল শূন্য, তবুও এতে উভয় পক্ষের সফলতা আছে। সরকার কূটনৈতিক অঙ্গনে এটাকে দেখাতে পারছে যে, তারাও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায়। অপর দিকে কূটনৈতিক অঙ্গন থেকে বিরোধী শক্তির ওপর সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের যে চাপ ছিল, তাতে তারা সহজেই উতরে গেছে। আনুষ্ঠানিক সংলাপের পরে অনানুষ্ঠানিক সংলাপের যে কথাবার্তা বলা হয়েছে তা স্রেফ ‘বাতকে বাত’, কথার কথা মাত্র। উভয় পক্ষই জানে, এর মাধ্যমে কোনো সমাধান বেরিয়ে আসবে না। তবুও সৌজন্যের খাতিরে অনেক কথা বলতে হয়।
উভয় সঙ্কটে সরকার : এই নিবন্ধের শুরুতে পলিটিক্স বনাম পলি-ট্রিক্সের কথা বলা হয়েছে। সংলাপ-পরবর্তী রাজনীতি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তত্ত্ব ও বাস্তবতায় এক সাগর ব্যবধান রয়েছে। আমরা আগেও বলেছি, সরকারের তরফ থেকে সংলাপের আয়োজন ছিল উদ্দেশ্যমূলক। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষায় তা সফল হয়েছে। অর্থাৎ পলিটিক্স বা রাজনীতি যদি সোজা হয়, তা কোনো কাজে আসে না। আর তা যদি পলি-ট্রিক্স অর্থাৎ বহুবিধ কারসাজি হয়, তা যথেষ্ট কার্যকর ও ফলদায়ক। সরকারের জন্য এখন আপাত তৃপ্তির বিষয় যে, নির্বাচনটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বা অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে। দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়ে রেখেছে। নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অংশগ্রহণ ক্ষমতাসীনদের জন্য দুধারে তরবারির মতো। তারা নির্বাচন বর্জন করলে বহির্বিশে^র গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ থাকত।
এখন যখন তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে যদি জোয়ার ওঠে তাহলে ক্ষমতাসীনদের তখতে তাউস ভেসে যেতে পারে। এখন ক্ষমতাসীন দলের রণকৌশল হচ্ছে- এ অবস্থা থেকে ফায়দা তুলে নেয়া। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের শর্ত যখন পূরণ হয়েছে, তখন সামনের দৌড়ে যাতে তারা এগোতে না পারে সে জন্য তাদের হাত-পা বেঁধে নির্বাচনী যুদ্ধে অকার্যকর করা। এ জন্য তাদের ফন্দি-ফিকিরের শেষ নেই। বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে- ‘মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট।’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, তাদের এ নীলনকশা পূর্বপরিকল্পিত। তারা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন সরকার কোন সময়, কোথায় কী কী করবে। এদের পেছনে একধরনের ধূর্ত এবং পারদর্শী আমলা রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। সৎ ও মহৎ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগে নেই তা নয়। তারা শঠ ও ধুরন্ধর রাজনীতিবিদদের সাথে পেরে উঠছেন না।
সমাগত নির্বাচন পরিকল্পনা : পরিকল্পনা মোতাবেক ২০১৪ সালের আদলে আগামী জাতীয় নির্বাচন সমাপন করতে চায় তারা। আগের মতোই ভোটারবিহীন নির্বাচন হবে এটা। পুলিশ ও প্রশাসননির্ভর এ নির্বাচনে মানুষ যাতে ভোট দিতে না আসে এ জন্য তারা ভীতির রাজত্ব কায়েম করবে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার প্রতিযোগিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘মনোনয়ন মানেই বিজয়’। এরকমভাবে বলা হবে যে, ভোট যাকেই দেন, জিতবে নৌকা। ভোটের আগেই ব্যালট ভর্তি করা, বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টদের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা, দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা ভোটের বাক্স ভর্তি করা এবং নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অপমান-অপদস্থ করে ব্যালট ছিনতাই করা ইত্যাদি পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সমাপ্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো ‘ওপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট’ রণকৌশল অবলম্বন করে শান্তিপূর্ণ(!) নির্বাচন নিশ্চিত করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হবে।
এসব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়েছে। সংলাপের আগে তারা স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনে তাদের বিশ^স্ত লোক সেট করার জন্য ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশে দুটো চাকরিই গুরুত্বপূর্ণ- একটি ডিসি, অপরটি ওসি। নির্বাচনক্ষেত্রে ওসি-ডিসিদের দাপট সবারই জানা কথা। সুতরাং সেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ ভুল করেনি। এ ছাড়া, আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ে পাইকারি পদোন্নতি, সুযোগ-সুবিধার অবাধ বণ্টন এবং দুর্নীতি করলে দুদক অনুমতি ছাড়া মামলা করতে পারবে না- এমন সব ব্যবস্থা নেয়া হয়। এভাবে নির্বাচনের আগে শত শত প্রকল্প অনুমোদন, ত্রাণকার্যক্রম ও বিভিন্ন স্থাপনার উদ্বোধনের মাধ্যমে কর্মী-সমর্থকদের অবাধ অর্থবিত্ত পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যেহেতু সংলাপ বর্তমান রাজনৈতিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক এবং যেহেতু বিরোধী দলের সাথে প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ সময়; সেহেতু সংলাপ-পরবর্তী কার্যক্রম পর্যালোচনা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে।
১. নির্বাচনকালীন সরকার : সরকারপ্রধান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নাটকীয় কায়দায় বিরোধী দলকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ দায়িত্ব প্রদানে রাজি হয়েছিলেন। কোনো রকম অনুযোগ বা অনুরোধ ব্যতিরেকে তিনি নির্বাচনকালীন সময়ে তার মন্ত্রিসভা অনেক ছোট করেছিলেন। সে ধারাবাহিকতায় এবারো তারা নিজেরাই এ রকম প্রস্তাবনার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। কয়েকবার তারিখও দিয়েছিলেন। কিন্তু অবশেষে পর্বতের মূষিক প্রসব। গৃহপালিত বিরোধী দলের প্রধান এবং প্রকৃত নেতার পৃথক পৃথক তালিকা নিয়ে বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছিল। মন্ত্রীদের কেউই গদি ছাড়তে নারাজ। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যেই তার সিদ্ধান্তহীনতার কথা জানালেন।
২. গায়েবি মামলা : নভেম্বরের প্রথম দিন সংলাপের সময় ড. কামাল হোসেন সরকার প্রদত্ত গায়েবি মামলা এবং বিরোধী নেতাকর্মীদের অব্যাহত গ্রেফতারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রধানমন্ত্রী মামলা ও গ্রেফতার আর হবে না বলে নিশ্চয়তা প্রদান করেন। ড. কামাল প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি গণমাধ্যমে এ কথাটি বলতে পারেন কি না! প্রধানমন্ত্রী সদয় সম্মতি প্রদান করেন। এরপর এক দিনের জন্যও মামলা ও হামলা বন্ধ হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বাইরে ২০ জেলায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১০০টি। এর মধ্যে ৯৭টি মামলারই বাদি পুলিশ। অনুসন্ধান ও পর্যালোচনায় জানা গেছে, দায়ের করা মামলাগুলো হয়রানিমূলক ও গায়েবি। গায়েবি মামলার কয়েকটি উদাহরণ এ রকমÑ কেরানীগঞ্জের কদমতলী গোল চত্বরের কাছে ৬ নভেম্বর দুপুরে কিছু লোককে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটাতে ও ভাঙচুর করতে দেখেছে পুলিশ। কিন্তু কদমতলীর স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বিস্ফোরণ হলে অন্তত শব্দ শোনা যেত। ভাঙচুর হলে এলাকায় শোরগোল হতো। সে দিন সকাল থেকে কদমতলী এলাকা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান। ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১৩ জনকে হাতেনাতে গ্রেফতার করার কথা বলেছে পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, সে দিন পুলিশ গাড়ি থেকে নামিয়ে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। একেই বলে গায়েবি মামলা। একই কায়দায় ঢাকার ছয়টি থানায় ছয়টি মামলা হয়। ১৩৮ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ১০ নভেম্বরের পুলিশ বলেছিল আটকের সংখ্যা মোট ১৮৪ জন। গত সপ্তাহেও থেমে থাকেনি গায়েবি মামলা ও গ্রেফতার। ইতোমধ্যে সংখ্যাটি অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা।
৩. সভা-সমাবেশ : ওই সংলাপে প্রধানমন্ত্রী এটাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে আর বাধা দেয়া হবে না। কিন্তু দেখা গেল ৬ তারিখের জনসভা শেষে মানুষজন যখন ঘরে ফিরছিলেন, তখন তাদের বিনা কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরবর্তীকালে তাদের বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাজশাহীর জনসভারও একই চিত্র। দুই দিন আগে থেকেই সরকারি দলের পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা তথাকথিত ধর্মঘটের নামে শহরটিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। জনগণকে পথে পথে বাধা দেয়া হয়েছে। বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছে। কাদের সিদ্দিকী এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার গাড়ি আটকে দেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ।
৪. নির্বাচনী শিডিউল : সংলাপের স্পিরিট অনুযায়ী জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করার কথা। বিরোধীদলীয় নেতারা ড. কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল এমনকি সরকারি দলে যোগদানে ইচ্ছুক ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরী শিডিউল পিছিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। পরে নির্বাচনের তারিখ অবশ্য এক সপ্তাহ পেছানো হয়েছে। এতে কারো কোনো উপকার হয়নি। বোঝাই যাচ্ছে ‘বিরোধীদের অপ্রস্তুত রেখে ভোটে যেতে চাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এত দিনে বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের দৌড়ের ওপর রেখেছে সরকারের পুলিশবাহিনী। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা তথা নমিনেশন দেয়ার ব্যাপারে যে ন্যূনতম সময়টুকু পাওয়ার কথা, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সে সময় শিডিউল পরিবর্তন করার পরও তা যথেষ্ট নয়।
৫. ইভিএম : বিরোধী দলগুলো ও সিভিল সোসাইটির প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন দ্বারা ভোট নেয়ার গোঁয়ার্তুমিতে অটুট আছে। শুধু সরকারি দলের সমর্থনে নির্বাচন কমিশন জনবিরোধী ওই সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক মহলের ধারণা সরকারি দলের অনুকূলে ভোট কারচুপি করার উদ্দেশ্যে ইভিএম ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হবে। সংলাপে সব রাজনৈতিক দল ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে।
৬. বিদেশী পর্যবেক্ষক : সরকার যে একতরফা নীলনকশার নির্বাচন করতে চাচ্ছে তার বড় একটি প্রমাণ বিদেশী পর্যবেক্ষক পাঠানোর ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউ পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমিশনের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান ফেডারিকা মঘেরিনি বলেছেন, ‘কোনো পাতানো নির্বাচনকে বৈধতা দেয়া তাদের কাজ নয়।’ পৃথিবীর সর্বত্রই নির্বাচন ঘোষণার পর পর্যবেক্ষক পাঠাতে যথেষ্ট সময় দেয়া হয়। অথচ নির্বাচন কমিশন এমনভাবে তারিখ ঘোষণা করেছে যাতে বিদেশ থেকে পর্যবেক্ষক আসতে না পারে।
৭. ‘অধিকার’ : দেশের পর্যবেক্ষক যারা সরকারের সমালোচক তাদেরও নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ ও ক্ষমতা বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া, নির্বাচনকেন্দ্রে প্রবেশ ও ছবি তোলার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। স্পষ্টত বোঝা যায়, একতরফা নীলনকশার নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই এসব কিছু করা হচ্ছে।
৮. সিকিউরিটি অ্যাক্ট : নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে সরকারের নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ কৌশল ততই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সরকার সম্পাদক ও সাংবাদিক সমাজের আবেদনকে অগ্রাহ্য করে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাস করেছে। এ ধরনের আরো আইন এর আগে পাস করা হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, নির্বাচনের মুহূর্তে যারা সরকারবিরোধী বা ভিন্ন মত পোষণ করতে চায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা। এ ক্ষেত্রে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের উদাহরণ উপস্থাপন করা যায়। তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন মানহানির মামলায়। এখন তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রয়োগ করা হয়েছে।
৯. গণগ্রেফতার : সারা দেশে ইতোমধ্যে যে ব্যাপক গ্রেফতার চালু হয়েছে তার বেশির ভাগ বিএনপির নির্বাচনকালীন সম্ভাব্য কর্মী, এজেন্ট বা স্বেচ্ছাসেবক। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ সেদিন সংবাদ সম্মেলনে গ্রেফতারকৃতদের নাম ও বিস্তারিত ঠিকানা দিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনে বিএনপিকে নিঃশেষ করে দেয়া। যাতে বিএনপির পক্ষে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কাজ করতে না পারে।
১০. অংশগ্রহণমূলক বনাম সুষ্ঠু নির্বাচন : ক্ষমতাসীন সরকারের একটি উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আর তা হলো, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নয় অভিমত বিদ্বজ্জনদের। তারা সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টিতে সরকারের ব্যর্থতার উল্লেখ করেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এবং বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মন্তব্য করেন, আপাতদৃষ্টিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পরিবেশ দেখতে পেলেও নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে এ অবস্থায় রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা ‘দীর্ঘ দুঃসহ যাতনার কণ্টক পথ’ বেয়ে একটি গণবিপ্লবের আশা করেন।
এই মুহূর্তে নির্বাচনী যে সমীকরণ গোটা জাতির সামনে উপস্থাপিত হয়েছে, তা আবারো সেই পুরনো নৌকা বনাম ধানের শীষের লড়াইয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের বাইরে জোট-বেজোটের যে লোকাচার বা সমীকরণ দৃশ্যমান হলো তা অভিনব না হলেও রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। দুই পক্ষেই জোট ভারী করার প্রবণতা লক্ষণীয়। বিরোধী শক্তি গণতন্ত্রের সংগ্রামে তাদের ছোটখাটো ব্যবধান ও বিচ্যুতি ঘুচিয়ে দিয়ে এক হতে পেরেছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এটি একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, জনগণের সম্মিলিত সংগ্রাম কখনো ব্যর্থ হয় না। আপাত অসুবিধা হলেও এদের আন্দোলন-সংগ্রাম চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com