২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

তালেবানের মোকাবেলা কিভাবে করবে তুরস্ক?

তালেবানের মোকাবেলা কিভাবে করবে তুরস্ক? - ছবি : সংগৃহীত

আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সৈন্য প্রত্যাহারের পর তুরস্ক সেখানে তাদের সৈন্য মোতায়েন রাখার একটি পরিকল্পনা করছে বলে জানা যাচ্ছে।

বিবিসি মনিটরিং-এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, গত ১৪ জুন ব্রাসেলসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়িপ এরদোগান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে যে বৈঠক হয়, সেখানে আফগানিস্তানে তুরস্কের সৈন্য রেখে দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।

তখন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছিলেন, আলোচনার সময় দুই নেতা একমত হয়েছেন যে কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সুরক্ষায় তুরস্ক এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

তুরস্কে অনেকেই এটিকে ঐ অঞ্চলে তাদের শক্তি ও প্রভাব বাড়ানোর একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন।

তবে তালেবান যখন খুবই দ্রুতগতিতে আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিচ্ছে, সেখানে যখন বিরাট নিরাপত্তা হুমকি তৈরি হচ্ছে - তখন কেন তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের এরকম প্রস্তাবে সাড়া দিলো, তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সমালোচনাও করছেন অনেকে।

তুরস্কের পরিকল্পনাটা ঠিক কী?

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে বলা হচ্ছে, আফগানিস্তানে তুরস্কের মূল ভূমিকা হবে কাবুল বিমান বন্দরের ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

কাবুলের এই বিমানবন্দরের মাধ্যমেই আফগানিস্তান বাকি বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত। তালেবান যদি কাবুল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থাই আর আফগানিস্তানে তাদের প্রতিনিধি রাখতে পারবে না।

তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকারকে উদ্ধৃত করে একটি তুর্কি নিউজ ওয়েবসাইট বলছে, বিভিন্ন দেশ অন্তত এরকম কথাই বলেছে। তাদের মত হচ্ছে, কাবুলের এই বিমানবন্দরকে সুরক্ষিত রাখা দরকার, কারণ এটি যদি বন্ধ হয়ে যায়, অন্যান্য দেশকে তাদের কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করতে হবে, সেখানে মিশন বন্ধ করে দিতে হবে।

উল্লেখ্য, এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে কাবুলে তুরস্কের ৫০০ সৈন্য মোতায়েন আছে। তবে তুরস্কের সৈন্যরা সেখানে কোনো ধরনের লড়াইয়ে লিপ্ত নয়। এছাড়া একটি ন্যাটো মিশনের অধীনে তুরস্ক আফগানিস্তানের সৈন্যদের প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে।

তুরস্কের একটি সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী, আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত আছে।

গত ৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই বিবৃতিতে বলেন, আফগানিস্তানে তুরস্কের ভূমিকার ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিন্তু এর বিস্তারিত আর কিছুই জানানি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে যে কূটনৈতিক, আর্থিক এবং অন্যান্য সহযোগিতা, তার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি পাকিস্তান ও হাঙ্গেরির মধ্যেও সহযোগিতার কথা বলেছিলেন, কিন্তু এরও কোনো বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি।

তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকার অবশ্য একথা অস্বীকার করেছেন যে তুরস্ক আফগানিস্তানে আরো সৈন্য পাঠাচ্ছে। তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন যে আফগানিস্তানে এখন যে সংখ্যক তুর্কি সৈন্য মোতায়েন আছে, তাদের সংখ্যা এর চেয়ে বাড়ানো হবে না।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আফগানিস্তানের বিষয়টিকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করছেন বলে সমালোচকরা অভিযোগ করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কে এর কী প্রভাব পড়বে
অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, আফগানিস্তানে তুরস্ক তাদের উপস্থিতি বজায় রাখার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে চায়।

তুরস্ক যদিও ন্যাটো জোটের সদস্য, তারপরও সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্কে অনেক টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র কেনা নিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কের সাবেক রাষ্ট্রদূত নামিক টানের মতে, তুরস্ক যে আফগানিস্তান মিশনের আংশিক দায়িত্ব নিতে চাইছে, তার পেছনে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কিছু স্বার্থ আছে। তিনি আসলে এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাথে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়তে চাইছেন, কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও।

তুরস্কের সরকারবিরোধী একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবাদপত্র 'ডেমোক্রেসি' অবশ্য কেবল যুক্তরাষ্ট্রের মন রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট এরদোগানের এই পরিকল্পনার সমালোচনা করেছে।

পত্রিকাটি মন্তব্য করেছে যে, তুরস্ক আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ভালো করার জন্য আফগানিস্তানের বিষয়টিকে ব্যবহার করছে।

অনেক বিশ্লেষক তুরস্কের এই ভূমিকাকে ১৯৫০ হতে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কোরিয়ান যুদ্ধের সময়ের ভূমিকার সাথে তুলনা করছেন।

তুরস্ক ঐ যুদ্ধের সময় ২১ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছিল, এর মধ্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গিয়েছিল ৯৬৬ জন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ওই যুদ্ধে সৈন্য পাঠানোর বিনিময়ে তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হতে পেরেছিল।

তুরস্কের সরকা বিরোধী বামপন্থী পত্রিকা ইভানসেলের কলামিস্ট সিনান বারডাল লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্কে অনেক উঠা-নামা দেখা গেছে। তবে একটা বিষয় এখনো বদলায়নি।

তিনি বলেন, তুরস্ক সৈন্য পাঠিয়েছে কোরিয়া ও আফগানিস্তানে, কিন্তু নীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র সবসময় তার হাতেই রেখেছে। সেখানে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে এই আলোচনা যখন অব্যাহত আছে, তখন মার্কিন কর্মকর্তারা আফগানিস্তানে তুরস্কের উপস্থিতিকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সমর্থকরা দাবি করেন, আফগানিস্তানে যদি তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি অব্যাহত থাকে, সেটি ওই অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাব বাড়াতে সহায়ক হবে, তাদের আন্তর্জাতিক মর্যাদাও বাড়বে।

একটি সরকারপন্থী নিউজসাইট স্টারের কলামিস্ট রাসুল টাউসেইন্ট বলেন, 'তুরস্কের এখন যে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, তাতে তারা আফগানিস্তানে তাদের উপস্থিতি বজায় রাখতে পারে। তুরস্ক এক উদীয়মান শক্তি এবং নিঃসন্দেহে এক আঞ্চলিক শক্তি। আফগানিস্তানে থেকে যাওয়ার মাধ্যমে তুরস্ক তার শক্তি আরো বাড়াতে পারে।'

তিনি আরো লিখেছেন, তুরস্কের উচিত একই কারণে আফগানিস্তানে থেকে যাওয়া, যে কারণে তারা লিবিয়া, সোমালিয়া, কাতার, আজারবাইজান, সিরিয়া এবং ইরাকে গেছে। আফগানিস্তানে তার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের ভূমিকাকে শক্তিশালী করবে।

আরেকটি সরকারপন্থী পত্রিকা মিলিশিয়ার কলামিস্ট ইব্রাহিম ওকবাবা লিখেছেন, আফগানিস্তান বিশ্ব রাজনীতিতে তুরস্ককে এক নতুন অবস্থানে নিয়ে যাবে। এটি তুরস্ককে অন্যতম আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত করবে। রাশিয়া, চীন, ভারত ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বিচারে তুরস্ক নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় চলে আসবে।

কোনো কোনো বিশ্লেষক তুরস্কের সঙ্গে আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করছেন।

মিলিশিয়ার আরেক কলামিস্ট টনকা বানকিন লিখেছেন, দুটি দেশের মধ্যে এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। তুরস্কের পররাষ্ট্র দফতরের মতে, ১৯২০ হতে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তুরস্ক আফগানিস্তানের আধুনিকায়নে সাহায্য করেছিল।

আফগানিস্তানে ন্যাটোর সাবেক বিশেষ দূত হেকমত স্টেইন বলেন, আতাতুর্কের সময় হতেই তুরস্ক ও আফগানিস্তানের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে গভীর সম্পর্ক ছিল। তুরস্ক এবং তুরস্কের সৈন্যদের ব্যাপারে আফগানিস্তানের মানুষ খুবই উষ্ণ হৃদ্যতা পোষণ করে।

তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকারও গত ৭ জুন বলেন, দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবেই ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক আছে। আফগানিস্তানের জনগণ যত দিন চায়, তত দিনই আমরা সেখানে থাকতে চাই। আমরা তাদের সাহায্য করতে চাই।

কিন্তু তুরস্কের জন্য কী ঝুঁকি তৈরি হতে পারে

আফগানিস্তানে যেরকম দ্রুতগতিতে আবার তালেবানের উত্থান ঘটছে, তাতে অনেক বিশ্লেষক সেখানে তুরস্কের থেকে যাওয়ার পরিকল্পনাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন। তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ তুরস্কে একটি 'ভ্রাতৃপ্রতিম ইসলামী দেশ' বলে বর্ণনা করেন।

কিন্তু তিনি তিনি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তুরস্ক যেহেতু ন্যাটোর সদস্য, তাই তারা ওয়াশিংটন ও আংকারার মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না।

তুরস্কের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল টিআরটিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তালেবান তুরস্কের সামরিক উপস্থিতির বিরোধিতা করবে এবং কাবুল বিমান বন্দর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে সেটিকে তারা বিদেশি হস্তক্ষেপ বলে বিবেচনা করবে।

সাবেক এক তুর্কি সামরিক কর্মকর্তা নেজাত এসলান গত ২৮ জুন বলেছেন, তালেবানের এধরণের কথাবার্তায় তুরস্কের সাথে তালেবানের সম্ভাব্য সংঘাতের আশঙ্কা বাড়ছে।

তার মতে, কাবুল বিমানবন্দরে তুর্কি সেনা মোতায়েন হবে এক ঐতিহাসিক ভুল এবং এটি তুরস্কের স্বার্থের পক্ষে যাবে না।

তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির সদস্য আতকো জাকরিুজের বলেন, তালেবান আফগানিস্তানে কোনো বিদেশি সৈন্য দেখতে চায় না। কাজেই এখানে অনেক অনিশ্চয়তা আছে। এটা বোঝা মুশকিল কেন এরদোগান সরকার সেখানে থেকে যাওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ো করছে।

এরপর কী?
প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়িপ এরদোগান বলেছেন, তুরস্ক তালেবানের সাথে আলোচনা করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রও তালেবানের সাথে আলোচনা চালিয়েছে।

তিনি বলেছেন, তালেবান তুরস্কের সাথে অনেক সহজে আলোচনা করতে পারবে। কারণ তুরস্ক তালেবানের বিপক্ষে নয়।

অন্যদিকে তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ অনেক কঠোর মন্তব্য করলেও তার সংগঠন পরে তুরস্কের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে বলে জানিয়েছেন।

তুরস্ক তাদের পরিকল্পনা নিয়ে আফগান সরকার এবং পাকিস্তানের সাথেও কথা বলছে। কিন্তু আফগানিস্তানের বর্তমান অনিশ্চিত অবস্থার কারণে এবং তালেবান যেভাবে সেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ আরো শক্ত করছে, কাবুল বিমান বন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাদের শিগগিরই নিতে হবে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement