খাশোগি হত্যাকাণ্ড এবং পাকিস্তান-সৌদি সম্পর্ক
- হামিদ মীর
- ০৬ নভেম্বর ২০১৮, ১২:১১
আরববিশ্বের বিদগ্ধ জ্ঞানতাপস, প্রফেসর মুহাম্মদ সাঈদ রমজান আলবুতি আল্লামা ইকবালকে বেশ ভালোবাসতেন। সিরিয়ার দামেশক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর রমজানের কাছে ইকবাল এমন এক মুরশিদে কামেলের মর্যাদা রাখতেন, যার কাব্যিক ছন্দে বাদশাহ ও আমিরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পয়গাম ছিল। তার সাথে ইকবালের প্রথম পরিচয় হয়েছিল কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানকার শিক্ষকদের মধ্যে প্রাচ্যের কবির উর্দু-ফার্সি রচনার আরবি অনুবাদ বেশ জনপ্রিয় ছিল। আল্লামা ইকবালের কাব্যের আরবি অনুবাদ মিসরের ডক্টর আবদুল ওয়াহহাব গাদ্দাম শুরু করেছিলেন। এরপর আল্লামা আবুল হাসান আলি নদভি এ ধারাকে সামনে এগিয়ে দেন।
আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অন্ধ শিক্ষক আসসাবি শালান শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়ার এত মনোরম অনুবাদ করেন যে, বিখ্যাত আরব গায়িকা উম্মে কুলসুমের কণ্ঠে এ অনুবাদ পুরো আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। রমজান আলবুতি ১৯৭৩ সালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল- ইকবালের সাথে একটি রাত। ওই প্রবন্ধে তিনি রাতভর ইকবালের সাথে একটি কাল্পনিক ভ্রমণ করেছেন। ওই ভ্রমণে তিনি হেজাজ-ইয়েমেন হয়ে স্পেনের কর্ডোভা মসজিদে পৌঁছেন। আর সুবহে সাদিকের সময় ইকবাল ফিলিস্তিনি আরবকে লক্ষ করে বলেন- ‘সময় এখনো যার জ্বালা থেকে মুক্ত হয়নি/আমি জানি, সে আগুন তোমার মাঝেও বিরাজমান!/ তোমার প্রতিকার নেই জেনেভায়, নেই লন্ডনে/ ইংরেজের প্রাণকোষ রয়েছে ইহুদির থাবার মাঝে!/ শুনেছি আমি, গোলামি থেকে উম্মাহর মুক্তি/ খুদির (আত্মমর্যাদা) লালন ও অনুধাবনের মাঝে বিদ্যমান!’
আলবুতির কাছে ইকবালের খুদিদর্শন ও জনগণের রাজত্বের সেøাগান ছিল সাম্প্রদায়িকতার আঘাতে জর্জরিত মুসলমানদের জন্য বিপ্লবের পয়গাম। তিনি আরব যুবকদের মাঝে ইকবালের মর্দে মুমিন তালাশ করেছেন এবং তাদের বাদশাহদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সবক দিয়েছেন। ২০১৩ সালে ইকবালের এ ভক্ত দামেশকের একটি মসজিদে বক্তৃতা করছিলেন। ওই সময় এক আত্মঘাতী হামলাকারী সেখানে আসে এবং সে বিস্ফোরণের মাধ্যমে এই ইকবালভক্তের আওয়াজ থামিয়ে দেয়। অবশ্য এ আওয়াজ অন্য মানুষের মধ্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাদেরই একজন ছিলেন জামাল খাশোগি।
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিও সাঈদ রমজান আলবুতির মতো স্বাধীন মতপ্রকাশ ও জনগণের রাজত্বের সমর্থক ছিলেন। তিনি ছিলেন রাজতন্ত্রের বিরোধী। সৌদি আরবে যখন তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো, তখন তিনি দেশান্তরী হয়ে গেলেন। তিনি আমেরিকা চলে যান এবং ওখানে ওয়াশিংটন পোস্টে কলাম লেখা শুরু করেন। তিনি সৌদি আরবের প্রতি বিদ্রোহী ছিলেন না। বরং তিনি সৌদি শাসকদের কাছে সে অধিকার চেয়েছিলেন, যা জাতিসঙ্ঘের সব সদস্য দেশ নিজের নাগরিকদের প্রদানের প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। সৌদি সরকারের কিছু শক্তিধর ব্যক্তির কাছে খাশোগির এ ‘ধৃষ্টতা’ মোটেও পছন্দ হয়নি। তারা খাশোগিকে ‘রাষ্ট্রের শত্র“’ এবং তাকে হত্যা করা অপরিহার্য বলে অভিহিত করে।
এরপর রাষ্ট্রের ওই রক্ষকেরা খাশোগির সাথে সেই হত্যার খেলা খেলেছে, যা পুরো বিশ্বে সৌদি আরবের মর্যাদাকে টুকরা টুকরা করে দিয়েছে। বাদশাহর বিরুদ্ধে সমালোচনাকারী সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ডের পর বাদশাহ দৃষ্টি নত করে ব্যাখ্যা পেশ করছেন। কেউ যদি শিখতে চান, তাহলে একজন সাংবাদিকের এ হত্যার মাঝে এ শিক্ষা নিহিত রয়েছে যে, আপনি একজন সাংবাদিককে হত্যা করতে পারবেন, তবে ওই সত্যকে হত্যা করতে পারবেন না, যা গোপন করা আপনি ‘রাষ্ট্রের স্বার্থের দাবি’ বলে অভিহিত করেন।
সাংবাদিকের হত্যায় রাষ্ট্রের কোনো উপকার তো নেই-ই, বরং এতে রাষ্ট্রের ক্ষতিই হয়। ২৩ অক্টোবর সৌদি সরকার রিয়াদে একটি আন্তর্জাতিক পুঁজি বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। ওই সম্মেলনে যে সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বক্তৃতা করছিলেন, ঠিক ওই মুহূর্তে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার পার্লামেন্টে জামাল খাশোগির হত্যার দায় সৌদি আরবের ওপর আরোপ করছিলেন। আর সৌদি সরকার এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, জামাল খাশোগিকে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসুলেটে হত্যা করা হয়েছে।
ওই হত্যার কারণে বিশ্ব মিডিয়াতে এতটাই হইচই শুরু হয় যে, বেশ কিছু বড় বিনিয়োগকারী সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত সে সম্মেলনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ত্যাগ করেছে। সৌদি সরকার জামাল খাশোগির হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে তার বন্ধুরাষ্ট্রদের। সবচেয়ে বেশি বিপদ ছিল পাকিস্তানের। একদিকে সৌদি আরব, অপর দিকে তুরস্ক। উভয় দেশই পাকিস্তানের বন্ধু। আমরা সৌদি আরবের শান্তি ও নিরাপত্তা কামনাকারী। আবার পাকিস্তানের প্রতি তুরস্কের জনগণের ভালোবাসাও প্রত্যাখ্যান করা যায় না- এমন বাস্তব সত্য। তবে এ সত্যও অস্বীকার করা যায় না, এক দিকে তুরস্ক সরকার জামাল খাশোগির হত্যার নিন্দা করছে, অপর দিকে সাংবাদিকদের সব আন্তর্জাতিক সংগঠন তুরস্ককে ‘সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বড় কারাগার’ বলে অভিহিত করছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও জামাল খাশোগির হত্যার নিন্দা করেছেন, অথচ এ ট্রাম্পকে আমেরিকায় স্বাধীন সাংবাদিকতার ‘সবচেয়ে বড় শত্র“’ মনে করা হয়। সৌদি আরবে গণতন্ত্র নেই, আছে রাজতন্ত্র। আর বাদশাহর মোসাহেবরা তাদের সমালোচকদের সাথে সেই আচরণই করে থাকেন, যা খাশোগির সাথে করা হয়েছে। কিন্তু আমেরিকা, তুরস্ক, ভারত, ইরান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে গণতন্ত্র রয়েছে। এসব দেশে সাংবাদিকদের কণ্ঠ কেন চেপে ধরা হয়? পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সাংবাদিকদের হত্যা করা হয় কেন? জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড পুরো বিশ্বকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে। স্বাধীন মতপ্রকাশের নিরাপত্তার জন্য সারা বিশ্বের সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলো এক হচ্ছে।
ট্রাম্প ও এরদোগান মনে রাখবেন, একজন সাংবাদিকের হত্যার পর প্রকাশিত প্রতিক্রিয়া সৌদি আরবের শক্তিধর বাদশাহর মাথা নত করে দিয়েছে, কাল আপনাদের অহঙ্কার ও ক্ষমতাও মাটির সাথে মিশে যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কাছে আবেদন, তুরস্কে বন্দী অসংখ্য সাংবাদিককে অবিলম্বে মুক্তি দিন। সাংবাদিকদের কারাগারে নিক্ষেপ, টিভি চ্যানেল বন্ধ করা বা সাংবাদিকদের চাকরি থেকে বহিষ্কার করার দ্বারা রাষ্ট্র সুদৃঢ় হয় না, বরং দুর্বল হয়ে পড়ে। আমাকে এক হিতাকাক্সক্ষী বলেছেন, জামাল খাশোগির হত্যার পর সৌদি সরকারকে সমালোচনার লক্ষ্য বানানোর মধ্যে পাকিস্তানের কোনো জাতীয় স্বার্থ নিহিত নেই। কেননা, সৌদি সরকার এমন বিপদের মুহূর্তেও পাকিস্তানকে তিন বছরের জন্য তেল ঋণ দিতে সম্মতি প্রকাশ করেছে। এ অধম তার হিতাকাক্সক্ষীকে বলেছে, আমি একজন পাকিস্তানি হিসেবে সৌদি সরকারকে অনেক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
কিন্তু এটাও জানি যে, আমার দেশ এ সহযোগিতা বিনামূল্যে পাচ্ছে না। এ সহযোগিতার বিনিময়ে আমাদের কাছ থেকে যে সেবা নেয়া হচ্ছে, তা পাকিস্তানের বিপদ হ্রাস নয়, বরং বৃদ্ধির কারণও হতে পারে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এই ঝুঁকি এ জন্য নিয়েছেন, সৌদি আরব কখনো বন্ধু হয়ে আমাদের পিঠে খঞ্জর বিদ্ধ করেনি। ওখানকার শাসনপদ্ধতি এবং অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা তাদের ব্যাপার। কিন্তু আমরা তো ইকবালের ভক্ত। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও ইকবালকে তার ‘মুরশিদ’ বলে আখ্যায়িত করেন। সুতরাং আমাদের বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্কের মাঝে ওই প্রশস্ততা নজরে আসা উচিত, যা আলবুতি ইকবালের চিন্তাধারার মাঝে দেখতে পেয়েছিলেন। সৌদি আরবে সফল সফরের জন্য প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে মনে রাখবেন- দুটি মুসলিম দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে আমাদের কোনো পক্ষ না নিয়ে আপস-মীমাংসাকারী হওয়া উচিত। আমাদের সৌদি আরবের পাশাপাশি ইয়েমেন, তুরস্ক, ইরান ও আফগানিস্তানকেও সাথে নিয়ে চলা উচিত।
হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৫ অক্টোবর, ২০১৮ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com