১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে ব্রিটেনে সহিংসতা

- ছবি - বিবিসি

ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সমর্থকদের সংঘর্ষের খবর উপমহাদেশ থেকে প্রায়ই পাওয়া যায়। কিন্তু সেখান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে যুক্তরাজ্যের একটি শহরে দু’দল ক্রিকেট সমর্থকের সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় পরিণত হয়েছে- এমন খবর নজিরবিহীন। কিন্তু মধ্য ইংল্যান্ডের লেস্টার শহরে এমনটাই ঘটছে গত বেশ কিছুদিন ধরে।

প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে শহরটিতে থেমে থেমে সহিংসতা চলছে। পুলিশ বলছে, এ পর্যন্ত ৪৭ জনকে গ্রেফতার এবং দু’জনের কারাদণ্ড হয়েছে।

অস্ত্র রাখার দায়ে অ্যামোস নরোনহা নামে একজনের ১০ মাসের কারাদণ্ড হয়েছে। লেস্টারের ইলিংওয়ার্থ রোডের এ বাসিন্দার বয়স ২০ বছর। তিনি আদালতে অস্ত্র রাখার কথা স্বীকার করেছেন।

অ্যাডাম ইউসুফ নামে লেস্টারের ব্রাইন স্ট্রিটের বাসিন্দা ২১ বছরের আরেক ব্যক্তিকে ছুরি রাখার দায়ে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

সংঘর্ষের সময় আহত হয়েছে ২৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা। তবে তাদের আঘাত গুরুতর নয়। এছাড়া আহত হয়েছে পুলিশের একটি কুকুরও।

শনিবার গ্রেফতার হওয়া দু’জনের একজনের কাছে ‘ধারালো অস্ত্র’ পাওয়া গেছে। আর অন্যজনের বিরুদ্ধে ‘সহিংস বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ রয়েছে বলে পুলিশ জানাচ্ছে।

কর্মকর্তারা আরো বলেছেন, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কমপক্ষে আটজন লেস্টারের বাইরে বার্মিংহ্যামের মতো অন্য শহর থেকে আসা।

শহরের পূর্বাঞ্চলে সারা রাত ধরে পুলিশী টহল চলছে এবং গত কয়েক ঘণ্টায় নতুন কোনো বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি। তবে লেস্টার শহরের দক্ষিণ এশীয়-অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় পরিস্থিতি বেশ থমথমে।

মঙ্গলবার লেস্টার শহরের পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলেন সাংবাদিক এ এস এম মাসুম।

তিনি জানালেন, শহরের অ্যাশফোর্ড এলাকায় একটি মসজিদের সামনে সেদিন দুপুরে হিন্দু ও মুসলিম কমিউনিটির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘শান্তি সভা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সেখান থেকে নেতারা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকজনের প্রতি শান্তি বজায় রাখতে এবং সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানাচ্ছেন।

লেস্টারশায়ার কাউন্টির ইকুয়ালিটি ও হিউম্যান রাইটস কর্মকর্তা কাজী মাসউদ বলছিলেন, শহর কেন্দ্রে লোকজনকে বড় দল নিয়ে চলাচল করতে নিষেধ করা হয়েছে।

লেস্টারের লোকজন সেখানকার মেয়রের সমালোচনা করছেন এই বলে যে শহরের পুলিশ বাহিনী তার নিয়ন্ত্রণে হলেও তিনি সহিংসতা দমনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে দেরি করেছেন।

শহরের প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা রব নিক্সন বলেছেন, উত্তেজনা সৃষ্টির পেছনে সামাজিক মাধ্যম ছড়ানো ভুয়া খবর বড় ভূমিকা পালন করেছে।

সহিংসতা নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের হাইকমিশন। গত বেশ কিছুদিন ধরে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুসংক্রান্ত খবরের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য ও উপমহাদেশের সংবাদমাধ্যমেও এ সহিংসতার ঘটনাও ছিল বড় খবর।

যুক্তরাজ্যে ভারত ও পাকিস্তানের হাইকমিশন থেকেও এ ঘটনা নিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে।

লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের এক বিবৃতিতে লেস্টারের ঘটনাবলীতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, লেস্টার শহরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে পরিকল্পিত সহিংসতা ও ভীতিপ্রদর্শন চলছে আমরা তার তীব্র নিন্দা করি। লেস্টারে এ ধরনের ইসলামবিদ্বেষী ঘটনার খবর এটাই প্রথম নয়।

অন্যদিকে ভারতীয় হাইকমিশন রোববার এক বিবৃতিতে বলেছে, লেস্টার শহরে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে সহিংসতা চালানো হয়েছে, হিন্দু ধর্মীয় স্থান ও প্রতীকের যে ক্ষতিসাধন করা হয়েছে আমরা তার তীব্র নিন্দা করি এবং এতে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছি।

