৯ মাসের জন্য বন্ধ সেন্টমার্টিন ভ্রমণ : যা অর্জিত হলো বিধিনিষেধে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:১৩, আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:১৫
দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কয়েকমাস আগে পর্যটকদের যাতায়াত সীমিত করার মতো কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার।
সেই অনুযায়ী প্রতিবছর ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে প্রতি রাতে গড়ে দু’হাজার করে পর্যটক থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছিল এই প্রবাল দ্বীপটিতে।
নভেম্বর মাসে শুধু দিনের বেলায় সেন্টমার্টিনে ঘোরার অনুমতি ছিল।
রাতে এই দ্বীপে অবস্থানের সুযোগ শেষ হচ্ছে ৩১ জানুয়ারি। এরপরের নয় মাস ভ্রমণের জন্য সেন্টমার্টিনে যাওয়া যাবে না।
কিন্তু সরকার যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ওই নিয়ম জারি করেছিল বাস্তবে তা অর্জন করা কতটা সম্ভব হলো?
সরকারের দেয়া বিধিনিষেধে সেন্টমার্টিনে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি?
বিধিনিষেধ
গত বছরের অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের যাতায়াত ও অবস্থান সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে পর্যটকেরা সেন্টমার্টিনে যেতে পারলেও রাতে থাকতে পারবেন না। আর ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে গিয়ে রাতে থাকতে পারবেন।
তবে শর্ত হলো, ওই দু’মাসে দৈনিক গড়ে দুই হাজারের বেশি পর্যটক সেখানে যেতে পারবেন না। আর ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কোনো পর্যটকই সেখানে যেতে পারবেন না।
যদিও শুরু থেকেই সেখানকার মানুষ ও ব্যবসায়ীরা সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে।
সেন্টমার্টিনকে কেন্দ্র করে যাদের জীবন-জীবিকা, তারা জানুয়ারির শেষে এসে এখনো আশা করে আছেন যে সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।
৩০ জানুয়ারি টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এ কে আহসান উদ্দীন জানিয়েছেন, ‘ব্যবসায়ীরা এক মাস সময় বাড়িয়ে দেয়ার জন্য মানববন্ধন করছেন।’
কিন্তু সরকার শুরুতেও যেমন তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল, এখন পর্যন্ত তারা তাই আছে।
ইউএনও বলেছেন, ‘সময় বাড়ানোর ব্যাপারে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি এখনো।’
তবে অক্টোবরে ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, ‘আমরা দ্বীপটি বাঁচাতে চাই। এটি সবার সম্পদ। পর্যটকরা দায়িত্বশীল আচরণ করলে দেশের ওই সম্পদ রক্ষা পাবে।’
সরকার তখন সেন্টমার্টিন ভ্রমণের ব্যাপারে নানা শর্ত জুড়ে দেয়। যেমন তখন বলা হয় যে সেখানে কোনো আলোকসজ্জাসহ বারবিকিউ পার্টি করা যাবে না। আট কিলোমিটার দীর্ঘ এই দ্বীপের প্রবালসহ সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ করার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, পর্যটকদের মাধ্যমে বা অনুমোদিত জাহাজে করে নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ব্যাগ ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পরিবহন করা যাবে না।
এগুলোর বাইরে আরো বলা হয়, পর্যটকরা কোন হোটেলে অবস্থান করবে তার রেজিস্টার সংরক্ষণ করতে হবে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের অ্যাপ থেকে সংগ্রহ করা ট্রাভেল পাসধারী পর্যটকদের অনুমোদিত জাহাজে ভ্রমণ নিশ্চিত করতে হবে।
তবে আইইউসিএন বাংলাদেশের মুখ্য গবেষক সীমান্ত দীপুও বলেন, ‘যেভাবে বলা হয়েছিল, সেভাবে ট্রাভেল পাস ব্যবহার হচ্ছে না। তবে মানুষ কম যাচ্ছে, এটি সত্য।’
পর্যটকদের অভিজ্ঞতা
সম্প্রতি ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিনে সপরিবারে ঘুরতে গিয়েছিলেন জাকিয়া আহমেদ। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় সেন্টমার্টিন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
তিনি শুরুতেই বলেন, জাহাজে অনেক ভোগান্তি হয়েছে। স্ট্যান্ডিং টিকিট নিয়েও অনেকে এবার সেন্টমার্টিনে গেছেন বলে জানান তিনি।
পর্যটন সীমিতকরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো। কিন্তু ‘বিচের কোথাও কোনো বিন নেই’ বলে উল্লেখ করেন জাকিয়া আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘ওখানে যে পরিমাণ খাবারের দোকান, সবারই কিছু না কিছু খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিন না থাকায় পুরো বিচ জুড়ে চিপস-বিস্কুটের প্যাকেট, বোতল, সিগারেটের প্যাকেট পড়ে থাকে।’
সেন্টমার্টিনে যারাই যান, তারা সাধারণত বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত ভূখণ্ড ছেঁড়াদ্বীপও ঘুরে আসতে চান। যদিও ভ্রমণের উদ্দেশে যেখানে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে।
তবে জাকিয়া আহমেদ তার অভিজ্ঞতা থেকে জানান, এই নিষেধাজ্ঞারও কোনো বাস্তবায়ন নেই।
তিনি বলেন, ‘আমি নিজে সেখানে যাইনি। কিন্তু আমি যে রিসোর্টে ছিলাম, সেখানেরই অনেকে সূর্যোদয় দেখতে ছেঁড়াদ্বীপে গিয়েছেন। তারা কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য ভোররাত ৪টার দিকে রিসোর্ট থেকেই অটো করে যান। আবার ৭টার দিকে ফিরে আসেন।’
সেইসাথে, ‘আলোকসজ্জা থেকে শুরু করে বারবিকিউ পার্টি, সবই চলছে,’ বলেন তিনি।
তিনি যেসব বিষয়গুলোর দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলছেন, এই একই সুরে কথা কথা বলছেন সাম্প্রতিক সময়ে সেন্টমার্টিন ঘুরে আসা আরো কয়েকজন।
কিছুদিন আগে বন্ধুদের নিয়ে সাদিয়া আফরিন গিয়েছিলেন সেন্টমার্টিন। তিনি বলেন, ‘দ্বীপে, মানে বাইরে সৈকতে বারবিকিউ করে না। তবে রিসোর্টে করা যায়।’
২০১৭ সাল থেকে ট্যুর অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন জান্নাতুল ফেরদৌসী। প্রতিবছর তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় পর্যটকদের নিয়ে ভ্রমণে বের হন।
সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি গিয়েছিলেন সেন্টমার্টিনে। তার ভাষ্য, ‘এর আগেও আমি এখানে এসেছি। কিন্তু এবারের মতো এরকম বাজে অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। এখানে আগেও অনেক অনিয়ম হতো। কিন্তু নিষেধাজ্ঞায় আলাদা করে কিছু পরিবর্তন হয়নি। বরং অনিয়ম যেন আরো বেশি হচ্ছে এখন। শিপে প্রচুর মানুষ, স্ট্যান্ডিং টিকিট নিয়ে যাচ্ছে।’
আর একসাথে অনেক দর্শনার্থী যাওয়ার কারণে নোংরাও বেশি হচ্ছে বলে জানান তিনি। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। সে জন্য শিপে জার থেকে পানি নিয়ে খেতে হয়। অথচ সেন্টমার্টিন গিয়ে দেখবেন বোতল আর বোতল, পানিতে ভাসছে।’
তিনিও বলেন যে কোস্টগার্ডরা থামানোর চেষ্টা করলেও ছেঁড়াদ্বীপে অনেকেই যায়।
উদ্দেশ্য পূরণ হলো কতটা
পর্যটকদের মূল অভিযোগ প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে। সেন্টমার্টিনের একটি রিসোর্টের মালিক আব্দুল্লাহিল মামুন নিলয় বলেন, ‘এখানে সমস্যা হলো, বাধ্যবাধকতা নেই। সরকার যদি বাধ্যতামূলকভাবে বলতো যে রিসোর্টগুলোর সামনে প্লাস্টিক থাকতে পারবে না, তাহলে ছোট রিসোর্টগুলোতেও একজন লোক রাখা হতো শুধু এই জিনিস পরিষ্কারের জন্য।’
আইইউসিএন বাংলাদেশের মুখ্য গবেষক সীমান্ত দীপু বলেন, ‘এখানে ডিক্ল্যারেশন আছে, কিন্তু মনিটরিং নেই এটা সত্য। তবে সব দায়িত্ব সরকারের একারও না।’
তার মতে, মানুষ কম গেলে প্লাস্টিকের ব্যবহার এমনিতেই কমে যাবে।
তিনি বলেন, ‘সরকার যদি তার নজরদারি নাও বাড়ায়, তবুও আস্তে আস্তে প্লাস্টিক কমবে।’
পর্যটক কমে গেলে আর্থিক ক্ষতি হলেও পরিবেশের উপকার হবে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘সেখানে মানুষ ও জাহাজ গেলে কচ্ছপ ও কোরালের প্রজনন ভালো হবে।’
সেইসাথে, অতিথি পাখির সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়বে বলে জানান তিনি।
ইতোমধ্যে সেখানে এই কড়াকড়ির কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষ বেশি গেলে জেলেরা প্রচুর কোরাল তুলে আনে ও পর্যটকদের কাছে সেগুলো বিক্রি করে। পর্যটক কম গেলে তো ওরা আর আগের মতো কোরাল ধরবে না। সুতরাং এতে লাভটাই বেশি।’
তার মতে, দীর্ঘমেয়াদের পরিবর্তন বোঝার জন্য আরো কয়েক বছর যেতে দিতে হবে।
এবার মানুষ কম যাওয়ায় সেন্টমার্টিনে কী কী প্রভাব পড়েছে, জানতে চাওয়া হয়েছিল সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: মুজিবুর রহমানের সাথে।
তিনি বলেছেন, ‘জানুয়ারিতেই বন্ধ করে দিলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে।’
তারা চার মাসের জায়গায় দু’মাস ব্যবসা করতে পারছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ঠিকভাবে তত্ত্বাবধায়ন করলে দু’মাস আর চার মাস চলার মাঝে খুব একটা ‘ফারাক’ নেই।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এ কে আহসান উদ্দীনও ব্যবসায়ীদের দাবির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, এবার তারা প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করার বিষয়ে কঠোর অবস্থানে ছিলেন।
তিনি যোগ করেন, ‘এক্ষেত্রে অবশ্য পর্যটকদেরও দায় আছে। তারা যেখানে-সেখানে প্লাস্টিক ফেলে রেখে গেছে। যদি সরকারের সিদ্ধান্ত না পরিবর্তন হয়, তাহলে ফেব্রুয়ারি থেকে আমাদের পরবর্তী কাজ হবে তাদের সেই ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক-পলিথিনগুলো পরিষ্কার করা।’
আহসান উদ্দীন জানান, এবার সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্যের কথা বিবেচনা করে ‘কোনো নাইট পার্টি ছিল না। উচ্চস্বরে সাউন্ড বাজানোয় নিষেধাজ্ঞা ছিল। ছেঁড়াদ্বীপে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করেছি আমরা।’
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা