নির্বাচন খেলার আরেক দিক
- আবু সালেহ আকন ও মনির হোসেন
- ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ১১:৫২
দেশে অহেতুক ধরপাকড়ে নির্বাচনী পরিবেশ বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। তফসিল ঘোষণার পরও এই গ্রেফতার অব্যাহত থাকায় নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নিয়েও এরই মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে। এদিকে বেপরোয়া গ্রেফতারে জেলখানার পরিবেশও ভারী হয়ে উঠেছে। জেলখানায় ধারণক্ষমতার তিন গুণেরও বেশি বন্দী অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।
এক দিকে গায়েবি মামলা, অন্য দিকে একের পর এক গ্রেফতার। পুরনো মামলাতো রয়েছেই; নতুন করে সারা দেশে যে কয়েক হাজার মামলা হয়েছে ওই মামলার সূত্র ধরে এখন অভিযান চালাচ্ছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গ্রেফতার হচ্ছেন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীরা। ঘরবাড়িতে এখনো অবস্থানের মতো সুযোগ নেই তাদের। পিরোজপুরের যুবদল নেতা কামরুল বলেন, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও গ্রেফতার অভিযান বন্ধ হয়নি। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মামলার কারণে। তার বিরুদ্ধে ২০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। কামরুল বলেন, ভেবেছিলাম তফসিল ঘোষণার পর পুলিশ একটু সংযমী হবে। এখন দেখি আরো বেপরোয়া।
মহানগর বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা মোশাররফ জানান, এখনো মামলা হচ্ছে। গ্রেফতার তো চলছেই। ভয়ে বাসায় ঘুমাতে পারেন না। রাস্তায় নামলেই ভয় হয় কখন গ্রেফতার হয়ে যান। তিনি বলেন, এই আতঙ্ক নিয়ে দলের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। মোশাররফের আশঙ্কা এখন দলীয় কাজে রাস্তায় নামলেই পুলিশ তাদের গ্রেফতার করবে। সিদ্দিক নামের এক বিএনপি কর্মী বলেন, পুলিশ এখনো যেভাবে আক্রমণাত্মক ও মারমুখো তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তাদের শঙ্কা রয়েছেই। তিনি বলেন, পুলিশ এভাবে আচরণ করলে নির্বাচনী প্রচারাভিযানই তো চালানো যাবে না।
শুধু গ্রেফতারই নয়, এই সময়ে শ্যোন এরেস্ট ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি এক যুবদল নেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করার পরে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তাকে আরো পেন্ডিং মামলায় শ্যোন এরেস্ট দেখানো হয়। পল্টন থানায় গ্রেফতার ওই বিএনপি নেতাকে আবারো রিমান্ডের আবেদন জানানো হয় বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, গত এক সপ্তাহে প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকের বাড়ির সামনে প্রতিদিনই পুলিশ যাচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় পুলিশ গ্রেফতারের নামে সামারি করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। টাকার জন্য অনেক পুলিশ সদস্য নেতাকর্মীদের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকে এমন ঘটনাও ঘটছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তি কিভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন! তিনি বলেছিলেন, ‘নতুন মামলা দেয়া হবে না ও গ্রেফতার করা হবে না’, যেদিন বলেছেন ঠিক সেই রাত থেকেই আরো বেশি মামলা ও গ্রেফতার শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ডা: শফিকুর রহমান গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার হীন উদ্দেশ্যেই পুলিশ অন্যায়ভাবে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে। তিনি বলেন, সারা দেশে জামায়াত ইসলামীর নেতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করার ঘটনায় প্রমাণিত হচ্ছেÑ দেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শুধুই সরকারদলীয় নেতা ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন। তাদের রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় তোরণও নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নামে কোনো একটি পোস্টার, ফেস্টুন বা ব্যানার নেই। ২০ দলীয় জোটের খিলগাঁও এলাকার এক কর্মী বলেন, সম্প্রতি তারা কয়েকটি পোস্টার লাগিয়েছিলেন। লাগিয়ে বাসায় ফিরতে পারেননি; এরই মধ্যে পুলিশ পাঁচজনকে রাস্তা থেকে আটক করে নিয়ে যায়। ওই কর্মী বলেন, এই পরিস্থিতির মধ্যে কে পোস্টার লাগাতে যাবে?
একাধিক সূত্র বলেছে, নয়াপল্টন এলাকা বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট নেতাকর্মীদের পদচারণায় কিছুটা আনন্দময় হয়ে ওঠলেও সবাই ভয়ে থাকেন। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা দিনভর উপস্থিত থাকলেও তারা কার্যত পুলিশ ও গোয়েন্দাদের নজরদারির মধ্যেই থাকেন। লিঙ্কন নামের এক যুবদল কর্মী বলেন, মনে হয় পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে আছি। পুলিশ আগের মতোই সরঞ্জামাদি নিয়ে সকালেই উপস্থিত হয়ে যায়। ২৪ ঘণ্টাই তারা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে থাকে।
এ দিকে, বেপরোয়া গ্রেফতারে কারাগারেও বন্দীদের ত্রাহী অবস্থা। তাদের সাথে দেখা করতে গিয়েও নাজেহাল ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন স্বজনরা।
কেরানীগঞ্জের নতুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক নানা পেশার বন্দীর সাথে সাক্ষাৎ করে ফেরার পথে স্বজনরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও কারাগার সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে পুরান ঢাকার চকবাজার থানা এলাকার বাসিন্দা দুই আসামির সাথে স্বজনরা দেখা করতে যান। সাধারণ সাক্ষাৎ কক্ষে দেখা করে তারা কারাগার এলাকার বাইরে যাওয়া মাত্র সাদা পোশাকের পুলিশ তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। সেখানে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা আটক রাখার পর টাকার বিনিময়ে তাদের মুক্তি মেলে। শুধু ওই দু’জন নন, প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যার কারণে রাজবন্দীর স্বজনরা কারাগারের বাইরে গ্রেফতার হতে পারেন এমন আতঙ্কে আপাতত দেখা-সাক্ষাৎ করতে না যাওয়ার মনোভাবে আছেন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তার সাথে গতকাল রাতে এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, কারাগারের বাইরে কে বা কারা বন্দীর স্বজনদের আটক করছেন সেটি আসলে তাদের জানা নেই। তা ছাড়া এটা তাদের বিষয়ও না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সম্প্রতি ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানে বেশি ধরা পড়ছেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। আর যারা ধরা পড়েনি তাদের বেশির ভাগ হয় এলাকা ছাড়া নতুবা গা ঢাকা দিয়ে আছেন।
আদালত প্রতিবেদক জানান, প্রতিদিন গড়ে বিভিন্ন থানায় গ্রেফতার লোকদের মধ্যে তিন শতাধিক আসামিকে আদালতের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হচ্ছে।
কারাগার সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা প্রায় তিন হাজার ৭০০। হঠাৎ করে বন্দীদের চাপ বাড়ায় কারা কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা হিমশিম খাচ্ছেন। সর্বশেষ গত রোববার পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রায় ১২ হাজার বন্দী অবস্থান করছিলেন, যা ধারণক্ষমতার তিন গুণেরও বেশি। এ অবস্থায় কারাগারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিডিআর বিদ্রোহ মামলা ও রাজনৈতিকসহ অন্যান্য মামলার আসামি মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার বন্দীকে শুক্র ও শনিবার কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। তারপরও কারাগারে গতকাল পর্যন্ত ১১ হাজারের মতো বন্দী রয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও কারা সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্মাণাধীন আরপি গেটের সামনে এক বন্দীর স্বজন গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, কারাগার এলাকা থেকে সন্দেহজনক কেউ বের হলেই কখনো সিএনজি আবার কখনো মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যেতে তারা দেখেছেন। তবে তারা কারা, সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানাতে পারেননি। এমন ঘটনা সর্বশেষ তিনি কবে দেখেছেন জানতে চাইলে বলেন, আমার জানা মতে ‘গত মাসে দেখেছিলাম’। তবে বিস্তারিত খবর তিনি আগামীকাল দিতে পারবেন বলে জানান।
এ দিকে পুরান ঢাকার চকবাজার থানাধীন নাজিমুদ্দিন রোড সংলগ্ন একটি এলাকার দুই যুবককে সম্প্রতি পুলিশ রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার করে। পরে তাদের দু’জনকে আদালতের নির্দেশে পাঠানো হয় কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বর্তমানে তারা সেখানেই আছেন।
তিন দিন আগে তাদের সাথে কারাগারে দেখা করতে যান তাদের দুই আত্মীয়। তারা কারাগারে বিনা স্লিপে টিকিট কেটে সাধারণ কক্ষে সাক্ষাৎও করেন। প্রয়োজনীয় খাবারও দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর তারা কারাগার এলাকা থেকে বের হয়ে নির্মাণাধীন মূল গেটের সামনে থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়ির অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় সাদা পোশাকের পুলিশ বিএনপির নেতাকর্মী পরিচয় দেয়ায় তাদের গাড়িতে তুলে একটি ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের পাঁচ-ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে রফাদফার পর ওই রাতে ছেড়ে দেয়।
পুলিশের হাতে আটক বন্দীর এক স্বজন গতকাল এ প্রতিবেদকের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভাই-ব্রাদাররা রাজনীতি করে। করতেই পারে। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেছে। আদালত তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমরা যদি তাদের স্বজন হই, তাহলে কারাগারে দেখা করতে যাওয়াও কি আমাদের অপরাধ?
কী সমস্যা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিন দিন আগে আমার দুই আত্মীয়কে পুরান ঢাকা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তাদের সাথে কারাগারে আমরা দেখা করে বাড়ি ফিরছিলাম। কারাগার গেটের বাইরে আসামাত্রই ফারুক নামের এক পুলিশ কনস্টেবল আমাদের দু’জনকে ধরেই বলে ‘তোরা বিএনপি করছ, গাড়িতে উঠ, বলেই নিয়ে যায়। কী আর করা। একটা ফাঁড়িতে আমরা দু’জনে রাত ৮টা পর্যন্ত বসে থাকি। পরে ১০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পাই। এই অবস্থা হলে আমরা কিভাবে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের দেখতে যাবো? তিনি বলেন, পুলিশ যে ফাঁড়িতে নিয়ে যায় সেটির নাম জানি না। তবে একজন পুলিশের নাম বলতে পারি। তার নাম ফারুক। তিনি পুলিশ কনস্টেবল। তাদের যেখানে বসিয়ে রাখা হয় সেখানে আরো একজনকে ধরে নিয়ে যায়। তার সাথে কী হয়েছে তা আর তিনি বলতে পারেননি।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসির কাছে এ বিষয়টি জানার জন্য গত রাতে একাধিকবার টেলিফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।