দাঙ্গার শুরু কোথায়, কিভাবে
মধ্য ইংল্যান্ডের লেস্টার শহরটি লন্ডন শহর থেকে এক শ’ মাইল দূরে। তিন লাখের বেশি জনসংখ্যার এ শহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত।

লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তান সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ এখানে আগেও হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকেরা। তবে সে সহিংসতা এবারের মত গুরুতর আকার কখনো নেয়নি।

সাংবাদিকরা বলছেন, এবার শুধু স্থানীয়রা নয়, লেস্টারের আশপাশের অন্য শহরগুলো থেকেও লোকজন এসে সংঘর্ষে যোগ দিয়েছে, যা নজিরবিহীন।

ঘটনার শুরু সদ্যসমাপ্ত এশিয়া কাপ টুর্নামেন্টে গত ২৮ আগস্ট ভারত-পাকিস্তান যে ম্যাচটি হয়েছিল সেখান থেকে।

ওই টুর্নামেন্টের দু’দলের প্রথম ম্যাচটিতে ভারত পাকিস্তানকে হারায়। এরপর সেই বিজয় উদযাপন করতে লেস্টার শহরের বেলগ্রেভ, মেল্টন রোড ও শ্যাফটসবেরি এভিনিউ এলাকায় রাস্তায় নেমে আসে শত শত যুবক।

স্থানীয়রা বলেছেন, এদের অনেকে গুজরাট অঞ্চলের একটি সাবেক পর্তুগিজ উপনিবেশ দামান থেকে আগত ভারতীয় বংশোদ্ভূত সম্প্রদায়ের লোক।

পুলিশ বলেছে, সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিওর ব্যাপারে তদন্ত করা হচ্ছে - যেগুলোতে 'বর্ণবাদী ও ঘৃণাপূর্ণ' শ্লোগান দেয়া হচ্ছিল।

স্থানীয় একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের খবরে বলা হয়, জনতার মধ্যে থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে শোনা যায়। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত কিছু ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একদল লোক মিলে এক ব্যক্তির টি-শার্ট ছিঁড়ে ফেলছে এবং তারপর এই লোকটিসহ কয়েকজনকে মারধর করছে।

লেস্টারশায়ার লাইভ নামে একটি অনলাইন পোর্টালের রিপোর্টে বলা হয়, একজন পুলিশ কর্মকর্তাও এসময় জনতার হাতে আক্রান্ত হন। পুলিশ এদিনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আটজনকে গ্রেফতার করে।

পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে ওঠে শনিবার
সহিংস ঘটনার শুরু হয়েছিল প্রধানত বেলগ্রেভ এবং স্পিনি হিল এলাকায়। এরপর থেকেই শুরু হয় ভারত ও পাকিস্তান সমর্থকদের বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ এবং তা কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে চলতে থাকে।

এশিয়া কাপে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিতীয় একটি ম্যাচ ছিল ৪ সেপ্টেম্বর যাতে পাকিস্তান ভারতকে হারায়। এর পর আবার সহিংসতা শুরু হয়।

এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে আর পুলিশ সাত দিনে কমপক্ষে ১৮ জনকে জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের সন্দেহে গ্রেফতার করে।

তাদের বিরুদ্ধে ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র রাখা, হত্যার হুমকি দেয়া, মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানো, দলবদ্ধ মারামারি এরকম নানা অভিযোগ ছিল। পরে অবশ্য এদের অনেকেই জামিনে ছাড়া পায়।

শনিবার ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতি আবার গুরুতর হয়ে ওঠে।

সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে গ্রিন লেন এলাকায় যেখানে বেশ কিছু মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কাছেই একটি হিন্দু মন্দিরও আছে- সেখানে একদল বিক্ষোভকারী মিছিল করে যাওয়ার সময় 'জয় শ্রীরাম' বলে শ্লোগান দেয়।

বেলগ্রেভ এলাকায় কমিউনিটি কর্মী মাজিদ ফ্রিম্যান যিনি টুইটারে এসব ঘটনার ভিডিও পোস্ট করেছেন। তাকে উদ্ধৃত করে দৈনিক গার্ডিয়ান জানিয়েছে, এ সময় বোতল ছোঁড়া এবং মুসলিমদের লক্ষ্য করে ব্যঙ্গবিদ্রুপ এবং মারধরের ঘটনা ঘটে।

লেস্টার শহরের পূর্ব অংশে এদিন দুই সম্প্রদায়ের পাল্টাপাল্টি মিছিল বের হয় এবং পুলিশ তাদের পথরোধ করে।

তাতেও সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি। দু’পক্ষের মধ্যে বোতল ছোঁড়াছুঁড়ি, হাতাহাতি হয়, বেশকিছু গাড়ির ক্ষতি করা হয়।

সামাজিক মাধ্যমে দু’গ্রুপের এসব সংঘর্ষের বেশ কিছু ভিডিও বের হয়। এর মধ্যে একটিতে দেখা যায়, এক দল লোক মেল্টন রোডে একটি ধর্মীয় স্থানের বাইরে একটি পতাকা ছিঁড়ে ফেলছে।

গত কিছুদিনে অনুষ্ঠিত এসব পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ ও সমাবেশ কর্তৃপক্ষের কোনো রকম অনুমতি ছাড়াই হচ্ছিল বলে স্থানীয় লোকেরা বলছেন।

কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যার তুলনায় পুলিশের সংখ্যা ছিল খুবই কম এবং ঘটনা সামাল দিতে তাদের বেগ পেতে হয়েছে।

লেস্টারের বাইরে থেকে লোক আনা হয়
সাংবাদিক এ এস এম মাসুম বলছিলেন, এসব সংঘর্ষে স্থানীয় মুসলিমদের অবস্থান প্রথমে রক্ষণাত্মক থাকলেও পরে তা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে থাকে।

এ সময় হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে কাছাকাছি অন্য শহর থেকে মুসলিমদের এ বিক্ষোভে যোগ দিতে আহ্বান জানানো হতে থাকে।

মাসুম আরো বলেছেন, এরকম কিছু বার্তা তিনি নিজেও দেখেছেন। ব্যাপারটা এখন শুধু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমিত নেই। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মুসলিম তরুণরাও কেউ কেউ এসব বিক্ষোভে জড়িয়ে পড়ছে বলেন তিনি।

পুলিশ কর্মকর্তা রব নিক্সনও বিবিসির কাছে নিশ্চিত করেছেন যে, সামাজিক মাধ্যমে লোকজনকে লেস্টারে গিয়ে মারামারিতে যোগ দিতে উস্কানো হয়েছে।

তিনি বলছিলেন যে এখনো এসব বিক্ষোভ-সহিংসতা লেস্টার শহরের কিছু এলাকাতেই সীমিত আছে তবে আতঙ্কটা পুরো শহর জুড়েই আছে।

শুধু তাই নয়, আগামী কিছুদিন পরই দিওয়ালি উৎসব এবং এ সময় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির ফলে আগামী দিনগুলোতে কী হয় তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছেন কমিউনিটিগুলোর নেতারা।

লেস্টার শহরের মেয়র কী বলছেন
দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে থেমে থেমে চলতে থাকা এই নজিরবিহীন সহিংসতার পর লেস্টারের হিন্দু ও মুসলিম উভয় কমিউনিটির নেতারাই শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন।

লেস্টারভিত্তিক মুসলিম সংগঠনগুলোর ফেডারেশনের একজন নেতা সুলেমান নাগদি বিবিসিকে বলছিলেন, কিছু তরুণ আছে যারা খুবই অসন্তুষ্ট এবং তারা ক্ষতিকর ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমাদের এ বার্তা দিতে হবে যে এর অবসান হতেই হবে এবং অভিভাবকদের দিয়ে আমরা চেষ্টা করছি যেন তারা তাদের ছেলেদের সাথে কথা বলেন।

লেস্টারের হিন্দু ও জৈন মন্দিরগুলোর প্রতিনিধি সঞ্জীব প্যাটেল বলছেন, সহিংসতা কোনো সমাধান নয়, এখন শান্তির সময়।

কথা হচ্ছিল লেস্টারের একজন কাউন্সিলর শহিদ খানের সাথে। তিনি পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছিলেন, ‘আমরা এখানে বহুকাল ধরে হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি বাস করছি, কখনো এমন অবস্থা হয়নি।’

শহরটির মেয়র স্যার পিটার সোল্সবি বলেছেন, তিনি নিজে এবং কমিউনিটি নেতারাও এ ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন। তার মতে, সামাজিক মাধ্যমে অত্যন্ত বিকৃত প্রচারের কারণে উত্তেজনা আরো বেড়েছে।

তিনি বলেন, আমরা প্রায়ই লেস্টারে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভালো সম্পর্কের কথা বলি। কিন্তু এ নিয়ে আত্মসন্তুষ্টির কোনো অবকাশ নেই।

সোল্সবি বলেন, সম্পর্ক ভালো রাখার কাজ সব সময়ই চলমান। তবে এটা খুবই স্পষ্ট যে এক্ষেত্রে আরো কাজ করতে হবে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement