১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিপজ্জনক চেহারা নিচ্ছে চীন-মার্কিন বৈরিতা

বিপজ্জনক চেহারা নিচ্ছে চীন-মার্কিন বৈরিতা - সংগৃহীত

চীনা পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরুর আগে রোববার বেইজিংয়ে বিশেষ এক সংবাদ সম্মেলনের সুযোগে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ওয়াশিংটনের প্রতি স্পষ্ট করে কিছু বার্তা দিতে চেয়েছেন।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড প্যানডেমিক নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একের পর এক “মিথ্যা ভিত্তিহীন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব“ ছড়িয়ে মার্কিন কিছু রাজনীতিবিদ দুই দেশের মধ্যে নতুন এক শীতল যুদ্ধ শুরুর পাঁয়তারায় লিপ্ত হয়েছে যার ফল কারো জন্যই শুভ হবে না।

চীনা মন্ত্রী বলেন, “আমেরিকাকে বদল করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা চীনের নেই। সুতরাং চীনকে বদলের অবাস্তব যে স্বপ্ন আমেরিকা লালন করছে তা তাদের পরিহার করা উচিৎ।“

তিনি সাবধান করেন, “গত কয়েক দশক ধরে দুই দেশের সহযোগিতার ফলে যে সুফল তৈরি হয়েছে, তা নষ্ট করলে তাতে আমেরিকার নিজের ক্ষতি তো হবেই, পুরো বিশ্বের স্থিতিশীলতা এবং সচ্ছলতা হুমকিতে পড়বে।“

চীনের কাছ থেকে এমন জোরালো বক্তব্য এমন সময় এলো যখন করোনাভাইরাসের সমস্ত দায় চীনের ওপর চাপানোর চেষ্টায় রাশ টানার কোনো লক্ষণই দেখাচ্ছেন না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

সম্প্রতি এক তত্ত্ব প্রচার করেছেন হোয়াইট হাউজের বাণিজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা পিটার নাবারো যে, “চীন করেনাভেইরাসে আক্রান্ত লাখ মানুষকে বিমানে উঠিয়ে সারা পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছে যাতে একটি প্যানডেমিক তৈরি হয়।“ এ কথায় প্রচণ্ড ক্ষেপে গেছে বেইজিং।

শায়েস্তা করতে চীনের সাথে সম্পর্ক পুরোপুরি ছেদ করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি মি ট্রাম্প।

কদিন আগে ফক্স বিজনেস নেটওয়ার্কের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস প্যানডেমিক আরো একবার প্রমাণ করেছে যে পণ্য এবং সেবার জন্য চীনের ওপর থেকে সবধরনের নির্ভরতার ইতি টানতেই হবে। “

নতুন এক শীতল যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব?
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এ সময় চীনকে কোণঠাসা করে নতুন এক শীতল যুদ্ধের চেষ্টা কি শুধুই ডোনাল্ড ট্রাম্প বা তার কিছু সহযোগীর কাজ?

অধিকাংশ পর্যবেক্ষক অবশ্য তা মনে করেন না। তাদের কথা - বেশ আগে থেকেই বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বৈরিতা দিনে দিনে বাড়ছে। করোনাভাইরাস প্যানডেমিক তাতে শুধু নতুন একটি মাত্রা যোগ করেছে।

বেইজিং ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের প্রেসিডেন্ট ওয়াং হুহাইওর মতে, ১৯৭৯ সালে দুই দেশের মধ্যে পুরোমাত্রায় কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠান পর পারস্পরিক অবিশ্বাস এত খারাপ কখনো হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা এশিয়া সোসাইটির মার্কিন-চীন সেন্টারের পরিচালক অরভিল শেল বিজনেস ইনসাইডার পত্রিকাকে বলেন, “আমরা একটি শীতল যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।“

হংকংয়ের ব্যাপটিস্ট ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক জ্যঁ পিয়ের সেবাস্টিয়ান লন্ডনের ফিনানশিয়াল টাইমস পত্রিকাকে বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন নতুন এক ধরণের শীতল যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে।“

কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসিকে বলেন, বেশ অনেক দিন ধরেই চীনকে আমেরিকা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির প্রতি প্রধান হুমকি হিসাবে বিবেচনা করছে।

ড. আলী বলেন , সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের যে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নেয়, তাতে পরিষ্কার বলা আছে, আর কোনদিনই বিশ্বের কোথাও তারা এমন কোনো শক্তিকে মাথাচাড়া দিতে দেবে না যারা আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

"অনেক দিন ধরেই চীনকে তারা ভবিষ্যতে সেই ধরণের একটি চ্যালেঞ্জ মনে করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিষয়ক সরকারি সমস্ত নথিপত্র, দলিলে তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।“

ড. আলী মনে করেন, এটি শুধু ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নয়, সুযোগ পেলেই চীনকে ঘায়েল করার বিষয়ে আমেরিকার রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একধরণের ঐক্যমত্য রয়েছে।

ড. আলী বলেন চীনের প্রতি বৈরিতা আমেরিকা শুধু নথিপত্রের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে বেশ কিছু দিন ধরেই কার্যকরী করতে শুরু করেছে।

চীনের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের সাথে, যেমন ভারত, জাপান, ভিয়েতনাম, সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশগুলোর সাথে যৌথ সামরিক মহড়া করছে।যেসব ডব্লিউ টি ও বা ডব্লিউ এইচ ওর মতো যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চীনের প্রভাব রয়েছে, যেগুলোর সুবিধা চীন নিচ্ছে সেগুলোকে খাটো করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

“চীন চোখের সামনে এগুলো দেখছে। তাদের মধ্যে এক ধরণের উৎকণ্ঠা জোরদার হচ্ছে যে আমেরিকা তাদের নথিপত্রে লেখা কৌশল বাস্তবে কাজে লাগাতে শুরু করেছে।“

রয়টার্স বার্তা সংস্থা বলছে, চীনের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি অভ্যন্তরীণ নথিতে দেশের শীর্ষ নেতৃত্বকে সতর্ক করা হয়েছে যে চীনের প্রতি যে বৈরি মনোভাব বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে এখন তৈরি হয়েছে, তার নজির ১৯৮৯-এ তিয়েনানমেন স্কয়ারের ঘটনার পর দেখা যায়নি।

ঐ নথিতে বলা হয়েছে, চীন এবং চীনা কম্যুনিস্ট পার্টিকে ঘায়েল করা, অপদস্থ করা , তাদেরকে বিশ্ব নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির জন্য একটি হুমকি হিসাবে দেখানোর জন্য আমেরিকা উঠেপড়ে লেগেছে।

তাহলে কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে? বিবিসির এই প্রশ্নে ড মাহমুদ আলী বলেন, যে শীতল যুদ্ধ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলেছে, তেমনটি শুরু হয়েছে বা অদূর ভবিষ্যতে হবে বলে তিনি মনে করেন না।

তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র সে ধরণের তথাকথিত শীতল যুদ্ধ শুরু করলেও, চীন এখনো কিছুই করেনি বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তির সাথে সবদিক থেকে পাল্লা দেওয়ার সেই প্রভাব-প্রতিপত্তিও চীনের নেই।

“চীন যে বার্তা আমেরিকা এবং তাদের মিত্রদের দিতে চাইছে যে তাদের ওপর খুব বেশি চাপ তৈরি করলে তারা বসে থাকবে না। চাপের কাছে বেইজিং আর কখনো নতি স্বীকার করবে না, এবং চীনকে খুব বেশি আঘাত করার চেষ্টা করলে আমেরিকা ভুল করবে।“

ভাগ হয়ে যেতে পারে বিশ্ব ব্যবস্থা
অদূর ভবিষ্যতে দুই পরাশক্তির মধ্যে সামরিক সংঘাতের কথা কেউ এখনো বলছেন না।

বেইজিংয়ে চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের ওয়াং হুইয়াও বলছেন, সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা কম, “কিন্তু মুক্ত বাণিজ্যের কারণে গত কয়েক দশকে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে। “আমরা হয়তো দেখবো পুরো বিশ্ব ব্যবস্থা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে।“

ড. মাহমুদ আলীও অনেকটা তেমনই মনে করছেন। তার মতে, অর্থনীতি এবং প্রযুক্তি খাতে বিশ্ব ব্যবস্থায় একটা বিভাজন হয়তো দেখা দিতে চলেছে যার একদিকে চীন এবং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র।

“উন্নয়নশীল বিশ্বের কিছু দেশ হয়তো চীনের দিকে ঝুঁকতে পারে।“

তিনি মনে করছেন, তাদের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের সাথে ৬০টিরও বেশি দেশ রয়েছে, যাদের সাথে এই কূটনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা করতে পারে চীন।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement