নানা জটিলতায় দেশের অর্থনীতি
- হারুন-আর-রশিদ
- ৩০ আগস্ট ২০১৯, ১৬:৪৫
২৭ জুন ২০১৯ বৃহস্পতিবার দশ দিনব্যাপী মিশন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক দাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত এগোচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু দেশের ব্যাংক খাতে কোনো উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে না। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করছে। এ ছাড়া রাজস্ব আয় বাড়ানোর ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা দেশের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডাইসাকু কিহারার নেতৃত্বে আইএমএফের আর্টিক্যাল-৪ এর ছয় সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদল ১৬-২৭ জুন ২০১৯ পর্যন্ত ঢাকা সফর করে। এ সময় তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, অর্থসচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও একাধিক সংসদ সদস্যের সাথে বৈঠক করেন। ডাইসাকু কিহারা বলেন, অর্থনীতি এগোলেও ব্যাংকিং খাতে ধস নেমেছে। এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। খেলাপি ঋণ কমাতে সময় বেঁধে কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। ব্যাংকিং সুপারভিশন বাড়াতে হবে, খেলাপিদের আইনি সহায়তা বন্ধ করতে হবে। ঋণখেলাপিদের পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন নীতিমালা আরো কঠোর করা দরকার। সর্বক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে সংস্কারের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়াতে হবে। বাজেটে আয়, ব্যয় ও ঘাটতি- এ তিনটি খাতে সমন্বয় সাধন করতে হবে। প্রতি বছরই বাজেটে ঘাটতির অঙ্ক বাড়ছে। সেহেতু রাজস্ব নীতিতে সংস্কার প্রয়োজন। এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আধুনিকায়ন করতে হবে। অন্য দিকে ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সরকার সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। সরকারি বিনিয়োগে অপচয় রোধ করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাতীয় পরিকল্পনার আলোকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে হবে, দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে বাজেট নীতি ও মুদ্রানীতিতে যেকোনো ধরনের সংস্কারে নীতিগত ও কৌশলগতভাবে সহায়তা করবে আইএমএফ।
খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপিদের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা দিতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে বিষয়টির ওপর দ্বিতীয় দফা স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এ আদেশ দুই মাসের জন্য স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী এ সংস্থাটি।
১৩ জুলাই ২০১৯ জাতীয় দৈনিকে লিড নিউজ ছাপিয়েছে, দেশে মোট কত টাকা আছে এই নামে। ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ১১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাই ঋণ নিয়েছেন ১০ লাখ ৯১৮ কোটি টাকা। টাকা ফেরত না দেয়ায় খেলাপি দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। এ ছাড়া সরকারও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে রেখেছে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। আবার ব্যাংকগুলোতে এপ্রিল পর্যন্ত গ্রাহকদের আমানত রাখা আছে ১০ লাখ ২৬ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। তাহলে প্রশ্ন জাগে, দেশে মোট কত টাকা আছে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যমানের কাগজে নোট ও ধাতব মুদ্রা রয়েছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই পাঁচ শ’ ও এক হাজার টাকার কাগজে নোট। বাকিগুলো ১০০ টাকা, ৫০ টাকা, ২০ টাকা ও ১০ টাকার কাগজে নোট। এ ছাড়াও এই হিসাবের মধ্যে রয়েছে পাঁচ টাকা, দুই টাকা ও এক টাকার কাগজে নোট ও ধাতব মুদ্রা। এমনকি ৫০ পয়সা, ২৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ৫ পয়সা ও এক পয়সার মুদ্রার হিসাবও এর মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিতে এগুলো ‘মানি’। এর নাম ‘রিজার্ভ মানি’, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই রিজার্ভ মানি বা মানি সাপ্লাই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা থেকেই ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা পরিচালনা করছেন। গার্মেন্ট ব্যবসা চলছে। স্বর্ণের ব্যবসা হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবসা চলছে। এই টাকা থেকেই সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস হচ্ছে। দেশের সব ধরনের শিল্পকারখানা চলছে, মুদি দোকান চলছে। আমদানি-রফতানি হচ্ছে। চাল-ডাল কেনা হচ্ছে। এই টাকা থেকেই মানুষ বিভিন্ন স্থানে ঘুরছে-ফিরছে, বিনোদন করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বলেছেন, দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি থেকে ১০ লাখ কোটি টাকা ঋণ দেয়া সম্ভব হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ১০০ টাকা কেউ ব্যাংকে জমা রাখলে ব্যাংক ওই ১০০ টাকা থেকে ১০ টাকা রেখে অবশিষ্ট ৯০ টাকা আরেকজনের কাছে ঋণ দিচ্ছে। আবার যিনি ৯০ টাকা ঋণ নিলেন, তিনি কিছু টাকা তুলে অথবা ৯০ টাকাই অন্য ব্যাংকে জমা রাখছেন। সেই ব্যাংক আবার আট টাকা জমা রেখে বাকি টাকা আরেকজন গ্রাহককে ঋণ দিচ্ছে। এভাবে ১০০ টাকা হাতবদল ও ব্যাংক বদলের মধ্য দিয়ে এক হাজার টাকায় পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ‘মানি’কে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করেছে: ‘ন্যারো মানি’ ও ‘ব্রড মানি’। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত মে মাস ২০১৯ পর্যন্ত ব্রড মানির পরিমাণ এক কোটি ২০ লাখ ৫১ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। সাধারণত মানুষের কাছে যে কারেন্সি থাকে (কারেন্সি ইন সার্কুলেশন) তাই মুদ্রা। মানুষের হাতের টাকা দিয়ে দৈনন্দিন খরচ করা হয়, প্রয়োজনীয় লেনদেন চলে। এর বাইরে আরো মুদ্রা জমা থাকে ব্যাংকে, যাকে ব্যাংকারেরা ডিপোজিট বা আমানত বলে থাকেন। এটাও মুদ্রা। মুদ্রা আবার দুই প্রকারের হয়। ১০ থেকে এক হাজার টাকার নোটকে বলা হয় ব্যাংক কাগজে মুদ্রা। আর ১ পয়সা থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত নোট ও ধাতব মুদ্রাকে বলা হয় সরকারি মুদ্রা। (তথ্যসূত্র : দৈনিক ইনকিলাব, ১৩-০৭-২০১৯)।
এনবিআরের রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ৭৯ ব্যক্তির কাছে এনবিআরের রাজস্ব পাওনা তিন হাজার ৭২২ কোটি টাকা। ১২৪ প্রতিষ্ঠানের কাছে এনবিআরের পাওনা ২৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৭৯ ব্যক্তির প্রত্যেকেই ব্যবসায়ী। তাদের পরিবারের একাধিক সদস্যও দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন ব্যবসা করছেন। গত পাঁচ বছরে ৭৯ জনকেই বকেয়া পরিশোধে তাগাদা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ জনকে ২০ বার করে ১০ জনকে ১৬ বার, অন্যদের ১৪ বারের কম চিঠি দেয়া হয়েছে। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ৭৯ জনই পাওনা রাজস্বের অতি সামান্য কিছু অর্থ এনবিআরের কোষাগারে জমা দিয়ে আবারো সময় নিয়েছেন। এভাবে বারবার সময় নিয়েও গত পাঁচ বছরে তারা পাওনার ২০ শতাংশও পরিশোধ করেননি। ৭৯ জনের মধ্যে ১৭ জনের হিসাব সাময়িক জব্দ করা হয়। পাওনার অতি সামান্য দিয়ে হিসাবগুলো আবারো সচল করা হয়। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরা নয়-ছয় করে প্রতি বছর নিয়মিত রিটার্ন জমা দিয়েছেন। বেশির ভাগই রিটার্নে ব্যবসায় লোকসান দেখিয়েছেন। অল্প কয়েকজন সামান্য লাভ দেখিয়েছেন।
এ দিকে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই (২০১৯-২০২০) রাজস্ব আদায়ে কঠোর হচ্ছে এনবিআর। প্রতিটি রাজস্ব দফতরকে প্রতি মাসের জন্য রাজস্ব আদায় ও করদাতা সংগ্রহে পৃৃথক লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয় এনবিআর। এক মাসের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে তা পরের মাসের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার সাথে আদায় করে দিতে হবে। কোনো রাজস্ব দফতর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে এর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে হবে। ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য না হলে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এনবিআরের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী করদাতাকে ভোগান্তিতে ফেললে তাকেও কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। গত ১৬ জুলাই এসব নির্দেশ দিয়ে বিভিন্ন রাজস্ব দফতরে চিঠি পাঠিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি ইবিআইএন (ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর) গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ব্যবসায়ীদের কাছে তুলে ধরতে বলেছেন। বলা হয়, ইবিআইএন না থাকলে কোনো ব্যবসায়ী আমদানি-রফতানি করতে পারবেন না। কোনো টেন্ডারে অংশ নিতে পারবেন না। ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন না। ইএফডি (ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস) যন্ত্র সরবরাহে গুরুত্ব দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ইএফডি সরবরাহে এনবিআর চেষ্টা করছে। মূলত ব্যবসায়ীদের জানাতে হবে, এসব যন্ত্র ব্যবহার অত্যন্ত সহজ। একটি মোবাইল ফোন চালানোর মতোই এসব যন্ত্রের সাহায্যে ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব রাখা যাবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, চলতি অর্থবছরে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বড় অঙ্কের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে এনবিআরকে। তিনি বলেন, আমি আশাবাদী এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। এ জন্য এখন থেকেই বিভিন্ন কৌশল নেয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে ২০১৯-২০২০ এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের (২০১৮-২০১৯) শুরুতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। বড় অঙ্কের ঘাটতিতে এ লক্ষ্যমাত্রা পরে ১৬ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। ঘাটতি বাণিজ্য দেশে প্রবৃদ্ধি অর্জনে যাতে বড় বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে হবে। (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২১-০৭-২০১৯)।
লেখক : গ্রন্থকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা