সাইপ্রাসের যে ম্যালেরিয়া নির্মূলকারী ‘বীর’কে সবাই ভুলে গেছে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৩ মে ২০২১, ২৩:৩০
তাকে বলা হতো ‘এক মহান মুক্তিদাতা। তার নাম ছিল মেহমেত আজিজ। ভূমধ্যসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র সাইপ্রাস গত শতাব্দীতে যা কিছু অর্জন করেছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কীর্তিগুলোর একটির পেছনে ছিলেন এই মেহমেত আজিজ। কিন্তু অল্প কিছু সাইপ্রিয়ট ছাড়া আর বিশেষ কেউই তার নাম শোনেনি।
আজিজ ছিলেন একজন তুর্কী সাইপ্রিয়ট স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। সে সময় সাইপ্রাসে প্রতি বছরই ম্যালেরিয়া হতো। কিন্তু মেহমেত আজিজ বিশ্বে প্রথমবারের মতো একটি ম্যালেরিয়া-প্রবণ দেশ থেকে এই রোগটি সম্পূর্ণ নির্মূল করতে পেরেছিলেন।
তার সহকর্মীরা তাকে ডাকতেন ‘দ্য ফ্লাই ম্যান’ বলে। সেসময়কার নোবেল পুরস্কারজয়ী ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ স্যার রোনাল্ড রসের কাছে অধ্যয়ন করেছিলেন এই মেহমেত আজিজ।
এ্যানোফিলিস নামে বিশেষ এক ধরনের মশার মাধ্যমেই যে ম্যালেরিয়া ছড়ায় তা প্রথম প্রমাণ করেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস।
সেটা ১৯৩৬ সালের কথা। সাইপ্রাস তখন ছিল একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ। দেশটিতে তখন ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ছিল ব্যাপক। প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার লোক ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতো। বিশেষ করে শিশুদের জন্য ম্যালেরিয়া ছিল খুবই মারাত্মক এক ব্যাধি।
সাইপ্রাসের একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলেছেন, তার শৈশবে ‘বহু শিশু ম্যালেরিয়ায় মারা যেতো। যারা বেঁচে যেতো, তারাও এত দুর্বল হয়ে পড়তো যে একদিনের জন্যও তারা কোন কাজ করতে পারতো না।’
সামরিক বাহিনীর স্টাইলে লড়াই
এর প্রায় ১০ বছর পরের কথা। মেহমেত আজিজ তখন সাইপ্রাসের প্রধান স্বাস্থ্য পরিদর্শক। তিনি একটা আর্থিক অনুদান পেলেন ওপনিবেশিক উন্নয়ন তহবিল বা সিডিএফ থেকে। এর লক্ষ্য সাইপ্রাস থেকে এ্যানোফিলিস মশা নির্মূল করা। যা ম্যালেরিয়া রোগের বাহক। তিনি তার অভিযানের পরিকল্পনা করলেন সামরিক কায়দায়।
পুরো সাইপ্রাস দ্বীপটিকে তিনি ৫০০ এলাকায় ভাগ করলেন। যার নাম দেয়া হলো গ্রিড। প্রতিটি গ্রিডের আয়তন ছিল এমন। যেখানে ১২ দিনের মধ্যে মশা নির্মূলের কাজটা করতে পারে মাত্র একজন লোক । এই পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে মাঠে নামলো মেহমেত আজিজের দল ।
প্রতিটি গ্রিডে প্রতি বর্গমিটার এলাকা তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করলেন সেই গ্রিডের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক। যেখানেই তিনি দেখলেন পানি জমে আছে সেখানেই তিনি ছড়িয়ে দিলেন ডিডিটি নামে মশা ধ্বংসকারী রাসায়নিক। এমনকি পানীয় জলের উৎসও বাদ পড়লো না।
এই ডিডিটির ব্যবহার যাতে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায়। তারও একটা উপায় উদ্ভাবন করলেন আজিজের দল। তারা এমনভাবে জমে থাকা পানির ওপর ডিডিটি ছড়ালেন। যেন পানির ওপর অতি পাতলা পেট্রোলিয়ামের একটি স্তর তৈরি হয়। যার ফলে মশার ডিম ফুটতে না পারে।
১৯৪৮ সালের জুন মাসে সাইপ্রাস রিভিউ পত্রিকায় এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে প্রতিটি গ্রিডে প্রত্যেকটি জলাশয়, নদী এবং জলাবদ্ধতা-তৈরি-হয়েছে-এমন-এলাকায় পানির ওপর কীটনাশক ছড়িয়ে দেয়া হলো। এমন গরু-ঘোড়া-ছাগলের মত প্রাণীর খুরের চাপে তৈরি হওয়া গর্তগুলোর ওপরও দেয়া হলো কীটনাশক।
আজিজের লোকেরা জলাভূমিতে নামলেন, দড়িতে ঝুলে গুহার ভেতর ঢুকলেন। কোনো জায়গাই তাদের কাজের আওতার বাইরে রইলো না।
কীটনাশক ছড়ানো জায়গাগুলো প্রতি সপ্তাহে পরীক্ষা করে দেখা হতো। সেখানে আবার মশার শূককীট জন্মাচ্ছে কিনা। দরকার হলে সেখানে আবার কীটনাশক ছিটানো হতো।
যত দিন এই অভিযান চলেছিল। তত দিন কোনো অপরিষ্কার এলাকা থেকে কোনো যানবাহন পরিষ্কার এলাকায় ঢুকলে সেই যানবাহনগুলোর ওপরও কীটনাশক প্রয়োগ করা হতো।
ম্যালেরিয়া কী?
মানবদেহে ম্যালেরিয়া তৈরি হয় প্লাজমোডিয়াম নামে একরকম পরজীবী থেকে। এটা স্ত্রী জাতীয় এ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই মশা যখন মানুষের রক্ত পান করার জন্য কাউকে কামড়ায়, তখনই এই পরজীবী জীবাণু এক দেহ থেকে আরেক দেহে ছড়ায়।
ম্যালেরিয়া সংক্রমণ ঘটলে মানুষের দেহে গুরুতর অসুস্থতা দেখা দেয়। প্লাজমোডিয়াম পরজীবী জীবাণু মানুষের যকৃত এবং রক্তের লোহিত কণিকা সংক্রমিত করে। পরে মস্তিষ্কসহ সারা দেহেই এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। তা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
২০১৯ সালে সারা পৃথিবীতে ২২ কোটি ৯০ লাখ লোক ম্যালেরিয়ায় সংক্রমিত হন, এবং তার মধ্যে আনুমানিক চার লাখ ৯ হাজার জন মারা যান। যার দুই তৃতীয়াংশই শিশু।
মশার কলোনির সন্ধান
সাইপ্রাসে এ্যানোফিলিস মশার আবাসস্থলের সন্ধান চলেছিল তিন বছর ধরে। মেহমেত আজিজের মেয়ে তুরকানের মনে আছে তার বাবা স্বাস্থ্য পরিদর্শকের ইউনিফর্ম। সেটা ছিল পুরোদস্তুর সামরিক কায়দার ইউনিফর্ম।
তার মনে আছে, ছোটবেলায় পিকনিকে গিয়েও তার বাবা শুকিয়ে যাওয়া নদীর পার ধরে হাঁটতেন - পানির ধারার উৎস কোথায় তা বের করতে। আর তার পেছনে পেছনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হতো তুরকানকে।
একবার একটি সাইপ্রিয়ট গ্রাম দেখতে গেলেন মেহমেত আজিজ। তার সাথে ছিলেন একজন আমেরিকান ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ। সফরের কারণ ছিল ওই গ্রামটিতে ৭২ ভাগ শিশুর দেহে ম্যালেরিয়া সংক্রমণের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল।
সেই আমেরিকান বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আজিজ কীভাবে মশার আবাসস্থল খুঁজে বের করতেন। ঘরের উঁচু সিলিংএ মশার সন্ধান করতে মই খুঁজে বের করার কাজে আজিজ ছিলেন খুবই দক্ষ। এভাবেই শেষপর্যন্ত গ্রামের একটি স্নানঘরের ভেজা দেয়ালের মধ্যে তিনি মশার একটি ঝাঁক আবিষ্কার করে ফেললেন।
তিন বছরের কিছু বেশি সময় পর ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাইপ্রাস পৃথিবীর প্রথম ম্যালেরিয়া-মুক্ত দেশে পরিণত হয়।
বীরের সম্মান দেবার পরও কেন লোকে তাকে ভুলে গেল?
লন্ডন নিউজ ক্রনিকল অনেক প্রশংসা করে মেহমেত আজিজকে নাম দিয়েছিল ‘মহান মুক্তিদাতা’ বা দ্য গ্রেট লিবারেটর। আজিজের গ্রিক ও তুর্কি সাইপ্রিয়ট সহকর্মীদের বর্ণনা করা হলো ‘ম্যালেরিয়া-বিরোধী লড়াইয়ে সম্মুখ-সারির যোদ্ধা।’
এম বি ই বা মেম্বার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার খেতাব দিয়ে সম্মানিত করা হলো আজিজকে। ব্রিটেনের উপনিবেশ বিষয়ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার প্রশংসা করে বললেন, সারা বিশ্বের ডাক্তার ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছেন মেহমেত আজিজ।
ম্যালেরিয়া নির্মূলের মিশন শেষ হবার পরও মেহমেত আজিজ সাইপ্রাসের প্রধান স্বাস্থ্য পরিদর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি টাইফয়েড ও যক্ষার মতো সংক্রামক রোগ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অভিযান চালিয়েছেন। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু এই সাফল্য সত্বেও তার খ্যাতি কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে তার জীবন-কাহিনির সবচেয়ে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় কিন্তু ম্যালেরিয়া উচ্ছেদে তার সাফল্য নয় বরং কিভাবে একটি জাতির ইতিহাস থেকে তা পুরোপুরি মুছে দেয়া হলো সেখানেই।
সেই কারণ নিহিত আছে ছোট্ট সাইপ্রাস দ্বীপ কীভাবে এক স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণে দু’টুকরো হয়ে গেল তার মধ্যে। সেই ঘটনাপ্রবাহ সাইপ্রাসের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জনগোষ্ঠীর জন্যই ক্ষতির কারণ হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনেক সাইপ্রিয়টই বীরত্বে সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হবার পর ব্রিটেনে যখন লেবার পার্টি নির্বাচনে জিতলো তখন অনেকেই আশা করেছিলেন সাইপ্রাস এবার ওপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাবে।
স্বাধীনতা ও বিভক্তি
সাইপ্রাসকে বলা হতো ভূমধ্যসাগরে ‘ব্রিটেনের বিমানবাহী জাহাজ। যা কখনো ডুববে না।’
সাইপ্রাসের দুর্ভাগ্য ছিল এই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অংশগুলোতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ায় এই দ্বীপটির কৌশলগত গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। তাই ব্রিটেন সেখান থেকে যেতে চাইছিল না।
মেহমেত আজিজের ম্যালেরিয়া নির্মূলে অভাবনীয় সাফল্যের পাঁচ বছর পর ১৯৫৫ সালে। ব্রিটেনের সাইপ্রাস ছেড়ে যেতে অনিচ্ছার কারণে শুরু হলো সহিংস সংঘাত।
শেষ পর্যন্ত ১৯৬০ সালে দ্বীপটি স্বাধীনতা পায়। কিন্তু জাতিগত, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বিভেদের কারণে দ্বীপটি ক্রমশঃ বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভক্তির মাঝে পড়ে হারিযে যায় মেহমেত আজিজের কাহিনি।
১৯৭৪ সাল থেকে সাইপ্রাস তুর্কী ও গ্রিক এই দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়। যখন গ্রিসের তৎকালীন সামরিক শাসকদের সমর্থনে দ্বীপটিতে একটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়। তার জবাবে তুরস্ক অভিযান চালায় সাইপ্রাসে। তখন থেকেই সাইপ্রাসের উত্তরের এক-তৃতীয়াংশে বাস করছে তুর্কি সাইপ্রিয়ট জনগোষ্ঠী আর দক্ষিণের দুই-তৃতীয়াংশে বাস করছে গ্রিক সাইপ্রিয়টরা।
এই বিভক্তির কারণে মেহমেত আজিজের মতো কোনো ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে।
মেহমেত আজিজ মারা যান ১৯৯১ সালে ৯৮ বছর বয়সে নিকোশিয়ার উত্তর প্রান্তে। রাষ্ট্রীয় পেনশনের ওপর নির্ভর করেই নিভৃতে তার অবসর জীবন কাটিয়েছিলেন তিনি। কোনো সরকারি শেষকৃত্যানুষ্ঠান ছাড়াই তাকে সমাহিত করা হয়।
তুর্কি ও গ্রিক, উভয় সাইপ্রিয়ট জনগোষ্ঠীই যদি ম্যালেরিয়া-দমন অভিযানের এই নেতার স্মৃতিকে আবার জাগিয়ে তুলতে পারতো তাহলে হয়তো তা হয়ে উঠতো সাইপ্রাসের সবার কাছে বলার মতো আরেকটি গল্প।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা