গ্রিনল্যান্ড দখলের হুমকি নিয়ে ট্রাম্পকে সতর্ক করল জার্মানি-ফ্রান্স
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩:০৪
ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড দখল করতে সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি ফিরিয়ে না নেয়ায় নবনির্বাচিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সতর্ক করেছে জার্মানি ও ফ্রান্স।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেছেন, ‘সীমানার অখণ্ডতার নীতি প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তা খুব ছোট বা খুব শক্তিশালী দেশ যাই হোক না কেন।’
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাঁ-নোয়েল ব্যারো বলেছেন, ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে কখনই বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সার্বভৌম সীমান্তে আক্রমণ করতে দেবে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন।’
গত মঙ্গলবার ট্রাম্প আবারো তার গ্রিনল্যান্ড অধিগ্রহণের ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলেছেন, আর্কটিক দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার প্রথম মেয়াদে গ্রিনল্যান্ড কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন ট্রাম্প। এরপর তিনি বারবারই এই ধারণা উত্থাপন করে আসছেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মার্কিন মিত্র ডেনমার্ক স্পষ্ট করে জানিয়েছে, গ্রিনল্যান্ড বিক্রির জন্য নয়। আর অঞ্চলটির মালিক মূলত এর বাসিন্দারা।
গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মুট এগিদ ডেনমার্কের কাছ থেকে তার দেশকে স্বাধীন করার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন। তবে তিনিও স্পষ্ট করে বলেছেন, অঞ্চলটি বিক্রির জন্য নয়। বুধবার তিনি কোপেনহেগেন সফর করেন।
চ্যান্সেলর শলৎজ বলেন, আসন্ন মার্কিন প্রশাসনের বক্তব্যগুলোয় ‘কিছুটা ভুল ধারণা’ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সীমান্তের অখণ্ডতার নীতি- পূর্ব বা পশ্চিম যেকোনো দেশের জন্য প্রযোজ্য।’
জার্মানি, ফ্রান্স ও ডেনমার্ক মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সদস্য।
শলৎজ জোর দিয়ে বলেন, ‘ন্যাটো আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এবং আটলান্টিক মহাসাগর উপকূলীয় দেশগুলোর সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু।’
এর আগে বুধবার ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাঁ-নোয়েল ব্যারো ফ্রান্স ইন্টার রেডিওকে বলেন, ‘আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করেন যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ড আক্রমণ করবে কি না, তাহলে আমার উত্তর হবে- না। আমরা কি এমন এক যুগে প্রবেশ করেছি যেখানে আবারো শক্তিশালীদের টিকে থাকার নিয়ম দেখা দিচ্ছে? তাহলে এর উত্তর হবে- হ্যাঁ। তাহলে কি আমাদের নিজেদেরকে ভয় ও উদ্বেগে কাবু হতে দেয়া উচিত, অবশ্যই না। আমাদের জেগে উঠতে হবে এবং নিজেদের শক্তি গড়ে তুলতে হবে।’
জার্মানি ও ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রধান দুই সদস্য, যাদের প্রায়ই এই জোটের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়।
তবে ইইউ কিভাবে সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে তা অনুমান করা বেশ কঠিন। ইইউর নিজস্ব কোনো প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেই এবং এর ২৭টি সদস্য দেশের বেশিভাগই ন্যাটোর অংশ।
২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেবেন ট্রাম্প।
এর দু’সপ্তাহেরও কম সময় আগে ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোতে এক স্বাধীন সংবাদ সম্মেলনে তিনি গ্রিনল্যান্ড নিয়ে এই মন্তব্য করেন।
গ্রিনল্যান্ড বা পানামা খাল দখলের জন্য তিনি সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘না, আমি আপনাকে এই দু’টির কোনোটির বিষয়েই আশ্বস্ত করতে পারছি না। কিন্তু আমি এটুকু বলতে পারি যে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য আমাদের এগুলো প্রয়োজন।’
স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে গ্রিনল্যান্ডে মার্কিন রাডার ঘাঁটি রয়েছে। আর ওয়াশিংটনের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই এটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রাম্প বলেন, দ্বীপটি চীনা ও রাশিয়ান জাহাজগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেগুলো তার মতে ‘সর্বত্র ছড়িয়ে আছে’।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, "আমি মুক্ত বিশ্বের সুরক্ষার কথা বলছি।"
ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন মঙ্গলবার ডেনিশ টেলিভিশনকে বলেন, "গ্রিনল্যান্ডের মালিকানা গ্রিনল্যান্ডবাসীর" এবং কেবল স্থানীয় জনগণই এর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারেন।
তবে, তিনি জোর দিয়ে বলেন, ডেনমার্কের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতাও প্রয়োজন।
গ্রিনল্যান্ডের পার্লামেন্ট সদস্য কুনো ফেনকার বলেছেন, তারা ট্রাম্পের কাছ থেকে কিছু ‘জোরাল মন্তব্যের’ জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তবে দ্বীপের সার্বভৌমত্ব ও নিজেদের সবকিছু নিজেদেরই নিয়ন্ত্রণের থাকার আলোচনা এসবের ঊর্ধ্বে।
গ্রিনল্যান্ডের শাসক জোটের অংশ সিউমুট পার্টির ফেনকার বলেন, ‘গঠনমূলক সংলাপ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সাথে পারস্পরিকভাবে লাভজনক অংশীদারিত্বকে’ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ স্বাগত জানাবে।
ডেনমার্ক ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে একটি মুক্ত সহযোগিতার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেননি তিনি।
তিনি আরো বলেছেন, ‘এটি কোনো এক রাজনীতিবিদের একক সিদ্ধান্ত নয়। এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত যা গ্রিনল্যান্ডের জনগণকে নিতে হবে।’
মাত্র ৫৭ হাজার জনসংখ্যার দ্বীপ গ্রিনল্যান্ডে স্বায়ত্তশাসন রয়েছে, তবে এর অর্থনীতি মূলত কোপেনহেগেন থেকে আসা ভর্তুকির ওপর নির্ভরশীল এবং এটি এখনো ডেনমার্কের অংশ।
প্রায় ৮০ শতাংশ অঞ্চল তুষারাবৃত হলেও এই দ্বীপে বিরল খনিজ পদার্থের সবচেয়ে বড় মজুদ রয়েছে, যা ব্যাটারি এবং উচ্চ-প্রযুক্তির ডিভাইস তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ড্যানিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক স্টেফেন ক্রেটজ গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নুক থেকে জানান, তিনি যাদের সাথে কথা বলেছেন তাদের বেশিভাগই ট্রাম্পের সামরিক শক্তি ব্যবহার করে অঞ্চলটি দখল করার হুমকি শুনে ‘স্তম্ভিত’।
যদিও গ্রিনল্যান্ডের বেশিভাগ মানুষ ভবিষ্যতে স্বাধীনতার আশা করছেন। তিনি বলেছিলেন, সেখানে এটাও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে তাদের এমন এক অংশীদারের প্রয়োজন যিনি জনসেবা, প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক ভিত্তি দিতে পারে যেমনটি ডেনমার্ক এখন করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমি এখনো এমন কাউকে পাইনি যিনি স্বপ্ন দেখছেন যে দ্বীপটি যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্য কোনো বাইরের শক্তির উপনিবেশে পরিণত হবে।’
ক্রেটজ আরো বলেন, যদিও ড্যানিশ সরকার ট্রাম্পের সাথে যেকোনো বিরোধকে ‘হ্রাস’ করার চেষ্টা করেছে, ‘পর্দার আড়ালে আমি বুঝতে পারছি যে এই সংঘাত ডেনমার্কের জন্য আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সঙ্কটে পরিণত হতে পারে।’
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র গত মঙ্গলবার গ্রিনল্যান্ডে এক সংক্ষিপ্ত সফর করেন, যাকে তিনি ‘ব্যক্তিগত ভ্রমণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি স্থানীয়দের সাথে কথা বলেন।
এরপর তিনি একটি বারে গ্রিনল্যান্ডবাসীদের একটি দলের সাথে প্রো-ট্রাম্প ক্যাপ পরা একটি ছবি পোস্ট করেন।
কেন গ্রিনল্যান্ড এত গুরুত্বপূর্ণ
গ্রিনল্যান্ডে কী কী প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তার লম্বা তালিকা আছে দ্য জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ডেনমার্ক অ্যান্ড গ্রিনল্যান্ডের ওয়েবসাইটে।
সেখানে যেমন আছে সোনা, প্লাটিনাম, হিরা ও রুবির মতো দামি খনিজ, তেমনি আছে লিথিয়াম, টাইটেনিয়ামসহ বিরল সব ধাতুর খনি। জ্বালানি উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়লা ও ইউরেনিয়ামের খনিও আছে।
বড় ধরনের তেলের খনি ও প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রও রয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে দ্বীপটির বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে এবং এর ফলে সেখানকার ভূমি ব্যবহারের সুযোগ বাড়বে। একইসাথে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অপার সম্ভাবনাও উন্মোচিত হবে।
বিশ্ব ব্যাংকের ধারণা, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী এসব খনিজ সম্পদের চাহিদা পাঁচ গুণ বেড়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে গ্রিনল্যান্ডকে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকে রাশিয়াও।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা