০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২ মহররম ১৪৪৬
`

কাজ শুরু করেছেন নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার, ক্ষমা চাইলেন সুনাক

রাজা চার্লসের সাথে দেখা করে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী সুনাক - ছবি : বিবিসি

ব্রিটেনে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে গেল বেশ দ্রুততার সাথে। শুক্রবার (৫ জুলাই) রাজা চার্লসের সাথে সাক্ষাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান ঋষি সুনাক। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজার সাথে দেখা করেন কিয়ের স্টারমার। তাকে সরকার গঠন করার আমন্ত্রণ জানানো হয়।

বাকিংহাম প্যালেস থেকে ফিরেই মন্ত্রিসভা গঠনের কাজ শুরু করেছেন নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার। ডাউনিং স্ট্রিটে এসেছেন লেবার এমপি অ্যাঞ্জেলা রেনার। মিজ রেনারকে উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন র‍্যাচেল রিভস। অনেক বড় চ্যালেঞ্জ নিতে হবে সে ব্যাপারে অবগত আছেন জানিয়ে র‍্যাচেল বলেন, খুব বেশি অর্থ রেখে যাচ্ছে না পূর্বসূরীরা।

এর আগে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে বক্তব্য রাখেন কিয়ের স্টারমার। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ জরুরি এবং আজ থেকেই শুরু হচ্ছে।’

বক্তৃতার পর সস্ত্রীক ১০ নম্বর বাড়িটিতে প্রবেশ করেন তিনি।

তারও বেশ কিছু সময় আগে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক।

রেয়াজ অনুযায়ী উপস্থিত গণমাধ্যমকে ব্রিফ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

ফলাফল বিপর্যয়ের দায় নিজের কাঁধে তুলে নেন সুনাক। বলেন, ‘দেশবাসীর কাছে সবার প্রথমে যে কথাটা বলতে চাই তা হলো, আমি দুঃখিত। আমি সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছি, কিন্তু, আপনাদের রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে রায়ের মাধ্যমে আপনারা জানিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাজ্যে সরকারের পরিবর্তন দরকার।’

ব্রিটেনে সংসদের নিম্নকক্ষ হাউস অফ কমন্সে মোট আসন সংখ্যা ৬৫০টি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ৩২৬টি আসনে বিজয়ী হতে হয়।

প্রাপ্ত ফলাফল থেকে জানা যাচ্ছে, লেবার পার্টি ৪১২টি আসনে জয় পেয়েছে। আর কনজারভেটিভ পার্টির ঘরে গেছে ১২১টি আসন।

২০১৯ সালের তালিকা থেকে টোরিরা ২৫০টি আসন খুইয়েছে এবার। আর লেবাররা গত নির্বাচনের তুলনায় ২১১টি আসন বেশি পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করেছে।

এছাড়া লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ৭১টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এর বাইরে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির নয়টি আর রিফর্ম ইউকে চারটি আসন নিজেদের দখলে রাখতে সমর্থ হয়েছে।

এর আগে বুথ ফেরত জরিপেও লেবার পার্টির নিরঙ্কুশ জয়ের কথা বলা হয়েছিল।

নিজের আসনে জয়ের পর স্টারমার বলছিলেন ‘পরিবর্তনের সূচনা হলো এখান থেকেই, এটা আমাদের জন্য দেয়ার সময়’।

প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক পরাজয় মেনে নিয়ে স্টারমারকে টেলিফোন করে অভিনন্দন জানান।

রিফর্ম ইউকে দলের নেতা নাইজেল ফারাজ এবার প্রথম বারের মতো এমপি নির্বাচিত হলেন।

এছাড়া লেবার পার্টির সাবেক নেতা জেরেমি করবিনও নিজের আসনে জয় পেয়েছেন। স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন করবিন।

জর্জ গ্যালাওয়ে নিজের আসনে হেরে গেছেন।

স্কটল্যান্ডে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ডগলাস রস তার আসনে পরাজিত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে জিতেছেন লিবারেল ডেমোক্র্যাট প্রার্থী সিমাস লগান।

এটিই কনজারভেটিভ পার্টির ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে নির্বাচনী ফল। চৌদ্দ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২৫০ আসন হারিয়ে তারা এখন বড় ধরণের বিপর্যয়ে পড়েছে।

এর ফলে ২০১০ সালের পর আবারো একজন লেবার প্রধানমন্ত্রীর ঠিকানা হলো ডাউনিং স্ট্রিট। অন্যদিকে টোরিদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে লড়াই হবে কারণ ঋষি সুনাক নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কনজারভেটিভ অর্থাৎ টোরিরা লিবারেল ডেমোক্র্যাট ও নাইজেল ফারাজের রিফর্ম ইউকে পার্টির দিক থেকেও চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। কারণ এই দল দুটির মোট জনসমর্থন আগের চেয়ে বেড়েছে।

টোরি থেকে রিফর্ম ইউকে পার্টিতে যাওয়া লি অ্যান্ডারসন তার নতুন দলের হয়ে প্রথমবারের মতো অ্যাশফিল্ড আসনে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ওই আসনে দ্বিতীয় আসনে আছে লেবার পার্টির প্রার্থী।

এবার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল স্যার রবার্ট বাকল্যান্ড হলেন প্রথম টোরি এমপি যিনি তার নিজের আসনে পরাজিত হয়েছেন। তিনি বলেন, তার দল নির্বাচনী বিপর্যয়ের মুখে এবং লেবারদের জয় হলো ‘পরিবর্তনের জন্য বড় ভোট’।

তিনি নির্বাচনী প্রচারণা অপেশাদারিত্ব ও বিশৃঙ্খল আচরণের অভিযোগ তুলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যানসহ তার দলের কয়েকজন সহকর্মীর তীব্র সমালোচনা করেছেন।

তিনি বলছিলেন, ‘ব্যক্তিগত এজেন্ডা ও পদের জন্য তামাশা করা নিয়ে আমি খুব বিরক্ত’ এবং টোরি নেতৃত্ব নিয়ে সামনের প্রতিযোগিতার বিষয়েও সতর্ক করেন।

লেবার পার্টির এবার ভূমিধ্বস বিজয় ১৯৯৭ সালের টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে পাওয়া আসনের চেয়ে অল্প কিছু কম। সেবার ৪১৯ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ব্লেয়ার।

প্রথম নারী চ্যান্সেলর বা অর্থমন্ত্রী হতে যাওয়া র‍্যাচেল রিভস বলেছেন, ‘এটা পরিষ্কার ব্রিটেনের মানুষ পরিবর্তনের জন্য এবং স্যার কিয়ের স্টারমারের নেতৃত্বে ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যতের’ জন্য ভোট দিয়েছে।

জয়ের পর দেয়া ভাষণে তিনি বলছিলেন, ‘আমরা আপনাকে হারতে দেব না এবং শুরু করার জন্য আমার আর তর সইছে না’।

অন্যদিকে রিফর্ম ইউকের নাইজেল ফারাজ ‘অনেক, অনেক আসনে’ জয়লাভ করার অনুমান করলেও চারটিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। যদিও শূন্য আসন থেকে চার আসন পাওয়ার তাৎপর্যও কম নয়।

লিবারেল ডেমোক্র্যাটসরা ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে টোরিদের ভোট কমিয়েছে, যেখানে চ্যান্সেলর জেরেমি হান্ট ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্রান্ট শ্যাপসসহ কয়েকজন মন্ত্রী ঝুঁকিতে পড়েছেন।

দলটির নেতা স্যার অ্যাডভোকেট ড্যাভি বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে এক প্রজন্মের জন্য এটাই আমাদের সেরা ফল’।

দলটি কনজারভেটিভ পার্টি থেকে হ্যারোগেট ও কেনেয়ারসবরো আসন বড় ব্যবধানে ছিনিয়ে নিয়েছে।

লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টির চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা মন্ত্রী স্যার জ্যাকব রিস-মগ বলেছেন কনজারভেটিভদের জন্য এটি পরিষ্কারভাবে একটি হতাশার রাত। তিনি বলেন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট নিয়ে বরিস জনসন, লিজ ট্রাস ও সুনাকের টানাটানিকে ভোটাররা সরিয়ে দিয়েছেন।

স্কটিশ ডেপুটি ফার্স্ট মিনিস্টার কেইট ফোর্বস বলেছেন তার দল একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি।

কারণ, তারা ৩৮টি আসন হারিয়েছে।

লেবারের জন্য দারুণ রাত... কিন্তু মুসলিম ভোট
নির্বাচনে লেবার পার্টি দারুণ সাফল্য পেলেও মুসলিম ভোটের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি।

বিবিসির চিফ পলিটিক্যাল করেসপন্ডেন্ট হেনরি জেফম্যান লিখেছেন যে লেবার পার্টির জন্য রাতটি (নির্বাচনের ফল ঘোষণার) দারুণ ছিল। কিয়ের স্টারমারের নেতৃত্বে তারা এতো আসন পেয়েছে যা তারা ২০১৯-এর নির্বাচনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর চিন্তাই করেনি।

কিন্তু এ সাফল্যের মধ্যেও খুঁত আছে। কারণ বড় সংখ্যায় মুসলিম ভোট আছে এমন আসনে দলটি ভালো করেনি। ১০ শতাংশের বেশি মুসলিম ভোট আছে এমন আসনে দলটির ভোট কমেছে গড়ে ১০ শতাংশ।

লেস্টার পূর্ব আসনে কনজারভেটিভ প্রার্থীর কাছে হারার কারণ এটাই। আবার লেস্টার দক্ষিণে শ্যাডো মন্ত্রী জনাথন অ্যাশওয়ার্থ স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন তার কারণও এটি।

অধিক মুসলিম জনগোষ্ঠী আছে এমন পাঁচটি আসনে লেবার হেরে গেছে। এরমধ্যে চারটিতে স্বতন্ত্র আর একটিতে কনজারভেটিভ প্রার্থী জয়ী হয়েছে।

ক্ষমতাসীন দলের বড় যারা হারলেন
কনজারভেটিভ দলের এক ডজনের বেশি মন্ত্রী ও সিনিয়র সদস্য নির্বাচনে হেরে গেছেন।

হাউজ অব কমন্সের নেতা পেনি মরডন্ট নির্বাচনে হেরে বলেছেন ‘গণতন্ত্র কখনোই ভুল নয়’। প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্রান্ট শ্যাপস পার্লামেন্টে ছিলেন প্রায় ২০ বছর। তিনিও বিদায়ের পথে।

তিনি বলেছেন, ‘জনগণ বিভক্ত পার্টিকে ভোট দেয় না’। ব্রেক্সিটের পক্ষে থাকা বড় নেতা জ্যাকব রিস-মগ আর এমপি নন।

সাবেক বিচার মন্ত্রী স্যার রবার্ট বাকল্যান্ড তার পার্টির অন্য নেতাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন।

স্কটিল্যান্ডে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ডগলাস রস তার আসনে পরাজিত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে জিতেছেন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী সিমাস লগান।

ওয়েলসে কোনো আসন নেই কনজারভেটিভদের
ওয়েলসে লেবার পার্টি আগের চেয়ে নয়টি আসন বেশী পেয়েছে। এখন তাদের মোট আসন ২৭।

অন্যদিকে কোনো আসনই পায়নি কনজারভেটিভ পার্টি।

প্লাইড কামরির এখন পার্লামেন্টে চারটি আসন।

আর লিবারেল ডেমোক্র্যাটিকরা পেয়েছে একটি আসন।

বরিস জনসনের আসনেও পরাজয় দলীয় প্রার্থীর
বরিস জনসনের আসনে এবার জয় পেয়েছে লেবার পার্টির প্রার্থী। গত বছর তিনি এমপি পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে উপনির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে আসনটি ধরে রেখেছিলো টোরি প্রার্থী স্টিভ টাকওয়েল।

এবার লেবার পার্টির ডেনি বিলস কনজারভেটিভ প্রার্থীকে হারিয়ে আসনটি জিতে নিলেন। অন্যদিকে সাবেক কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস ৬০০ ভোটে হেরে গেছেন।

দু’বছরের কম সময় আগে তিনি অল্প কিছুদিনের জন্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

এদিকে ঋষি সুনাক ইয়র্কশায়ারে নিজের আসনে জিতেছেন। যেহেতু কনজারভেটিভ পার্টির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনে জিতেছে সে কারণে সুনাক পার্লামেন্টে বিরোধী দলীয় নেতা হতে পারেন।

তবে এটি নির্ভর করবে তিনি দলের প্রধান হিসেবে থাকতে চান কি-না তার ওপর।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement