কেন ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় ইলন মাস্ক
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৮
জ্যান্ডার মুন্ডি কর্মস্থলে অন্য সব দিনের মতোই ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ সময় তিনি শোনেন, প্রযুক্তি জগতের ধনাঢ্য ব্যক্তি ইলন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের ফোলসম শহরের কাছাকাছি একটি স্কুলে বক্তব্য রাখছেন।
মুন্ডি তখন নিজেকেই প্রশ্ন করেন, ‘কবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটিকে এই শহরেই পাওয়া যায়?’
ফোলসম বেশ শান্ত একটি অঞ্চল, যার জনসংখ্যা মাত্র নয় হাজার। এখানকার বাসিন্দারা সাধারণত রাজনীতি সম্পর্কে খুব একটা খোলাখুলি কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।
২১ বছর বয়সী মুন্ডি একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। নভেম্বরের নির্বাচনে ভোট দেয়ার পরিকল্পনা করছেন না বলেই স্বীকার করেন তিনি।
কিন্তু ইলন মাস্কের কথা শুনতে ভিড় তৈরি হতে দেখে উত্তেজনা অনুভব করেন মুন্ডি। নিজেও আগ্রহী হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
স্কুলটি থেকে ফেরার সময় তিনি কমলা হ্যারিসের চেয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকেই বেশি ঝুঁকে যান বলে জানান মুন্ডি।
তিনি বলেন, ‘যদি এরকম কেউ আপনাকে বলে যে এই নির্বাচনই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে চলেছে, কেবল আগামী চার বছরের জন্য কে রাষ্ট্রপতি হবেন তা নয়, বরং বিশ্ব কেমন হতে চলেছে... আমি মনে করি এটি একটি বিশাল ব্যাপার। এটা গুরুত্বপূর্ণ, খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
ইলন মাস্ক ইতোপূর্বে প্রযুক্তি জগতে উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা সম্পন্ন একজন প্রতিভাবান হিসেবে নিজের একটি পরিচয় গড়ে তুলেছেন। রাজনীতির একেবারে ভেতরে না ঢুকে পাশাপাশি থেকেছেন, তিনি এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিতে ৫৩ বছর বয়সী এই ব্যক্তি রিপাবলিকানদের নির্বাচিত করতে চেষ্টা করছেন তার সময়, জ্ঞান আর যথেষ্ট বিনিয়োগের মাধ্যমে। দেশের অভিজাত ব্যবসায়ীদের মধ্যে এটা সত্যিই বিরল। কারণ তারা ঐতিহ্যগতভাবেই পেছনে থেকে রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পছন্দ করেন।
এটি ঐতিহ্যবাহী বড় বড় ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব বা সিইওদের প্রচলিত আচরণ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, যারা তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশে সম্ভাব্য দাতাদেরকে খুশি করতে হ্যাম্পটনের বিশাল বাড়িতে ব্যয়বহুল ভোজ আয়োজনের জন্যই বেশি পরিচিত।
ফলে স্বভাবতই ইলন মাস্কের ব্যতিক্রমী হওয়ার পেছনে তার অনুপ্রেরণা বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছেন পর্যবেক্ষকরা।
মিশিগান ইউনিভার্সিটির রস স্কুল অফ বিজনেসের উদ্যোক্তা বিভাগের চেয়ারম্যান এরিক গর্ডন ব্যাখ্যা করেন, সিইওদের ঐতিহ্যগত কার্যক্রম জনসাধারণের সম্মুখে হয় না। কিন্তু মাস্ক এটি বেশ জোরেশোরে, প্রকাশ্যে ও গর্ব করে করেন। যা সম্ভবত নিজেকে আলোকিত করে তুলতেই করা।
অলাভজনক ট্র্যাকার প্রতিষ্ঠান ‘ওপেন সিক্রেটস’ বলছে, মাস্কের ট্রাম্প-সমর্থিত রাজনৈতিক অ্যাকশন কমিটি আমেরিকা প্যাক ইতোমধ্যেই এই নির্বাচনের জন্য ১১৯ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে।
মাস্কের নিজস্ব অবদান তাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দৌড়ে সবচেয়ে বড় দাতাদের একজন করে তুলেছে। কথিত আছে, সুইং স্টেটগুলোতে ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারাভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন তিনি।
এই প্রচেষ্টায় সাহায্য করার জন্য ইলন মাস্কের একজন প্রধান লেফটেন্যান্ট স্টিভ ডেভিসকে নিয়োগ করা হয়েছে, যিনি স্পেসএক্স, এক্স ও বোরিং কোম্পানিসহ মাস্কের অন্য কোম্পানিগুলোর জন্যও কাজ করেছেন।
প্রচারাভিযানে মাস্কের ব্যক্তিগত বিনিয়োগ মুন্ডির কাছে লক্ষ্যনীয় মনে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এটিই আমাকে হতবাক করার মতো ব্যাপার ছিল। কেউ ভোটারদের প্রভাবিত করতে এত বেশি সময় আর অর্থ ব্যয় করবে! তার মানে সে এটি কোনো বিশেষ কারণে করছে।’
পেনসিলভানিয়ার সিনেটর জন ফেটারম্যানের মতো কিছু ডেমোক্র্যাট তাদের দলকে নির্বাচনের আগে মাস্কের তরফ থেকে আসা সম্ভাব্য ঝুঁকি উপেক্ষা না করতে অনুরোধ করেছেন।
ইলন মাস্ক এমন একটি জনসংখ্যার কাছে আবেদন তৈরি করেছেন, যারা তাকে ‘নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান’ মনে করেন এবং যাদের কাছে ঐতিহ্যগতভাবেই গণতান্ত্রিক প্রচার-প্রচেষ্টা চালানোটা কঠিন বলে প্রমাণিত হয়েছে, ফেটারম্যান বিশ্বাস করেন।
১৩ জুলাই পেনসিলভানিয়ার বাটলারে হত্যা-প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পকে প্রথম সমর্থন দেয়ার পর থেকে ইলন মাস্ক ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের একটি অংশ হয়ে উঠেছেন। যেখানে তিনি প্রায়ই সতর্কবার্তা দিয়ে থাকেন যে শুধুমাত্র ট্রাম্পই যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকার গণতন্ত্রকে ‘বাঁচাতে’ পারেন।
প্রচারণার শেষ দিনগুলোতে ইলন মাস্ক পেনসিলভানিয়া রাজ্যে বেশ সক্রিয় হয়েছেন। যেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস- উভয়ের জন্যই সমান মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
আমেরিকা প্যাক নির্বাচনের দিন পর্যন্ত একজন ভোটারকে প্রতিদিন এক মিলিয়ন ডলার দান কার্যক্রম চালাচ্ছে- এই ভোটার যে দল সংশ্লিষ্টই হোক না কেন। যদি তারা ভোট দিতে এবং একটি পিটিশনে স্বাক্ষরের জন্য নিবন্ধিত হয়।
এর অংশ হিসেবে হ্যারিসবার্গ ও পিটসবার্গের ‘টাউন হল’ আয়োজনে ইলন মাস্ক বিজয়ীদের কাছে বিশাল লটারি স্টাইলের চেক উপস্থাপন করেন। সেখানে উৎসুক জনতা ‘ইলন’ স্লোগান দিচ্ছিল আর তাদের উদ্দেশে মাস্ক বলেন, এই জনতাদের শক্তিই তার আত্মাকে প্রজ্জলিত করে।
সম্প্রতি ফিলাডেলফিয়ায় এক সমাবেশে কংগ্রেসওম্যান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ বলেন, ‘আমাদের যারা জীবনের প্রয়োজন মেটাতে সংগ্রাম করছেন, তাদের সামনে ইলন মাস্ক এক মিলিয়ন ডলার ঝুলিয়ে লোভ দেখাচ্ছেন। যেন এই মানুষগুলো তার জন্য নাচেন।’
তিনি যোগ করেন, ‘ইলন মাস্ক মনে করেন যে আমাদের নির্বাচনের আগে একজন কর্মজীবী ব্যক্তির সামনে এভাবে অর্থ ঝুলানো একটি মজার ব্যাপার। কারণ ধনীরা এসবই করেন।’
কিছু পর্যবেক্ষক অবশ্য তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলছেন। তাদের মতে, ট্রাম্পের সাথে সম্পর্ক থেকে ইলন মাস্ক এবং তার ব্যবসা উপকৃত হবে।
এই পর্যবেক্ষকদের একজন বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জিং প্ল্যাটফর্ম চার্জওয়ের সিইও ম্যাট টেস্ক।
তার মতে, মাস্কের এমন রাজনৈতিক অবস্থান নেয়ার ব্যাপারটা বৈদ্যুতিক যানবাহন শিল্প জগতে অনেকের জন্যই কঠিন। তবে রাজনীতিতে তার ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তার কারণে এটি মোটেও অবাক হওয়ার মত বিষয় নয়।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, মাস্কের আগ্রহ মূলত তার ব্যবসার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত।’
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গর্ডনও এতে একমত। তার মতে, ইলন মাস্ক নিজেকে এমন একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখেন, যাকে নিয়ন্ত্রক দ্বারা আটকে রাখা হয়েছে। তিনি মনে করেন যে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রযুক্তির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে।’
অধ্যাপক গর্ডন বলেন, ‘তিনি সীমান্তে একজন বন্য আর অদম্য উদ্যোক্তা হতে চান। এমন কোনো নিয়মের মধ্যে আটকা পড়তে চান না, যাতে প্রযুক্তির অগ্রগতি ৫, ১০, ২০ বছর পিছিয়ে যায়।’
তিনি যোগ করেন, ‘মাস্ক অন্য পথে যেতে চান। তিনি মঙ্গল গ্রহে যেতে চান।’
ডোনাল্ড ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি নভেম্বরে জয়ী হলে মার্কিন সরকারের খরচ কমানোর ব্যাপারটা তদারকি করতে পারেন ইলন মাস্ক। এমনকি যদি তিনি সেই দায়িত্ব পালন না করেন, তবুও ইলন মাস্কের সমর্থনের জন্য ট্রাম্প তার কথা শুনবেন এবং মাস্ক প্রশাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পারেন বলে পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন।
ইলন মাস্ক বলেছেন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ‘শ্বাসরোধ’ করা ঠেকাতে একটি ‘সরকারি দক্ষতা বিভাগ’ করা হলে সেটার নেতৃত্ব দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী থাকবেন।
ডেমোক্র্যাটরা অবশ্য বলছেন, স্পেসএক্স ও টেসলার জন্য মাস্কের বিলিয়ন, বিলিয়ন সরকারি চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে মাস্কের এমন অবস্থান স্বার্থের জটিল দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়া গভর্নর গ্যাভিন নিউজমের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক উপদেষ্টা লেনি মেন্ডনকা বলেছেন, ‘এটি একইসাথে গভীরভাবে অনৈতিক ও অবৈধ।’
তিনি বিশ্বাস করেন, যারা এভাবে সরকার ও নিয়ন্ত্রকের সাথে সম্পর্কিত তারা ‘কথা বলতে পারে’। কিন্তু স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্তৃত্বের অবস্থানে তাদের থাকা উচিত নয়।
লরেন্স নোবেল, ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের একজন সাবেক জেনারেল কাউন্সেল, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইলন মাস্কের দান কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা জানি কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব ডিভাইসের মাধ্যমে কী করে। তারা তাদের মুনাফা, স্বার্থ-সংশ্লিষ্টদের লাভ আর সিইও ক্ষতিপূরণকে নিরাপদ রাখে এবং ব্যবসা করার খরচ হিসেবে নিরাপত্তা ইস্যুগুলোকে ব্যবহার করে।’
তিনি যোগ করেন, ‘যে ব্যক্তি ব্যবসাকে এভাবে দেখে, সরকারকে এভাবে দেখে, তাকে নিরাপত্তার দায়িত্বে রাখাটা বিপজ্জনক।’
কিন্তু তার ব্র্যান্ড এবং খ্যাতি যে এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে বাধা পড়ে গেছে। এ বিষয়টি ইলন মাস্কও জানেন বলেই তার কাজকর্ম থেকে বেশ স্পষ্ট।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা