২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রেম ও ইটাচিঠি

-

শান্তাদের দ্বিতল বাড়িটি ছিল আমাদের বাড়ির উল্টো পাশেই। রাস্তার এপার আর ওপার। আমি যখন কাস টেনে পড়ি, ও তখন কাস সেভেনে। মনে পড়ে, ঠিক সেই সময় শান্তাকে দেখলেই আমার কেমন কেমন যেন লাগত! অযথাই হার্টবিট বেড়ে যেত, কথা বলতে ইচ্ছে করত। কিন্তু সেই সাহস যে আমার ছিল না! আমার অবস্থা যখন তথৈবচ, তখন সাতপাঁচ না ভেবে হুট করে একদিন ওকে বলে ফেললামÑ ওগো সুন্দরী শান্তা! তুমি যে আমার জানটা! তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
সে মুখে ভেংচি কেটে, ভুবনমোহিনী এক হাসি দিয়ে অন্দরে চলে যায়।
অবাক করার বিষয় হলো, এর ঠিক পরের দিনই একই সময়ে সে আবার আমার সামনে এসে হাজির হলো! চোখেমুখে ভীষণ জিজ্ঞাসা! এবার বলুন ভাইয়া, কাল কী যেন বলতে চেয়েছিলেন? এক.
ই রে, সারছে! না মানে ইয়ে... ইয়ে আর কী! থতমত খেতে খেতে আমার মুখ যেন আটকে গেল! তোতলাতে তোতলাতে কোনোমতে বললাম, আসলে কথাটি যে তোমাকে কিভাবে বলি! আমি না তোমাকে অনেক অনেক...ভা...ভা...ভা! এভাবে তোতলাতে তোতলাতে আমার কখনওই এই বাক্যটি শেষ করা হয়ে ওঠেনি!
পরপর কয়েক দিন এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়াতে একদিন সে বিরক্তিভরা কণ্ঠে ভর্ৎসনা করে বলেই ফেলল, আসলে... আসলে আপনি একটা ভীতুর ডিম! আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না!
খুবই অপমান সূচক কথা! এরপর আমি আরও চিন্তাশীল হলাম! সেই সঙ্গে বিস্ময়ে রাতদিন ভাবতে লাগলাম, বাপরে বাপ! এই এত্তোটুকুন একটা মেয়ে! কথার ঝাঁজ কত! আচ্ছা, আমি যে ওকে মনে মনে ‘আই লাভ ইউ করছি’ ও কি তা টের পাচ্ছে!
দুই.
সে বছর শান্তা কাস এইটে উঠল। আমি স্কুল পেরিয়ে কলেজে। সদ্য স্কুলের শাসনগণ্ডি পেরোনো এই আমার মন যেন চড়ুইপাখিদের মতো উড়তে লাগল। প্রেম করার জন্য মন সদাই ছটফট করে! কেননা অন্য বন্ধুরা ইতোমধ্যেই একজন আরেকজনের সাথে সুপার গ্লুর মতো জোড়া লেগে গেছে! ওদিকে শীত ঋতুও শেষ হয়। আমি বিষণœ বদনে শিমুল-পলাশের পাতা ঝরা দেখি। মন হাহাকার করে; উদাসী হয়। এর কয়েক দিন পরই আসে ঋতুরাজ বসন্ত! গাছে গাছে ফুল ফোটে! ফুলে ফুলে ভ্রমরদের গুঞ্জন আমাকে আরও ব্যথিত করে! আেেপর সুরে মনে মনে বলি, আহারে! আর বুঝি হলো না! অথচ কত্তো স্বপ্ন ছিল এই জীবনে! বড় হলে চুটিয়ে প্রেম করব! প্রেমের পর একজনকে বিয়ে করব; বিয়ের পর ডজন ডজন আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে সুখের সংসারের বৈতরণী পার করতে করতে সারাটি জীবন পার করে দেবো! অথচ কী থেকে যে কী হচ্ছে আর হবে! সবই কপাল!
না, বেশি দিন অপো করতে হলো না। এরই মধ্যে জানে-জিগার বন্ধু হারুন একটি সুখ বার্তা নিয়ে এলো! কিভাবে যেন ও জানতে পেরেছে বাড়ি থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে ভাঙাভিটা নামক জায়গায় এক বিখ্যাত দরবেশ বাবা পড়া পানি দেন। সেই পানি নিজে পান করলে এবং কিছু অংশ প্রেমিকার বাড়ির ওঠান বরাবর ছিটিয়ে দিলে প্রেমিক মনে ব্যাপক সাহস সঞ্চার হয় এবং সেই সাথে যেকোনো সাহসী কাজ এবং কথা বলা যায় বীরদর্পে!
এর ঠিক পরের দিনই দীর্ঘ বাইক ভ্রমণে হারুনকে নিয়ে রওনা হলাম সেই পানি সংগ্রহে। অতঃপর গভীর এক রাতে সেই পানির কিছু অংশ নিজে পান করলাম এবং বাকি অংশ শান্তাদের উঠোন বরাবর ছিটিয়ে দিলাম। ওদিকে দিন যায় মাস যায় আমার যে সাহস আর বাড়ে না! বরং এলাকার অলিতে-গলিতে শান্তাকে দেখলেই হাত-পা আরও দ্বিগুণ পরিমাণে কাঁপা শুরু করে। তোতলাতে তোতলাতে মুখে ফেনা জমে যায়!
এর কয়েক মাস পরই মুশুরীখোলা স্কুল মাঠ প্রাঙ্গণে আমরা ‘প্রেমিক পুরুষ’ সংগঠনের উদ্যোগে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী বন্ধুরা মিলে আসন্ন ভালোবাসা দিবসে কী কী করণীয় শীর্ষক এক আলোচনা সভায় মতবিনিময় করছিলাম। একসময় আমার বিষয়টি উত্থাপিত হলে জিনিয়াস বন্ধু সাইদুল হঠাৎ ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার করে বৃত্তাকার সভার মধ্যস্থলে তাক ধিন ধিন নাচতে শুরু করল! ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই অবাক! প্রশ্ন ছুড়লাম, কী রে ব্যাটা! কী হয়েছে তোর?
দোস্ত আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে!
কী আইডিয়া?
কালই তো ভ্যালেন্টাইনস ডে! তাই না?
হ্যাঁ।
আমার নতুন আবিষ্কার ইটাচিঠির মাধ্যমেই আমি এবার তোর প্রেমটি সার্থক করে ছাড়ব!
ইটাচিঠি! মানে কী?
তবে শোন, তুই তো শালা সাহিত্যিক মানুষ! শান্তাকে উদ্দেশ করে জব্বর করে একটি চিঠি লেখে ফেল। যেহেতু তুই ওকে সরাসরি প্রেম নিবেদন করতে সাহস পাচ্ছিস না, তাই এই ইটাচিঠিই হবে তোর প্রেম প্রস্তাবের উপযুক্ত মাধ্যম! উল্লেখ্য, তখনও মোবাইল-ইন্টারনেটের যুগ শুরু হয়নি!
কিন্তু দোস্ত, সেটা কী করে সম্ভব? ওদের গেটে কী লেখা আছে দেখেছিস? কুকুর হইতে সাবধান! তা ছাড়া ওর বাপ আর ভাই যেই ভয়ঙ্কর!
আরে ব্যাটা, এখানেই তো আসল কারিশমা। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে এই চিঠিটি একটি ইটের টুকরোয় মুড়িয়ে সোজা ওদের ছাদে নিপে করে দিবি! ব্যস, হয়ে গেল!
রাতে আমি আমার সব রসবোধ আর ছন্দকারিশমা দিয়ে একটি উত্তম প্রেম-প্রস্তাবনাপত্র লিখে ফেললাম!
তিন.
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বান্ধবী কান্তার মাধ্যমে শান্তাকে আগেই খবর পাঠিয়েছিলাম, সে যেন ঠিক সকাল ১০টার মধ্যেই ওদের বাড়ির ছাদের দণি কোনায় অবস্থান করে। বিশেষ একটি সারপ্রাইজ আছে তার জন্য!
হ্যাঁ, ওই তো শান্তাকে দেখা যাচ্ছে! কি চমৎকার ড্রেসআপ! ইশরে, কি সুন্দর লাগছে আমার বউটাকে! হাসি হাসি মুখে সে আমার দিকেই অপলক তাকিয়ে আছে! একসময় আমরা নানা অঙ্গভঙ্গিমায় ইশারায় কথাবার্তা শুরু করলাম। আহা! এ যেন মুখোমুখি হাজার কথা বলার চেয়ে লকোটি কথা বলা! হাজার কোটি ভাব প্রকাশের চেয়ে লকোটি ভাব প্রকাশ করা! এর বেশ কিছুণ পরেই সে ভীষণ উদগ্রীব হলো! কী সারপ্রাইজ আছে তার জন্য! আমি হাত উঁচিয়ে কয়েকটি গোলাপ, চকোলেটের পুঁটলি আর ইটের টুকরোয় মোড়ানো ইটাচিঠির অংশবিশেষ দেখাই! সে তড়িঘড়ি সেটি ওদের ছাদে নিপে করতে বলে!
আমি বুঁকে ফুঁ দিয়ে, যেই সেটি ওদের ছাদে নিপে করি, চিঠিটি ল্যস্থলে না পৌঁছে পড়ল গিয়ে ওদের সদর গেট বরাবর; যেখানে পাহারাদার হিসেবে রাত-দিন অবস্থান করে একটি তেজি দেশী কুকুর!
হায়, হায়, একি হলো! আমি তৎণাৎ উড়ন্তবেগে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাই। দেখি চিঠিটি ঠিক কুকুরের সামনেই মুখ বরাবর পড়ে আছে! কুকুরটি তখন ঘুমাচ্ছিল!
আমি দুরু দুরু পায়ে বেশ সন্তর্পণে যেই চিঠিটি আনতে যাই, ওমনি ঘুম ভেঙে বড় বড় চোখ করে কুকুরটি আমার দিকে তাকায়! আমি ভয় পেয়ে যাই! পরে চিঠিটি যখন কোনোমতে মুঠিবদ্ধ করে দৌড় দেবো দেবো ওমনি কুকুরটা আমাকে ১৪০ কিলোমিটার বেগে তাড়া করল! আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চোখ বন্ধ করে দিলাম এক দৌড়। এ দিকে আমি যতই দৌড়াই, কুকুরটাও ততই দৌড়ায়! দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আর্জেন্টপাড়া সংলগ্ন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাজু, সেলিম আর বাপ্পিদের বাড়ির সামনের দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমায় পড়ে যাই! ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে, ওরা তখন সেখানকার বিখ্যাত চায়ের দোকান ‘রোদেলা চা স্টোরে’ দাঁড়িয়ে চা পান করছিল!
কিন্তু একি! আমি এ দিকে নর্দমায় তলিয়ে যাচ্ছি, অথচ আমার ওই তিন নিষ্ঠুর বন্ধু আমাকে সাহায্যের জন্য একটুও এগিয়ে এলো না! উপরন্তু দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে একে-অপরের ওপর গড়াগড়ি করছিল! আমি যতই বাঁচাও বাঁচাও বলে হাত উঁচিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিলাম ; ওদের হাসির মাত্রা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল!
শেষে কোনোমতে, নিজের জান নিয়ে ফিরে এলেও আমার সেই ইটাচিঠিটি কিন্তু রা করতে পারিনি! এখনো সেটি পড়ে রয়েছে সেই দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমায়!
হায়রে প্রেম; হায়রে ইটাচিঠি!


আরো সংবাদ



premium cement