০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

ট্রাম্প কেন গাজা ‘পরিষ্কারের’ প্রস্তাব দিলেন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প - ছবি : সংগৃহীত

পশ্চিমতীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল। সেখান থেকে শুধু গত সপ্তাহেই তারা ১৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে বহিষ্কার করেছে। তাদের অনেকের বাড়িঘরও মিটিয়ে দিয়েছে দখলদার বাহিনী।

এদিকে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে গাজা পরিষ্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে এখনো ১৫ লাখ ফিলিস্তিনি রয়েছে। ইসরাইলি গণহত্যা থেকে কোনো মতে বেঁচে গেছে তারা। ট্রাম্প তাদেরকে মিসর, জর্ডান কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় পাঠাতে চান। এদের সংখ্যা জেনিন থেকে বাস্তুচ্যুতদের থেকে অন্তত ১০০ গুণ বেশি হবে।

অবশ্য ট্রাম্পের এমন অযৌক্তিক ও অনৈতিক প্রস্তাবটি নতুন নয়। পশ্চিমা বিশ্ব আরো ১৫ মাস আগে থেকেই এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। ট্রাম্পের ঘোষণা তার আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। ২০২৩ সালের অক্টোবরে যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখনই ইসরাইল দাবি জানিয়েছিল যে গাজাবাসীকে মিসরের সিনাই উপত্যকায় স্থানান্তরিত করা হোক। এর পর থেকেই এই পরিকল্পনা শুরু হয়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার আরবীয় মিত্ররা এ নিয়ে কিছুটা কাজও শুরু করেছিল। তবে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির কারণে তা থমকে যায়। সিসি এই প্রস্তাবনা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, গাজাবাসীকে বরং ইসরাইলের মধ্যেই পূনর্বাসিত করা উচিৎ। তবে ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্ব এতে থেমে যায়নি। বরং তারা মিসরের বিকল্প অনুসন্ধান করেছিল। ফলে কঙ্গো, কানাডাসহ আফ্রিকারও বেশ কয়েকটি দেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। শেষমেষ সৌদি আরব নিয়েও কথা হয়েছিল। তবে এখনো সেই বিষয়ে সমাধানে পৌঁছা যায়নি।

‘যৌক্তিক সমাধান’
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী ট্রাম্প প্রস্তাবের পক্ষে এই যুক্তি দিয়েছিলেন যে ‘ফিলিস্তিনিরা যদি জর্ডান ও মিসরে পুনর্বাসিত হয়, তাহলে তারা আরবদের সাথেই থাকতে পারবে। তাদের আলাদা আবাসনের ব্যবস্থা হবে। সেখানে তারা সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে। তবে তাদের এই স্থানান্তর অস্থায়ীও হতে পারে। আবার দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে।’ ট্রাম্পের এই প্রস্তাবনা মূলত ২০২৩ সালে প্রকাশ করা ইসরাইলি প্রস্তাবনারই প্রতিধ্বনি। এর মাধ্যমে ইসরাইলের অবৈধ উপনিবেশ ও ভূমি দখল সম্ভব হবে। ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাবে গাজাবাসীদেরকে জাতিগত নিধন করা ও মিসরের সিনাই উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসনকে ইতিবাচক ও যৌক্তিক সমাধান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি এই প্রস্তাবনায় সিনাই উপত্যকাকে গাজাবাসীর প্রত্যাশিত সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে।

অথচ বাস্তবতা হলো, এর মাধ্যমে মোটেই শান্তি স্থাপিত হবে না। বরং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা হলো, ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবনায় বাধ্য করতে হবে। আবরবিশ্বকে চাপ না দিয়ে ইসরাইলকে চাপ দিতে হবে পশ্চিমাবিশ্বের। ১৯৪৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বহিষ্কৃত সকল ফিলিস্তিনিকে ফিরিয়ে নিতে নিতে হবে। অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের তাড়িতে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলেই কেবল এই অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

ট্রাম্প যদি সত্যিই চান যে ফিলিস্তিনিরা শান্তিতে থাকুক, তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সামঞ্জস্য রেখে ইসরাইলকে চাপ দিতে হবে যে তারা যেন ১৯৪৮ সালের পর থেকে যেসব শহর ও জনপদ ধ্বংস করেছে, সেখানে ফিলিস্তিনিদের জন্য আবাসন নির্মাণ করে দেয়।

ইসরাইল ত্যাগ
২০২৩ সালের গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেক ইসরাইলিই অবৈধ বসতি ছেড়ে পালিয়েছে। মজার বিষয় হলো, এক্ষেত্রে কোনো আরব দেশই পরামর্শ দেয়নি যে তারা যেহেতু পালিয়ে এসেছে, তাদেরকে আফ্রিকা, কানাডা কিংবা যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের কোনো দেশে স্থানান্তরিত করা হোক।

সরকারি তথ্য মতে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ৮২ হাজার ইহুদি দেশ ছেড়েছে। তবে অনানুষ্ঠানিক অনুমান অনুসারে সংখ্যাটি পাঁচ লক্ষের মতো হতে পারে।

অবশ্য যেসব ইসরাইলি দেশ ছেড়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদেরকে স্বাগত জানায়, তাহলে তারা শান্তিতে বসবাস করার এই সুযোগকে হাতছাড়া করবে না। ট্রাম্প চাইলে করতে পারেন। কারণ, ইতোমধ্যে ১০ লাখ ইহুদি মার্কিন ও ইউরোপীয় পাসপোর্ট গ্রহণ করেছে। এছাড়া তিনি ফিলিস্তিনিদের জন্য যেসব দেশের কথা বিবেচনা করেছিলেন, তাদেরকে রাজি করিয়ে যদি দেশছাড়া ইহুদিদের সেখানে পুনর্বাসিত করতে পারেন, তাও হতে পারে। এতে সেখানে তারা শান্তিতে থাকতে পারবে।

ইসরাইলের সরকারই বলেছে, ১৯৪৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৭ লাখ ২০ হাজার ইসরাইলি দেশ ছেড়েছে। এরপর তারা আর দেশে ফিরে আসেনি। অথচ তাদের বেশিরভাগই ছিল উপনিবেশবাদী বা তাদের বংশধর। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইসরাইলি সংবাদপত্র মারিভ জানিয়েছিল যে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন সহজতর করার লক্ষ্যে একটি নতুন আন্দোলনও সৃষ্টি হয়েছিল। আসলে নিরপত্তা উদ্বেগের কারণেই অনেকে এখন ইসরাইলে থাকতে চাচ্ছে না। ফলে এখন তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার জন্য গাজা খালি করার প্রয়োজন বোধ করছে তারা।

ট্রাম্পের প্রতি পাল্টা প্রস্তাব
সম্ভবত জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ এবং মিসরের সিসি উভয়ই বহিষ্কৃত ফিলিস্তিনিদের গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা ট্রাম্পকে পাল্টা প্রস্তাব দিতে পারেন যে বাস্তুচ্যুত ইসরাইলিদের পশ্চিমা বিশ্বই আশ্রয় দিক। এতে তাদের শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে। একইভাবে সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত হয় স্বেচ্ছাসেবক হতে পারে। অথবা ইসরাইলিদের অভিবাসনের জন্য অর্থায়ন করতে পারে। বিশেষ করে তাদের ‘পুরাতন বা নতুন’ আবাসভূমিতে, ইহুদিবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডোর হার্জল যাকে ‘আল্টনিউল্যান্ড’ বলেছিলেন, সেখানে তাদের আবাসন প্রদান করতেও উৎসাহিত করতে পারে।

এর বিপরীতে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের তাদের বহিষ্কৃত ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া আন্তর্জাতিক আইনের একটি ন্যায্য এবং যুক্তিসঙ্গত প্রয়োগ হবে। সুতরাং যেসব ইসরাইলি অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে নিরাপদ বোধ করেন না, তারা এমন দেশে চলে যেতে পারে, যেখানে তাদের সাদরে স্বাগত জানানো হবে। সেখানে তাদের কাঙ্ক্ষিত আবাসন, নিরাপত্তা এবং শান্তি প্রদান করা হবে।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই


আরো সংবাদ



premium cement

সকল