২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়া মালাজিকার্দ যুদ্ধ দিবস আজ

ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়া মালাজিকার্দ যুদ্ধ দিবস আজ - ছবি : সংগৃহীত

 

মালাজিকার্দের যুদ্ধ সম্পর্কে পড়তে গিয়ে আমি বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থেকেছি; আমার চিন্তা বারবার জট পাঁকিয়ে এসেছে। আমি শুধু ভেবেছি- এটাও সম্ভব!

আমার ধারণা- আপনিও যদি এই যুদ্ধ সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জানেন এবং অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন, তাহলে আমার বক্তব্যের সাথে একমত হবেন।

তুঘরুল বেগের মৃত্যুর পর তার ভাতিজা আল্প আরসালান সেলজুকদের সিংহাসনে আরোহন করেন। আমরা মালাজিকার্দে অনুষ্ঠিত যে যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে যাচ্ছি, তাতে মুখোমুখি হয়েছিলেন সুলতান আল্প আরসালান এবং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য। এই যুদ্ধে সম্রাট স্বয়ং নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

বাইজান্টাইন সৈন্যরা প্রায়ই মুসলিম অঞ্চলে এসে হানা দিচ্ছে; যাচ্ছেতাইভাবে লুটপাট চালাচ্ছে। ইসলামী সাম্রাজ্যে ভীতি সঞ্চার করা এবং সেখানে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। সুলতান আল্প আরসালান দেখলেন- এদের যদি বেশি বাড়তে দেয়া হয়, তাহলে মুসলিমদের কলিজায় আঘাত করতে পারে। সে মোতাবেক বাইজান্টাইনদের শায়েস্তা করার উদ্দেশে তিনি আর্মেনিয়া হয়ে আনাতলিয়ার দিকে এগিয়ে চললেন।

হিজরি ৪৬৩ সাল; ১০৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট।
সুলতান আল্প আরসালান আনাতলিয়ার বেশ ভেতরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এতদিন বাইজান্টাইনরা তেমন কোনো প্রতিরোধ না করলেও এবার রুখে দাঁড়ালো। সম্রাট রোমানুস রাশিয়ান, জর্জিয়ান, রোমান, ফরাসি ও অন্যান্য দেশ থেকে সেনা সংগ্রহ করে সুলতানকে শায়েস্তা করার জন্য বিশাল এক সেনাবাহিনী প্রস্তুত করে নিজেই রওনা হলেন।

ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় এই সেনাবাহিনীতে দুই লাখ অথবা তিন লাখ সেনা উপস্থিত ছিল। আর মুসলিম বাহিনীর সেনাসংখ্যা কত ছিল, জানেন? মাত্র ১৫ হাজার।

সুলতান বুঝে গেলেন যুদ্ধ অনিবার্য। এখান থেকে ফিরে আসার কোনো উপায় নেই। এদিকে তিনি মুসলিম প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু থেকে বহু দূরে অবস্থান করছেন। নতুন কোনো বাহিনী তার সাথে যুক্ত হবে সে উপায়ও নেই।

সুলতান আল্প আরসালান দূত পাঠালেন সন্ধির জন্য। কিন্তু সম্রাট এই প্রস্তাব দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন, 'এটা অসম্ভব! রায় নগরী ধ্বংস না করে আমি ক্ষান্ত হবো না।' সুলতান যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। সামনে হতে চলেছে বিশাল সেনাবাহিনীর সাথে এক অসম লড়াই। একটু চোখ বুজে অনুমান করুন তো- কেমন হতে পারে এই যুদ্ধের ফলাফল!

ওই দিন ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজে ইমামতি করলেন সুলতান নিজেই। নামাজ শেষে সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে আবেগভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, 'এই মুহূর্তে আমি নিজেকে তাদের সামনে পেশ করতে চাই, যখন মিম্বরে মিম্বরে মুসলিম বাহিনীর জন্য দোআ করা হচ্ছে। এরপর হয়ত আমি লক্ষ্যে পৌঁছাবো, নয়ত শহিদ হয়ে জান্নাতে চলে যাবো। তোমাদের মধ্য থেকে যার ইচ্ছে হয় আমাকে অনুসরণ করুক। আর যে চলে যেতে চায় সে নির্দ্বিধায় চলে যেতে পারে।'

আল্লাহর সৈনিকেরা সমস্বরে বলে উঠলো, 'আপনি যা করবেন আমরা তা অনুসরণ করবো এবং আপনি সব সময় আমাদের পাশে পাবেন।'

সুলতান সাদা পোশাকে নিজেকে আবৃত করে নিলেন। তিনি বললেন, 'আমি মারা গেলে এটিই হবে আমার কাফন।'

এমন চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে যারা যুদ্ধে নামেন, তাদের কি আল্লাহ পরাজিত হতে দেন! তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। সুলতান আল্প আরসালান এবং মুসলিম বাহিনী এই যুদ্ধে সর্বোচ্চ বীরত্ব প্রদর্শন করলেন। মাত্র ১৫ হাজারের মুসলিম বাহিনীর কাছে দুই লাখ সেনার বাইজান্টাইন বাহিনী পরাজিত হলো। সম্রাট রোমানোস হলেন বন্দী।

সম্রাটকে সুলতানের সামনে হাজির করা হলো। সুলতান বললেন, 'আপনি বিজয়ী হলে আমার সাথে কী আচরণ করতেন?' 'যাবতীয় কুৎসিত আচরণ।'

'আপনি আমার কাছে কী প্রত্যাশা করেন এবং আমার সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?'
'আমাকে হত্যা করবেন বা আপনার দেশে নিয়ে জনসম্মুখে অপমান করবেন। আর তৃতীয় হলো- মুক্তিপণ গ্রহণ করে ক্ষমা করবেন। কিন্তু এটা তো অসম্ভব।'
সুলতান বললেন, 'আমি শেষোক্ত সিদ্ধান্তটিই নিয়েছি।'
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫ লাখ দিনার মুক্তিপণের বিনিময়ে সম্রাট নিজেকে এবং বন্দীদের মুক্ত করে নিয়ে যান।

মালাজিকার্দের যুদ্ধে পরাজয়কে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই যুদ্ধ আনাতোলিয়ায় মুসলিমদের বসতি স্থাপনে সহায়ক হয় এবং এই বিজয়ের হাত ধরে পরবর্তী সময়ে ওসমানিয়া সুলতান মোহাম্মাদ আল ফাতিহের হাত ধরে কনস্টান্টিনোপল বিজয় হয়।

এখন প্রশ্ন হলো- কোন ঈমানের বলে সেদিন মুষ্টিমেয় কিছু যোদ্ধা তাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি সংখ্যক যোদ্ধার মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন? আমাদের কোনো মুসলিম নেতা কি পারেন না মালাজিকার্দ যুদ্ধের পূর্বে বলা সুলতান আল্প আরসালানের সেই বিখ্যাত উক্তিটি করে শক্তভাবে ইসলামের পক্ষে দাঁড়াতে? সেদিন যুদ্ধের আগে কী বলেছিলেন সুলতান আলপ আরসালান?

'আল্লাহর জন্য স্বয়ং আমি নিজের জীবন উৎসর্গ করছি। যদি আমি শাহাদাত লাভে ধন্য হই, তাহলে ধূলির ধরা থেকে সবুজ পক্ষীকূলের গর্ভে হবে আমার সমাধি। আর যদি আমি জয়ী হই, তাহলে আজকের দিনটিই হবে সবচেয়ে সৌভাগ্যমণ্ডিত এবং আমার আজকের দিনটি হবে বিগত দিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।'

তথ্যসূত্র : সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস- ড. আলি মুহাম্মদ সাল্লাবি; মুহাম্মদ পাবলিকেশন ও ইসলামের ইতিহাসে যুদ্ধ- সাদিক ফারহান; মাকতাবাতুল আসলাফ


আরো সংবাদ



premium cement