০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১,
`

তারল্য সঙ্কট, হাজার টাকার নোট বাতিলের প্রশ্ন

- প্রতীকী ছবি

তারল্য সঙ্কট বলতে নগদ অথবা নগদ সমতুল্য টাকার সঙ্কট বোঝায়। তারল্য সঙ্কট মানে দেশে নগদ টাকার সঙ্কট নয়; বরং ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সিয়াল চ্যানেলে নগদ টাকার সঙ্কট। বর্তমানে দেশের অনেক ব্যাংকে তারল্যের বেশ সঙ্কট রয়েছে। বিশেষ করে বিতাড়িত স্বৈরশাসকের অন্যতম অলিগারক এস আলমের দখলকৃত সাতটি ব্যাংকে। এ সঙ্কট অনেক দিন আগে থেকেই থাকলেও স্বৈরসরকারের উচ্চমহলে লুটের টাকার বেনিফিসারি থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে এ ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার টাকা ছাপানো বন্ধ করায় তারল্য সঙ্কট মোকাবেলায় সাপোর্ট দেয়ার সুযোগ অনেকটা কমে গেছে।

উল্লেখ্য, স্বৈরসরকারের ১৫ বছর মেয়াদে দুর্নীতি কেবল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নয়; বরং রাষ্ট্রীয় রূপ ধারণ করেছিল। কোনো হিসাব-নিকাশের তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ কোটি টাকা ছাপিয়েছে। এমনকি বিতাড়িত হওয়ার ক’দিন আগেও ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়। প্রশ্ন হলো- এত টাকা ছাপানোর পরও তারল্য সঙ্কট কেন? দুর্নীতিবাজরা তো আর দেশীয় মুদ্রা বিদেশে পাচার করতে পারে না। এ কথা সত্যি, টাকা পাচার হয়নি। তবে টাকা ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে বেরিয়ে দুর্নীতিবাজদের ভল্টে স্থান পেয়েছে। ভল্টের এই টাকাগুলো ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা এবং দুর্নীতিবাজদের কালো টাকা খুঁজে বের করার জন্য হাজার টাকার নোট বাতিল করার প্রসঙ্গ আসে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার শুরু থেকেই। আসুন দেখি এই নোট বাতিল করার সুবিধা-অসুবিধা কী এবং নোট বাতিল করা প্রয়োজন আছে কি না।

বাংলাদেশে কাগুজে নোট প্রচলনের ইতিহাস
বাংলাদেশে প্রথম কাগুজে নোট চালু করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে, এক টাকা ও ১০০ টাকার নোট চালু করার মধ্য দিয়ে। পর্যায়ক্রমে পাকিস্তানি রুপি অচল করে প্রথমে ৫০ রুপি এবং পরে ৫ ও ১০ রুপি বাতিল হয়। আরো পরে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানি এক রুপি ও দুই রুপির নোট অচল ঘোষণা করে নতুন টাকা ছাপানো হয়। স্বাধীনতার পর ভারত থেকে ছাপানো বাংলাদেশের টাকার নোটগুলোয় নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের ঘাটতি থাকায় ব্যাপক হারে জাল মুদ্রা ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে ভারতের ছাপানো বিভিন্ন ব্যাংকনোট আবার অচল ঘোষণা করা হয়।

পরে বাংলাদেশে প্রচলিত ১০০ টাকার নোট ইংল্যান্ড থেকে ছাপিয়ে এনে প্রচলন করা হয় ১৯৭২ সালের ১ সেপ্টেম্বর। সেই নোটও পরে অচল করা হয়েছিল মুদ্রাস্ফীতির চাপ সামলানোর জন্য। অন্য দিকে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সঙ্কট এবং উন্নত দেশগুলোতে প্রধানত তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে টাকার মূল্য আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পায় এবং দেশে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। বছরের প্রথম দিকে ব্যাপক হারে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতার কারণে আমদানি হ্রাস, বন্যার ফলে সৃষ্ট খাদ্য ঘাটতি, অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যাংকঋণের ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমাবনতির দিকে ধাবিত হয়।

এ ছাড়াও মূল্যস্ফীতিজনিত মুনাফা অর্জনের প্রত্যাশায় দেশে ব্যাংকঋণের একটি অংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য মজুদের কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। অনুৎপাদনশীল খাত এবং ফটকা ব্যবসায়ে ব্যাংকঋণের ব্যবহার বন্ধ করে উৎপাদনের ক্ষেত্রে অধিক হারে ঋণ জোগান দেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৭৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে পর্যায়ক্রমে কতিপয় বিশেষ ঋণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। একই উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানো হয়েছিল। স্বাধীনতার পর থেকে ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংকের সুদের হার অপরিবর্তিত ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ব্যাংকঋণ ও অর্থ সরবরাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।

১০০ টাকার নোট বাতিলের অভিজ্ঞতা
সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্য রেখে দেশের অর্থনীতিতে একটি সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন সাধনের উদ্দেশ্যে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শক্রমে ১৯৭৫ সালের ৭ এপ্রিল ইতঃপূর্বে প্রচলিত সব ১০০ টাকার নোট অচল ঘোষণা করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটিই ছিল কালো টাকা প্রতিহত করার প্রথম ও সবচেয়ে জোরালো পদক্ষেপ। সরকার এরপর তিন দিন অর্থাৎ ৭, ৮ ও ৯ এপ্রিল ১০০ টাকার নোট জমা দেয়ার সময় বেঁধে দেয়। এই তিন দিন ট্রেজারি ও ব্যাংক আর কোনো কাজ না করে কেবল ১০০ টাকার নোট জমা নিয়েছে। এমনকি ওই সময় ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। কোনো ট্রেন সীমান্তবর্তী স্টেশনে থামবে না বলেও নির্দেশ দেয়া হয়। এরপরের নির্দেশনা ছিল, ১২ এপ্রিল শনিবার জমা করা ১০০ টাকার যেকোনো সংখ্যক নোটের পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা ফেরত দেয়া হবে। এমনকি ৫০০ টাকা পর্যন্ত যারা অর্থ জমা দিয়েছেন, তাদেরও ৩০০ টাকা ফেরত দেয়া হবে। পরে অবশ্য ফেরত দেয়া অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়।

মুদ্রাস্ফীতির চাপ প্রশমিত করা ও অর্থনীতিতে কালো ও বাড়তি টাকার অশুভ প্রভাব দূর করার উদ্দেশে ১০০ টাকার নোট অচল করায় জনগণ সাময়িক অসুবিধায় পড়ে। তার পরও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ার ফলে সরকারের এই প্রচেষ্টা সফল হয়। চোরাকারবারি ও কালোবাজারি বহু লোকের অসদুপায়ে অর্জিত টাকা আটকা পড়ে। জনসাধারণের সুবিধার জন্য সরকার ৮০০ টাকা পর্যন্ত জমাদানকারীকে আংশিক নগদ ও অবশিষ্ট টাকা পাঁচ থেকে সাত বছর মেয়াদি বার্ষিক ৮ শতাংশ সুদসহ ঋণপত্রের মাধ্যমে পরিশোধ করে। সরকারের এই সুচিন্তিত ব্যবস্থার ফলে মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস পায় এবং জিনিসপত্রের মূল্যের ওপর এর কিছুটা শুভ প্রভাব পড়ে।

অবশ্য ২০১৬ সালের নভেম্বরে ভারতে মোদি সরকারের ৫০০ ও এক হাজার রুপির নোট বাতিল করার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। ওই কর্মসূচি তেমন সফল হয়নি। পরে আবারো ভারত প্রত্যাহার করে নিলো দুই হাজার রুপির নোট। কিন্তু সে দেশে কালো টাকার প্রসার কমেনি; বরং বেড়েছে। এর পরের ইতিহাস হচ্ছে- ভারতে কেবলই কালো টাকার প্রসার ও কালো টাকার মালিকদের সুযোগ দেয়ার ইতিহাস।

বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে টাকা অচল করা প্রসঙ্গ
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও নেতাদের বাড়ি থেকে নগদ টাকা উদ্ধারের পরিপ্রেক্ষিতে ৫০০ ও এক হাজার টাকার নোট বাতিলের প্রসঙ্গ আসে। এসব নোট বাতিল হলে লুকানো টাকাগুলো ব্যাংকে ফেরত আসবে এবং ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট নিরসনে ভ‚মিকা রাখবে বলে অনেকে মনে করছেন। এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘এগুলো নিয়ে হ্যাঁ বা না কিছু বলাই ঠিক না; এটি থাক; এটি কোনো অসুবিধা হচ্ছে না; সহজে এগুলোর সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরও বলেন, ‘নোট বাতিলের অভিজ্ঞতা ভালো নয়’। ভারতের ২০১৬ সালের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেখানে ৯৮ শতাংশ টাকা আবার ফেরত এসেছে, অর্থাৎ সাদা হয়ে গেল।’

বাংলাদেশে এক হাজার টাকার নোট চালু হয় ২০০৮ সালের ২৭ অক্টোবর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাজারে এক হাজার টাকার নোটের পরিমাণ দ্রæতগতিতে বাড়ছে। ২০১১ সালেও দেশে মোট ব্যাংক নোটের ২৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ ছিল হাজার টাকার নোট। এখন তা দেশের মোট ইস্যু করা নোটের ৫২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। সাথে ৩৮ দশমিক ৮০ শতাংশ ৫০০ টাকার নোট। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট ইস্যুকৃত অর্থের ৯১ শতাংশেরও বেশি উচ্চমূল্যের নোট। ২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক হাজার টাকার নোট ছাপিয়েছে ১৯ কোটি ৩৯ লাখেরও বেশি; প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

বাংলাদেশের মতো একটি অর্থনীতির দেশে ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকার নগদ অর্থ যথেষ্ট। ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ১০-১২ শতাংশ নগদ হিসেবে বাজারে থাকাই যুক্তিযুক্ত মনে করেন তারা। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের প্রায় ১৮ শতাংশ বাজারে নগদ অর্থ হিসেবে আছে।

বড় টাকার নোটের সুবিধা ও অসুবিধা দুই-ই আছে। বাংলাদেশে এখন মূল্যস্ফীতি যে পর্যায়ে রয়েছে তাতে এক হাজার টাকার নোট স্বাভাবিক। তবে সমস্যা হচ্ছে বড় নোট থাকায় চোরাচালান, অর্থ পাচার, অবৈধ লেনদেন সুবিধাসহ নানা অবৈধকাজে তার ব্যবহার বেড়ে যায়। আবার এই বড় নোট জালও হয় বেশি। এ ছাড়া বড় নোট ব্যাংকের বাইরে জমিয়ে রাখা হয়। মোট কথা, যারা অনৈতিক কাজ করেন তাদের জন্য বড় নোট আকর্ষণীয়। এ কারণেই হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় বেশি নগদ অর্থ ব্যাংকের বাইরে আছে। আর সেখানে হাজার টাকার নোটই বেশি।

উপসংহারে বলা যায়, কোন দেশের নোট কতটা বড় হবে তা নির্ভর করে সে দেশের মূল্যস্ফীতির ওপর। পাকিস্তান, জিম্বাবুয়েসহ অনেক দেশে বড় নোট আছে। কোথাও ১০ হাজার টাকার নোটও আছে। বড় নোট বহন করাও সহজ। তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় নোট ব্যান্ড করার প্রসঙ্গ আসে। বড় নোট ব্যান্ড করলে পুরো টাকা ব্যাংকে আসে না। কারণ অনেকে কালো টাকা প্রদর্শন করে বিপদে পড়তে চায় না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এক হাজার টাকার নোট বাতিল করতে না চাইলেও দুই হাজার টাকার নোট চালুর চিন্তা আগের সরকার করেছিল সেটি এখন করা ঠিক হবে না। ভারতে দুই হাজার রুপির নোট বাতিল করা হয়েছে। অন্য দিকে এক হাজার টাকার নোটজনিত সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে ক্যাশলেস ট্রান্সজেকশনের ব্যাপক প্রচলন করা যেতে পারে। কিন্তু দেশের স্বল্প এবং নিম্ন আয়ের মানুষ এর সুযোগ কমই নিতে পারবে। তাই কাগুজে নোট পুরোপুরি বিদায় করা যাচ্ছে না।

সুতরাং বড় নোটের অবৈধ লেনদেন, পাচারসহ নানা অনৈতিক কাজে ব্যবহারের ওপর বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পরসহ মোট দু’বার ১০০ টাকার নোট ব্যান্ড করা হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল চোরাচালান ও অবৈধ লেনদেন বন্ধ করা। ওই উদ্দেশ্য পুরোপুরি বিফল হয়েছে বলা যাবে না। তা ছাড়াও সে সময়ের দুর্নীতি এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে থাকা টাকার পরিমাণ এত বেশি ছিল না। সুতরাং ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য অন্তত এক হাজার টাকার নোট বাতিল করা হলে ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের কিছু টাকা অন্তত বাজেয়াপ্ত হবে বলে আশা করা যায়। সেই সাথে ব্যাংকের প্রতি জনগণের আস্থার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারলে তা তারল্য সঙ্কট মোকাবেলায় ভ‚মিকা রাখবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
Mizan12bd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement