সাগরের নীলে মিশে গিয়েছিলাম এক দিন
- আফফান উসামা
- ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:১১, আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:৩০
কেউ টাকা উড়ায়, কেউ টাকা কুড়ায়, কেউ বা বাঁধা পড়ে প্রকৃতির মায়ায়। কক্সবাজার যেন সমুদ্রের বিশালতার মতোই রহস্যে ঘেরা। যার পরতে পরতে নানা গল্প লেখা। কখনো সুখের, কখনো শোকের, কখনো জীবন যুদ্ধের।
যেখানে কেউ অঢেল টাকা ঢালে সাগরের গর্জন শুনবে বলে, কেউ ভুরিভোজে ব্যস্ত পউষী বা মেজ্জানে, কেউ আবার টাকা উড়ায় মদ-নারীর পেছনে; সেখানে আবার কেউ কোলে থাকার বয়সে শামুক কুড়োয়, মালা গাঁথে, কেউ আবার তা বিক্রি করে শরীক হয় বেঁচে থাকার লড়াইয়ে।
এক
কক্সবাজারের সুগন্ধা বিচে চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে সাগরের গর্জন শুনছিলাম, দেখছিলাম ভাটার ছোট ছোট স্রোত। ভাবছিলামও হয়তো কিছু। হঠাৎই তখন ব্যাঘাত ঘটলো, কারো ডাকে মন আড়মোড়া ভাঙলো। তাকিয়ে দেখি পাশে দাঁড়িয়ে ৯-১০ বছরের বাচ্চা।
: ভাই মালা নেবেন একটা? নেন না একটা মালা। কমায়ে রাখবনে। দুটোই আছে, শেষ হলেই বাড়ি যাব। কাল পরীক্ষা আছে।
- কিসের মালা এসব?
: শামুকের মালা।
- আমি এসব দিয়ে কী করব? বিয়ে-শাদী করিনি, কার জন্য নেব?
: ভাই নিয়ে রেখে দেন। পরে দিবেইন।
- আচ্ছা, তোমার নাম কী?
: আকাশ।
- বাহ, সাগর দেখতে এসে আকাশের সাথেও দেখা হয়ে গেল। তা তোমার বাসা কি এখানেই?
: হ, বাজারে ভিত্রে।
- কিসে পড় তুমি, কোন স্কুলে, বললা যে পরীক্ষা আছে!
: স্কুল না মাদরাসায়, ক্লাস থ্রিতে।
- বাসায় কে কে আছে?
: সবাই আছে। আব্বা, আম্মা, বইন।
- তুমি ছোট?
: হ।
- এই যে মালা বিক্রি করতেছ, ইচ্ছে করেই আসছ নাকি কেউ পাঠাইছে?
: মায়ে পাঠাইছে। প্রত্যেক দিন আহি। আম্মা বানায়, আমি বেঁচি।
- তোমার আব্বা কী করে?
: কিছু করে না। আরেকটা বিয়া করছে। আমগোরে দেহে না।
- আচ্ছা মালা কত করে?
: দুই শ’ ট্যাকা।
- এই টাকা দিয়ে কী করবা?
: মায়ে ডাল নিতে কইছে। আর শুকনা মরিচ।
- এই নাও দুই শ’, মালা দেও।
মালা হাতে নিয়ে এরপর আবার তাকে ফেরত দিয়ে বলি, এইটা তোমারে দিলাম। তুমি চাইলে তুমি রাখতেও পার, আবার বিক্রিও করতে পার।
এরপর আকাশকে বিদায় জানিয়ে ভেবে দেখলাম ওপরের আকাশের যেমন বিশালতার শেষ নেই, তেমনি এই মাটির ওপরও এমন আকাশের অভাব নেই। বেঁচে থাকার জন্য জীবনে কত যুদ্ধ তাদের! অথচ আমরা কত সুখে আছি।
দুই
বাংলাদেশের সবচেয়ে নয়নাভিরাম স্থান বলা যায় কক্সবাজারকে। এই দেশের প্রাকৃতিক নন্দনকাননের রাজধানীও বলা হয় যাকে। সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল ছিঁড়ে কখনো কোনোদিন কোথাও ছুটে যেতে চাইলে প্রথম নামটাই আসে এই বেলাভূমির।
পৃথিবীর দীর্ঘতম বেলাভূমি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। যা মনে পড়লে চোখে ভাসে মুক্ত আকাশ, সামনে অবারিত জলরাশি। শুভ্র ফেনিল ঢেউ যে কাউকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলে মুহূর্তে। প্রকৃতির কোলে অথই জলরাশি কৌতূহল জাগায়।
সেই কৌতুহল মেটাতে প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে কত কত দর্শনার্থী ছুটে আসে এখানে, তার শেষ নেই। কেউ প্রথমবার, কারো আবার কতবার এসেছেন তার হিসাব নেই। এমনটাই অবশ্য হওয়ার কথা, কক্সবাজার যে ‘প্রেমিকার’ মতো করেই টানে।
যদিও আমার মতো যাদের প্রেমিকা নেই, তারা প্রেমিকার বিষয়টা কী বুঝবে! বুঝিনি আমিও। তাই তো যেতে চাইনি। তবে শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের ‘প্রেম’ দেখার লোভে যখন গাড়িতে উঠে বসলাম, ততক্ষণে জায়গা পড়েছে সবার শেষে ‘গণসিটে’।
গণসিটটা অবশ্য যাত্রাপথে বেশ আপন হয়ে উঠলেও থাকা হয়নি বেশিক্ষণ। আড্ডায় আড্ডায় কেটেছে শুরুর রাতের বেশিভাগ সময়। ‘মুরব্বি’ মিতুলের সঞ্চালনায় যে আড্ডায় সভাপতি ছিলেন শাওন ভাই। অতিথিদের তালিকাও দীর্ঘ।
রাত গভীর হয়েছে, পাল্লা দিয়ে আড্ডাও জমেছে। তবে কী নিয়ে কথা হয়েছে তা না হয় আড়ালই থাকুক।
তিন
ময়মনসিংহ টু কক্সবাজার, ভায়া ঢাকা। যাত্রাপথটা দীর্ঘ হবে জানাই ছিল। তবে এত ভোগান্তি হবে ভাবিনি কেউ। ঢাকায় ‘আপ্যায়ন’ করতে ভুল করেনি বৃহস্পতিবার। যানজটের ‘ডাইনিংয়ে মেহমানদারি’ করতে করতেই রাত যেন প্রায় ফুরোয়!
এদিকে অজান্তেই মেহমান হয়ে গেছি আমিও। বউ থাকার যে এত সুবিধা, কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি চলার পথে, শাওন ভাইয়ের কল্যাণে। এবারের ট্যুরে ভাই তার প্রথম ও একমাত্র বউ আরিফা ভাবিকে নিয়েছিলেন সাথে। যার উপকারিতা আমিও পেয়েছি কম-বেশি।
এই যেমন কখনো কখনো কখনো নুডলস, আবার কখনো মিলেছে চিকেন-খিচুড়ি। দীর্ঘ যাত্রাপথে যা হয়ে উঠেছিল বড় তৃপ্তির কারণ। যদিও এর বিপরীতে এখনো কৃতজ্ঞতা আদায় করা হয়নি তাদের, একটা ধন্যবাদও দেইনি। ইদানীং কেমন জানি মনভুলা হয়ে গেছি। ধন্যবাদের বদলে তাই বলতে হচ্ছে ‘স্যরি’।
চার
হঠাৎ করেই কক্সবাজার আসা। কোনো উপলক্ষও নেই, তেমন কোনো পূর্ব প্রস্তুতিও নেই। বন্ধু মিতুল আগে থেকেই বলে রেখেছিল, আগের রাতেও বেশ পিড়াপিড়ি। এদিকে যখন দেখলাম শাওন ভাইও প্রস্তুত, সাথে ভারিও। তখন মনে হলো নিজের জন্য না হোক, তাদের জন্য হলেও যাই।
যাই হোক কত মাঠ-ঘাট আর পথ পেরিয়ে প্রথমবারের মতো প্রবেশ করি বঙ্গবন্ধু ট্যানেলে। যদিও ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটা ছিল না ট্যানেলের মুখে। পাঁচ আগস্টের পরে নতুন করে আর ‘আকিকা’ হয়নি।
অনেক অপেক্ষার পরে যখন টেনেটুনে কোনোরকমে কক্সবাজারের কাছাকাছি, তখনই হঠাৎ খারাপ হয়েছে গাড়ি। ততক্ষণে প্রায় ১৭ ঘণ্টা হয়ে গেছে রওনা দিয়েছি ময়মনসিংহ থেকে। ফলের শরীরের সাথে যেন মন-মেজাজও বিদ্রোহ করছে।
অবশেষে ঘণ্টা চারেক অপেক্ষার পর গাড়ি ভিড়ে স্বপ্ন-নগরী কক্সবাজারে। ততক্ষণে আনন্দ আর উদ্দীপনা যেন লোপ পেয়ে বসেছে। প্রায় ২১ ঘণ্টার জার্নি বলে কথা! তবুও শেষ বিকেলে ক্লান্ত দেহ ভাসিয়ে দিলাম সাগরের নোনা জলে।
কক্সবাজার সৈকতটি আর আগের মতো নেই, নেই সাবলীল পরিবেশও। বিশাল ঢেউ যদিও আগের মতোই আছে, তবে হারিয়েছে পানির নীলাভ রঙ। বালুর প্রভাবে পানি হয়েছে ঘোলাটে, প্লাস্টিক বর্জের আধিক্যে নষ্ট হয়েছে সৌন্দর্য। সব মিলিয়ে ক্লান্ত দেহ শান্ত হলেও তৃপ্তি আসেনি।
পাঁচ
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই যেন বদলে যায় কক্সবাজারের রূপ। দিনে যা কেবল নোনা পানির রাজ্য, রাতে হয়ে উঠে তা উৎসব মুখর। চাঁদের আলোর সাথে আধুনিকতার আলো মিশে জ্বলজ্বলে হয়ে উঠে সৈকত। তবে মানুষের পদচারণা কমেনি।
এর মাঝেই নামে ভাটা। দিনের আলোয় যেখানে পা রাখা দুঃসাধ্য, সন্ধ্যার পর সেখানেই সাজে প্রেম কাব্য। কিছু পুরুষ হয়ে যায় কবি, অপেক্ষায় তারা ঢের; কোথায় তার শখের নারী, প্রেম পিয়াসী। অন্যদিকে প্রেমিক হয়ে উঠে পেশাদার ক্যামেরাম্যান।
শাড়ি খানিকটা ওপরে তুলে, নুপুরের তালে তালে খালি পায়ে তার কপোতী পা ভেজায় রাতের ফেনা ওঠা পানিতে। যা দেখে বেজে উঠে বিষাদের গান ‘আমার কেউ নেই, আমার কেউ নেই।’
ছয়
কক্সবাজারের সৌন্দর্য বাড়াতে বড় ভূমিকা হিমছড়ি আর ইনানীর। হিমছড়ির পাহাড় যেন আমার মনের কথাই বলে বেড়ায়। যেখানে আরোহন হয়তো কষ্টসাধ্য, তবে তার ভেতরটা এতই সুন্দর যে প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য। তবে সাবধান, লোভ করবেন না। না হয় বন্ধু মিতুলের অবস্থা হতে পারে আপনারও।
কক্সবাজারের এই ট্যুর যদি কারো জন্যে একটু বেশিই সুখানুভূতির হয়, তবে সেটা মিতুলেরই। আড্ডা, হাস্যরস, বন্ধুদের সাথে ফুর্তি।
ইনানীর সূর্যাস্ত উপভোগ গাড়ি থেকেই করতে হয়েছে তীব্র যানজটের কবলে পড়ে। তবে সন্ধার লাল আভার সাথে পাটুয়ারটেকের সৌন্দর্য রাতের নিস্তব্ধতায় চাঁদের মায়াবী আলোয় প্রেমিকাকে দেখার মতো করেই বিমোহিত করে।
সাত
কোন কবি নাকি বলেছেন, ‘যদি আসো কক্সবাজারে, পা রাখিও বার্মিজ মার্কেটে। তুমি চাইলে নিতে পারো আচার, তবে শুটকি নিতে ভুল করিও না আবার।’ শাওন ভাই আবার সেই কবির একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। তা যা হোক হবে, সব উপেক্ষা করে ছুটে গিয়েছিলেন বার্মিজ মার্কেটে। তবে ওই কবির নাম কিংবা পরিচয় জানা যায়নি।
অল্প সময়ের এই ভ্রমণ অধ্যায়ে চাঁদের কলঙ্ক হয়ে আছে ‘ময়মনসিংহ টু কক্সবাজার’ যাত্রাপথ। তবে ফিরতি পথের গল্প সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘ডাবল এক্সেল’ ম্যান রাতুলের প্রেম আর ছ্যাঁকার টক-ঝাল গল্প শুনতে শুনতে পাড় হয়েছে রাতের বেশিভাগ সময়।
তাছাড়া শেষ রাতে চোখও লেগে আসে প্রায় সবার। শাওন ভাই লুঙ্গি পড়ে ভাবির কোলে মাথা রেখে যেভাবে ঘুমিয়েছেন, পরের ট্যুরে তা কাজে লাগানোর প্রত্যয় নিয়ে আমিও হারাই ঘুমের রাজ্যে।
বরাবরের মতো এবারের ট্যুরটাও ছিল আমাদের ময়মনসিংহ ট্রাভেলার্সের সাথে। মোটেও যারা আপস করে না আন্তরিকতার সাথে। বিশেষ করে প্রায় ২১ ঘণ্টার জার্নি শেষে কক্সবাজার পৌঁছে নিজেদের ক্লান্তি ভুলে রুমান ভাই যেভাবে খাবারের যোগান দিচ্ছিলেন আমাদের জন্য, একটা ধন্যবাদ খুব বেশিই প্রাপ্য তার।
প্রতিটা সামর্থবান মুসলিমের যেমন জীবনে একবার হলেও মক্কা-মদিনায় যাওয়া উচিত, ঠিক তেমনি সব বাংলাদেশীরও একবারের জন্য হলেও কক্সবাজার যাওয়া উচিত।
পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকতের মেরিন ড্রাইভ ধরে খোলা জিপ ধরে ছুটে চলার রোমাঞ্চকর আনন্দটা একবারের জন্য হলেও পাওয়া উচিত। সাধ, সাধ্য আর সীমাবদ্ধতার এই জীবনে যদিও সময় করা খুব কঠিন, তবুও সমুদ্রের নীলাভ জলে ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দেয়া উচিত।