০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

দেনার দায়ে শক্ত অবস্থান হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র?

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে - সংগৃহীত

যত সময় গড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ করা অর্থের পরিমাণ। পরিস্থিতি যা, তাতে শক্ত অবস্থান বজায় রাখাই কঠিন। ফলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিবিদদের। ‘সুপার পাওয়ার’ রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হলে তার আঁচ থেকে যে অন্যেরা বাঁচতে পারবে, এমনটা নয়।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। সরকারি তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের মোট ঋণের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ৩৬ লাখ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে চলতি বছরে ধারের পরিমাণ দু’লাখ কোটি ডলার বাড়িয়েছে ‘সুপার পাওয়ার’ দেশটি।

আগামী বছরের জানুয়ারিতে শপথ নেবেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, জাতীয় ঋণের মাত্রাছাড়া অঙ্ক কমানোই হবে তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী একাধিক নীতি ভণ্ডুল হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

তথ্য বলছে, গত কয়েক দশকে অস্বাভাবিক দ্রুততায় বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ নেয়ার অঙ্ক। চলতি শতাব্দীর শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ লাভ ৭০ হাজার কোটি ডলার। কিন্তু ২০২০ সালে সেই সংখ্যাই বেড়ে ২৩ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। পরের বছরগুলোতে জাতীয় ঋণের সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।

২০২০ সালে দুনিয়া জুড়ে শুরু হয় করোনা মহামারি। এর ধাক্কায় ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মার্কিন অর্থনীতি। সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে করোনা-পরবর্তী সময়ে ঋণের ওপর ঋণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সিদ্ধান্ত ওয়াশিংটনের বিপদ বাড়িয়েছে বলেই মনে করেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।

মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডারেল রিজার্ভ’ জানিয়েছে, করোনা-পরবর্তী বছরগুলোতে মোট ১৬ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। নভেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে শেষ ৩১৬ দিনে জাতীয় ধারের অঙ্ক প্রতিদিন বেড়েছে ৬৩০ কোটি ডলার। ফলে বর্তমানে নাগরিকের ওপর গড় এক লাখ আট হাজার ডলারের ঋণে বোঝা রয়েছে।

আতঙ্কের এখানেই শেষ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ এখন দেশটির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির ১২৫ শতাংশে পৌঁছেছে। আগামী দিনে ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ২০০ শতাংশে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে জাতীয় ধার ওয়াশিংটনের অর্থনীতির দ্বিগুণ আকার ধারণ করবে।

ঋণের পরিমাণে এভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্থিক বিশ্লেষকদের তরফে পাওয়া গেছে সতর্কবার্তা। তাদের কথায়, ধার যেভাবে বেড়েছে তাতে আগামী দিনে সুদের পেছনে বিপুল টাকা খরচ হবে যুক্তরাষ্ট্রের।

অন্য দিকে, পরিকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দে কমাবে সরকার।

ঋণের সূচক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় এখনই দিনে ১০০ কোটি ডলারের বেশি সুদ বাবদ খরচ করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, চলতি বছরে এক লাখ কোটি ডলারের গণ্ডি অতিক্রম করবে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের খরচ। এই অঙ্ক ওয়াশিংটনের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যয়ের চেয়েও বেশি।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করেছেন ‘বাইপারটিসান পলিসি সেন্টার’-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সাই আবাকাশ। মার্কিন বার্তাসংস্থা ‘ফরচুন’কে তিনি বলেন, ‘এখনকার পরিস্থিতিতে ঋণের অঙ্ক সুদের হারে ঊর্ধ্বমুখী চাপ দিচ্ছে। ফলে চড়ছে বন্ধকি হারের সূচকও।;

তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণত জাতীয় ঋণ বৃদ্ধি রাষ্ট্রের আর্থিক উন্নতির পথের কাঁটা হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সেই চিত্র খুব শিগগিরি দেখতে পাওয়া যাবে। দেশ ধারে ডুবে থাকলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়বে। বৃদ্ধি পাবে সংসার খরচ। অন্য দিকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নতির কথা ভেবে কোনো বিনিয়োগ করতে পারবে না সরকার।’

বিশ্লেষকদের ধারণা, জাতীয় ঋণ কমাতে সরকারি খরচে লাগাম টানায় নজর দেবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইতোমধ্যেই ‘ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ নামের একটি নতুন মন্ত্রণালয় গঠনের ঘোষণা করেছেন তিনি। এর নেতৃত্বে ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্ক এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত রিপাবলিকান নেতা বিবেক রামস্বামীকে রেখেছেন তিনি।

নতুন এই দফতরের মাধ্যমে অযোগ্য সরকারি কর্মচারী এবং বিভাগগুলোকে চিহ্নিত করা হবে। এরপর প্রশাসন থেকে তাদের ছেঁটে ফেলার নির্দেশ দেবেন তিনি।

মাস্ক জানিয়েছেন, এর মাধ্যমে কোটি কোটি ডলারের বাজে খরচ আটকানো যাবে। পাবলিক ব্রডকাস্টিং বাজেট কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই ধনকুবের।

পাশাপাশি, আগামী দিনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, আইনজীবীদের ফার্ম এবং গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে আন্দোলন চালানো গোষ্ঠীগুলোকে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ সহায়তা বন্ধ করতে পারেন ট্রাম্প। এছাড়া সরকারি কোষাগার ভর্তি করতে কর কাঠামোর বড় সংস্কারের পথেও হাঁটতে পারেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘জয়েন্ট সেন্টার ফর পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক স্টাডিজ’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেসিকা ফুলটন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের আয়কর নীতির কড়া সমালোচনা করেছেন। ফুলটনের কথায়, ‘করপোরেট করের হার কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার কথা বলেছেন ট্রাম্প। অর্থাৎ যারা টাকা দিতে পারবেন তাদের থেকেই অর্থ নেবে না সরকার।’

একই কথা বলছেন ‘ম্যানহাটন ইনস্টিটিউট’-এর সিনিয়র ফেলো ব্রায়ান রিডলও। তার কথায়, ‘জাতীয় ঋণের জেরে আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ তিন গুণ হওয়ার পর কর মওকুফ পাগলামি।’

ট্রাম্পের কর সংস্কার নীতি নিয়ে তার নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির অন্দরেও একাধিক প্রশ্ন রয়েছে।

করোনা মহামারির পর ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার উল্লেখ্যযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে তা যুক্তরাষ্ট্রের উপভোক্তাদের ওপর চাপ তৈরি করছে। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি নোটের মূল্য হ্রাসের কথা বলা যেতে পারে। ২০২০ সালের এপ্রিলে এতে ০.৬ শতাংশ পতন দেখা গেছে। বর্তমানে তা ৪.৪ শতাংশ উঠে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের বোঝা কমানো ট্রাম্পের কাছে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের বলে উল্লেখ করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। কারণ ইতোমধ্যেই চীন ও রাশিয়াসহ ‘ব্রিকস’ভুক্ত দেশগুলোর পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। এই শুল্ক-যুদ্ধ মার্কিন অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলেও সতর্ক করেছে ওয়াকিবহাল মহল।

এছাড়া ভারত, রাশিয়া, চীন ও ব্রাজিলসহ বেশ কিছু দেশ ডলারকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এর জন্য ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো আলাদা মুদ্রা চালু করতে পারে। সেক্ষেত্রে ডলারের অবমূল্যায়নের আশঙ্কা রয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মার্কিন অর্থনীতি। ফলে ঋণের জাল কেটে বেরিয়া আসা আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা


আরো সংবাদ



premium cement