গানের জলসায়
- জোবায়ের রাজু
- ১৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
ছোটবেলায় বাবা-মা যখন জানতে চাইতেন আমার জীবনের লক্ষ্য কী, তখন ফট করে বলে দিলাম, ‘গায়ক হবো।’ বাবা-মা আমার এই লক্ষ্যের কথায় সম্পূর্ণ না হেসে ধারণা করতেন বড় হতে হতে আমার এই গায়ক হওয়ার স্বপ্ন মরে যাবে।
আজ আমি বড় হয়েছি, কিন্তু গায়ক হওয়ার স্বপ্ন আমার মরে যায়নি। গানের প্রতি খুব ঝোঁক আমার। মা-বাবার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও গানের স্কুলে ভর্তি হয়েছি। ওস্তাদজি বললেন হারমোনিয়াম কিনতে হবে। মাটির ব্যাংক ভেঙে জমানো টাকা দিয়ে হারমোনিয়াম কিনেছি। রোজ সকালে গলা সাধি। আমার রেওয়াজ শুনে প্রথম প্রথম প্রতিবেশীরা ব্যাকুল হয়ে ছুটে এসে বিচলিত গলায় বলতÑ ‘কে কাঁদে কে কাঁদে!’ পরে তারা জানত আমি কাঁদছি না। গানের রেওয়াজ করছি।
গানের প্রতি আমার আগ্রহ অনেক। কিন্তু আমার গলা মোটেও ভালো নয়। কেউ কোনো দিন আমার কণ্ঠের প্রশংসা করেনি। না করুক, তাতে কী! আমি গান করি আমার জন্য। জীবনে যদি আমার গলা কখনো কারো ভালো লেগে যায়, তাহলে সারাজীবন তার জন্যই গাইব। কিন্তু সেটা কখনো সফল হবে বলে মনে হয় না। কারণ গানের সাথে নিত্য বসবাস হলেও আমার আজো কোনো ভক্ত তৈরি হয়নি।
পাড়ায় অনেক গানের আয়োজন হয়। শহর থেকে শিল্পী এনে গাওয়ানো হয়। অথচ কর্তৃপক্ষ জানে আমিও গান করি। কিন্তু আমায় তারা ডাকে না। আমার গলা নাকি কর্কশ! কাকের গলাও নাকি আমার থেকে ভালো! এসব শুনলে আমি অপমানিত হই। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারি না। কলেজের এক নবীনবরণ আয়োজনে আমার ওস্তাদ আমাকে নিয়ে গেলেন গাইতে। স্টেজে উঠে হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটি দেশের গানের প্রথম লাইন গাইতেই দর্শকরা জোর গলায় বলল, ‘ওরে নামাও। নতুন শিল্পী আনো।’ এতগুলো মানুষের সামনে লজ্জায় আমার মরি মরি দশা।
বাসায় রেওয়াজ করার মুহূর্তের অনেকগুলো ছবি আছে আমার মোবাইলে। রেওয়াজে বসলে ছোটবোন মিম ছবি তোলে। আমি সেসব ছবি আজকাল ফেসবুকে আপলোড করি। ফলে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডরা জানতে শুরু করে আমি একজন গানের মানুষ। যারা আগে আমার ছবিতে লাইক কমেন্ট মারত না, তারা এখন আমার যে কোনো পোস্ট দেখলেই কে কার আগে লাইক মারবে, এই প্রতিযোগিতায় নামে। আমার পোস্ট শেয়ার দেয়। ইনবক্সে এসে হাই হ্যালো করে। এসব সম্ভব হয়েছে একমাত্র গানের কারণে। তারা জানে আমি গান করি। কিন্তু তারা আমার গান শোনেনি। শুনলে আমি নিশ্চিত তারা আমার গলা শুনে হাসাহাসি করবে।
সেলিম খন্দকার আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। ফেনী জেলায় বাড়ি। আমি গান করি জেনে সে খুব আবদার করে মেসেজ লিখেছে, ‘ভাইয়া, আপনার গান শোনা হয়নি। আগামী শুক্রবার আমাদের পাড়ায় একটি অনুষ্ঠান আছে। আমি চাই আপনি আসুন। সবাইকে গান গেয়ে শোনান। আপনি তো গান জানেন।’ সেলিমের মেসেজ পড়ে আমার চোখ ভিজে গেল। এত বছর গান করি, অথচ কেউ কখনো গাইতে ডাকেনি আজ একমাত্র সেলিম ছাড়া। আমি সেলিমকে মেসেজ লিখি, ‘অবশ্যই আমি শুক্রবারে আপনার পাড়ায় গাইতে আসব। ঠিকানা দেন।’ সেলিম ঠিকানা দিলো। শুক্রবার আসতে আরো চার দিন বাকি। অনুষ্ঠানে কী কী গান করব, সেটা রেওয়াজে মন দিলাম।
২.
আজ শুক্রবার। গান গাইতে ফেনী এসেছি। সেলিমদের এলাকায়। জায়গার নাম সিলোনীয়া। সেলিম বেশ আন্তরিকতা দেখাল আমায়। তার বেস্ট ফ্রেন্ড আতিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইনি গান করেন। আমাদের অনুষ্ঠানে আজ গাইবেন।’
অনুষ্ঠানের কার্যকলাপ দেখে আমি অবাক। বিশাল স্টেজ বানানো হয়েছে। সেলিম মিউজিশিয়ানদেরও ভাড়া করে এনেছেন। অনুষ্ঠান মূলত ক্রিকেট টুর্নামেন্টের পুরস্কার বিতরণ। বিতরণের শেষে গান গাওয়া হবে।
জীবনে প্রথমবারের মতো স্টেজে গাইব ভাবতেই গা হিম হয়ে এলো। সঠিকভাবে গাইতে পারব তো! দর্শক আমার গান শুনে তৃপ্তি পাবে কিনাÑ এসব ভাবতে ভাবতে চিন্তার সাগরে ডুবে যাই।
অবশেষে পুরস্কার বিতরণের পর আমাকে ডাকা হলো স্টেজে। আমজাদ নামের ছেলেটি, যিনি সঞ্চলকের দায়িত্বে আছেন, তিনি শিল্পী হিসেবে দর্শকদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি স্টেজে দাঁড়িয়ে, সামনে এত এত দর্শক। ভয়ে আমার গা কাঁপছে।
বাদকরা বাজাচ্ছেন। আমি গাইতে শুরু করলাম। প্রথমে গাইলাম দেশের গানÑ সূর্যদয়ে তুমি...। সুরে গাই আর বেসুরে গাই, গান শেষে করতালি কেউ দেয়নি। পরের গান শুরু করলাম। এবার ধরলাম আইয়ুব বাচ্চুর গানÑ এক আকাশের তারা তুই...। গাইছি আর দর্শকদের প্রতিক্রিয়া ফলো করছি। না, কারো মধ্যে ইনজয় ভাব দেখা যাচ্ছে না। উপস্থিত দর্শক সারির পেছনের সিটের কয়েকটি মেয়ে দলবেঁধে উঠে চলে গেল। কেন ওরা চলে গেল! নিশ্চয়ই আমার গান ভালো লাগছে না।
এবার তৃতীয় গান ধরলাম আসিফেরÑ ও প্রিয়া তুমি কোথায়! পরপর আসিফের তিন চারটা গান গাওয়ার পর দেখি আমার সামনে শুধু একজন মধ্য বয়সের মুরুব্বি দর্শক বসে আছেন। বাকিরা একে একে সবাই চলে গেল। এমনকি যিনি আমাকে এই আয়োজনে গাইতে ডেকেছেন, তিনিও চলে গেলেন। বুঝতে পারছি আমার গান কারো ভালো লাগছে না। কেবল বসে রইলেন এই মুরুব্বি দর্শক। তিনি হা করে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আমার গান শুনছেন। নিশ্চয়ই আমার গান তার ভালো লেগেছে। তা না হলে তো তিনিও বাকিদের মতো চলে যেতেন।
আমার তো আগেই পরিকল্পনা ছিল জীবনে যদি অন্তত একজন মানুষের কাছে আমার গান ভালো লাগে, সারাজীবন তার জন্যই গাইব। সেই একজনকে সম্ভবত আজ এখানে পেয়ে গেছি। ওই তো দর্শক সারিতে তিনি বসে হা করে তাকিয়ে আমার গান শুনছেন নিরিবিলি।
উনি মুরুব্বি মানুষ। তার জন্য পুরনো দিনের গান গাওয়া উচিত। শুরু করলাম আবদুল আলীমের বিখ্যাত সব পল্লীগীতি। অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে তিনি সব গান শুনলেন।
গান শেষ করে মুরুব্বির কাছে গিয়ে বসলাম। ভক্তিমাখা কণ্ঠে বললাম, ‘চাচাজান, গান কেমন লাগছে আমার?’ তিনি কোনো কথা না বলে আগের মতো আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন। আবারো বললাম, ‘আবদুল আলীমের গান নিশ্চয়ই ভালো লেগেছে। তাই না চাচা?’ এবারও তিনি চুপ। কোনো কথা বলছেন না। আগের মতো হা করে তাকিয়ে রইলেন। ততক্ষণে আমাদের কাছে মিউজিশিয়ানরাও স্টেজ থেকে নেমে এলো। সবাই একবাক্যে চাচার কাছে জানতে চাইছেন আমার গান তার কেমন লেগেছে! কিন্তু চাচার মুখে যেন তালা। কোনো প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন না।
রাস্তার পাশ দিয়ে একটা ছেলে যাচ্ছিল। রিয়াদ নামের সে ছেলেটাকে ডাকলাম। সে এলো।
‘তুমি কী এই চাচাকে চেনো?’
‘চিনি। উনি আলাউদ্দিন চাচা। আমাদের গ্রামের। উনি জন্মগতভাবে বধির। কানে মোটেও শোনেন না। কথাও বলতে পারেন না।’
রিয়াদ ছেলেটির কথা শোনে আমিসহ বাদক ভাইয়েরা টাশকি খেলাম। চাচা মিয়া বধির! কানে শোনেন না! তার মানে এতক্ষণ যে তাকে আবদুল আলীমের গান শোনালাম, তিনি তার কিছুই শোনেনি? হায় হায়!
বাদক ভাইদের সামনে লজ্জায় আমার মাথা কাটা পড়ে। হ