'দুবাইয়ের শেখ মোহাম্মদ কন্যাদের অপহরণ করেছেন, এবং স্ত্রীকে হুমকি দিয়েছেন'
- ০৭ মার্চ ২০২০, ০৬:৫৬, আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০, ০৭:০৮
দুবাইয়ের শাসক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম বিশ্বব্যাপি পরিচিত তার দেশকে বাণিজ্য ও পর্যটনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর এক শীর্ষস্থানীয় গন্তব্যে পরিণত করার জন্য। শত শত কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক এই ৭০ বছর বয়স্ক শাসক এখন হঠাৎ করেই শিরোনামে এসেছেন লন্ডনের হাইকোর্টের এক রায়ের জন্য।
লন্ডনের হাইকোর্ট বলছে, শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুম তার দুই কন্যাকে অপহরণ করে জোর করে তাদের ব্রিটেন থেকে দুবাইতে নিয়ে গেছেন, এবং তার সাবেক স্ত্রী প্রিন্সেস হায়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ভীতিপ্রদর্শন করে চলেছেন।
হাইকোর্টের এই রায়ের মধ্যে দিয়ে যে সব ঘটনা এখন জনসমক্ষে বেরিয়ে এসেছে তা প্রায় হলিউডের সিনেমার কাহিনীর মতো।
আট মাস আগে শেখ মোহাম্মদের ষষ্ঠ স্ত্রী প্রিন্সেস হায়া বিন্ত আল-হুসেইন এক 'হাই-প্রোফাইল' মামলা করেছিলেন লন্ডনে - তার স্বামীর বিরুদ্ধে অপহরণ, জোরপূর্বক দেশে ফিরিয়ে নেয়া, নির্যাতন এবং ভীতিপ্রদর্শনের অভিযোগ এনে।
এর পর হাইকোর্ট একটি ফ্যাক্টফাইন্ডিং জাজমেন্ট বা এফসিজে প্রকাশ করেছে - যাতে এসব অভিযোগের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শেখ মোহাম্মদ চেষ্টা করেছিলেন এই রায় যেন প্রকাশ্যে না আসে। কিন্তু তার আপিল প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
ঘটনাগুলো কী?
শেখ মোহাম্মদ ২০০৪ সালে বিয়ে করেন জর্ডনের প্রয়াত বাদশা হুসেইনের মেয়ে প্রিন্সেস হায়া বিন্ত আল-হুসেইনকে।
তাদের দুই সন্তান আল-জলিলা ও জায়েদ। প্রিন্সেস হায়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তাদের নিখুঁত পারিবারিক জীবনের ছবি তুলে ধরতেন। কিন্তু ২০১৮ সালে সেই জীবনে ফাটল ধরার খবর বেরুতে শুরু করে।
শেখা লতিফার পালানো ও ধরা পড়া
শেখ মোহাম্মদের অন্য এক স্ত্রীর গর্ভজাত কন্যা শেখা লতিফা দুবার চেষ্টা করেছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাত ছেড়ে পালানোর ।
তিনি তার ফিনল্যান্ডের নাগরিক ফিটনেস ইনসট্রাকটর এবং এক সাবেক ফরাসী গুপ্তচরকে নিয়ে এক নৌকায় করে পালানোর সময় ভারতের উপকুলে ধরা পড়েন। তাদের ধরে আবার আমিরাতে ফেরত পাঠানো হয়।
কিন্তু তার আগে করা এক ভিডিওতে তিনি অভিযোগ করেন, তাকে তিন বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছিল ।
তিনি আরো বলেন, ২০০২ সালেও তিনি একবার পালাবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।
তিনি এখন গৃহবন্দী আছেন বলে শোনা যায়। তবে দুবাই সরকার বলছে, শেখা লতিফা নিরাপদে আছেন।
শেখা শামসার অপহরণ
শেখা লতিফার বড় বোন শেখা শামসা ২০০০ সালে ইংল্যান্ডের সারের পারিবারিক বাসভবন থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু শেখ মোহাম্মদের এজেন্টরা তাকে ক্যাম্ব্রিজশায়ার থেকে ধরে ফেলে, এবং জোর করে তাকে দুবাইতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
সংবাদমাধ্যমে খবর বেরোয় যে তাকে ইনজেকশন দিয়ে এবং ট্যাবলেট খাইয়ে বিমানে ওঠানো হয়। এ ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য ক্যাম্ব্রিজশায়ারের পুলিশের একটি আবেদন প্রত্যাখ্যান করে দুবাই।
লন্ডনের হাইকোর্ট বলছে, ২০০০ সালে শেখা শামসা এবং ২০০২ এবং ২০১৮ সালে শেখা লতিফা - এই দু'জনকেই অপহরণ এবং জোরপূর্বক দেশে ফিরিয়ে নেবার আদেশ দেন শেখ মোহাম্মদ এবং তা বাস্তবায়ন করান।
রায়ে বলা হয়, শেখ মোহাম্মদ এই দুই তরুণীকে এমনভাবে রেখেছেন যাতে তাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
ছেলেমেয়েদের নিয়ে পালিয়েছেন প্রিন্সেস হায়াও
শেখা লতিফা ও শেখা শামসার ঘটনার পর প্রথম দিকে প্রিন্সেস হায়া এ ব্যাপারে সরকারি ব্যাখ্যাকেই সমর্থন করেছিলেন।
কিন্তু ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে তিনি নিজেই ছেলেমেয়েদের নিয়ে জার্মানি হয়ে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান।
শেখ মোহাম্মদের ষষ্ঠ ও 'জুনিয়র' স্ত্রী প্রিন্সেস হায়া জর্ডানের পরলোকগত বাদশা হুসেইনের মেয়ে ও বর্তমান বাদশা আবদুল্লাহর সৎবোন। তিনি পড়াশোনা করেছেন ব্রিটেনের ডরসেটের ব্রায়ানস্টন স্কুলে এবং এর পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জানা যায়, তিনি থাকেন লন্ডনের অভিজাত এলাকা কেনসিংটন প্যালেস গার্ডেনে সাড়ে আট কোটি পাউন্ড মূল্যের একটি বাড়িতে।
তুমি বেঁচে ছিলে, তুমি মরে গেছ'
বিয়ে ভেঙে যাওয়া নিয়ে শেখ মোহাম্মদ নিজে সরাসরি কোন মন্তব্য করেননি।
কিন্তু ইন্সটাগ্রামে তিনি ক্রুদ্ধ ভাষায় লেখা তার একটি কবিতা পোস্ট করেন।
কবিতাটিতে একজন অজ্ঞাতনামা নারীকে 'প্রতারণা এবং বেঈমানির' জন্য অভিযুক্ত করেন শেখ মোহাম্মদ।
কবিতার নাম ছিল 'তুমি বেঁচে ছিলে, তুমি মরে গেছো'
প্রিন্সেস হায়া বলেছেন, ২০১৯ সালে শেখ মোহাম্মদ তাকে বলেছিলেন, 'ইংল্যান্ডে গিয়ে তুমি এবং তোমার ছেলেমেয়েরা কখনো নিরাপদ থাকবে না।'
এর পর জুলাই মাসে প্রিন্সেস হায়া লন্ডন হাইকোর্টে এক মামলা করেন।
তাতে তিনি জোরপূর্বক বিয়ে এবং নিপীড়নের হাত থেকে সুরক্ষা প্রার্থনা করেন এবং তার সন্তানরা যেন তার সাথে থাকতে পারে সে অধিকার দাবি করেন।
প্রিন্সেস হায়ার ভয় ছিল তার দুই ছেলেমেয়েকেও অপহরণ করে দুবাইয়ে নিয়ে যাওয়া হতে পারে।
অন্যদিকে শেখ মোহাম্মদ আদালতে একটি আবেদন করেছিলেন যে তাদের ছেলেমেয়েদের দুবাইয়ে ফিরতে দেয়া হোক।
প্রিন্সেস হায়ার দেহরক্ষীর সাথে প্রেম
জানা গেছে, প্রিন্সেস হায়ার একজন দেহরক্ষীর সাথে বিবাহবহির্ভূত প্রেমের সম্পর্ক ছিল।
মামলায় বলা হয় প্রিন্সেস হায়াকে দুবাই এবং লন্ডনে বহুবার হুমকি দেয়া হয়, এবং তিনি এখন জীবনের ঝুঁকির মধ্যে বাস করছেন।
হুমকি হিসেবে দুবার তার বালিশের ওপর পিস্তল রেখে দেয়া হয়েছিল, এবং আরেকবার তাকে ধরে নিয়ে যাবার কথা বলে বাড়ির সামনে হেলিকপ্টার নামানো হয়েছিল বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্রিটেনের রাজপরিবারের সাথে মাখামাখি
ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ ও রাজপরিবারের সাথে শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম ও তার সাবেক স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের কথা সর্বজনবিদিত।
তিনি ব্রিটেনে ঘোড়দৌড়ের সাথে জড়িত, এবং তার নিজস্ব গডলফিন স্টেবল নামে আস্তাবল আছে - যা পৃথিবীর অন্যতম রেসের ঘোড়া প্রজননের কেন্দ্র।
গডলফিন ঘোড়দৌড়ের যে টিম গড়ে তুলেছে তা পৃথিবীর বৃহত্তম। তারা ১৯৯২ থেকে ৬,০০০ রেস জিতেছে।
তবে তার ষষ্ঠ এবং জুনিয়র স্ত্রী হিসেবে প্রিন্সেস হায়াও ঘোড়দৌড়ের ব্যাপারে সমান উৎসাহী ছিলেন।
জানা যায়, একাধিক স্ত্রীর গর্ভে শেখ মোহাম্মদের মোট ২৩টি ছেলেমেয়ে আছে।
শেথ মোহাম্মদ রায়ের পর এক বিবৃতিতে বলেছেন, একজন সরকার প্রধান হিসেবে তিনি আদালতের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন নি, ফলে রায়ে পুরো ব্যাপারটির মাত্র একটি দিক ফুটে উঠেছে।
তিনি আরো বলেন, এটি একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং মিডিয়ার উচিত হবে তার সন্তানদের গোপনীয়তাকে সম্মান করা।
সূত্র : বিবিসি