২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভালো মন্দের মানুষ

-

রঞ্জু আমার যমজ ভাই। আমাদের চেহারা হুবহু একরকম। অনেকে আমাকে রঞ্জু আর রঞ্জুকে আমি ভেবে ভুল করে। রঞ্জু আর আমার শরীরে একই পিতার রক্ত বইলেও আমাদের দু’জনের চিন্তাধারা একেবারে বিপরীত। আমরা যেন দু’জন দুই মেরুর। আধুনিকতার এই নবীন যুগেও রঞ্জু বড্ড সেকেলে। ইন্টারনেটের চিত্তবিনোদন হিসেবে রঞ্জুর একটি ফেসবুক আইডিও নেই। অথচ আমি ফেসবুক ছাড়া চলতেই পারি না। কারণে অকারণে ফেসবুকে থাকতে হয় আমাকে। এই নিয়ে রঞ্জুর অভিযোগের অন্ত নেই। তাই ফেসবুকে অ্যাক্টিভ থাকি বলে রঞ্জু আমাকে টিটকারি করে প্রায়ই বলে, ‘ফেসবুককে এত সময় দিস। ফেসবুক তোকে কী দিয়েছে?’
রঞ্জু জানে না ফেসবুক আমাকে অনেক কিছুই দিয়েছে। অনেক ভালো ভালো মানুষদের সন্ধান দিয়েছে। এই মুহূর্তে আমার ফেসবুকের একজন ভালো মানুষকে মনে পড়েছে। তিনি আতিক সাহেব। ভীষণ ভদ্রলোক। কোনো এক অজানা কারণে আতিক সাহেব আমাকে খুব পছন্দ করেন। আমি নাকি তার আমেরিকা প্রবাসী কোনো এক ভাগ্নের মতো দেখতে। তাই মাঝে মধ্যে আতিক সাহেবকে আমি তামাশার ছলে মামা ডাকি। তিনি আমার মামা ডাক শুনে হাসেন।
ফেসবুকে তার সাথে পরিচয়ের এক বছরের মাথায় তিনি একদিন আবদার করলেন আমার সাথে দেখা করবেন। প্রথমে রাজি ছিলাম না। পরে ভেবে দেখলাম আমার প্রতি বিশেষ স্নেহ প্রদর্শনকারী এই মানুষটার আবদার রক্ষা না করা অনেকটা তাকে অপমানের শামিল।
দেখা করার ব্যাপারে আতিক সাহেব আমার ইতিবাচক ইঙ্গিত পেয়ে খুশি হলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম জেলা শহরে দেখা করব। কোনো এক শুক্রবারে আতিক সাহেব জেলা শহরে আসবেন আর আমিও সেদিন যাব সেখানে। দু’জন খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে কোনো নামকরা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করব।

২. আজ শুক্রবার। আতিক সাহেবের সাথে আজ দেখা হবে আমার। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি জেলা শহরে আসবেন। আমি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি দেখে রঞ্জু এসে পাশে দাঁড়াল।
‘কোথায় যাস?’
‘আতিক সাহেবের সাথে দেখা করতে।’
‘আতিক সাহেব কেডা?’
‘আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।’
‘হা হা হা।’
‘হাসছিস কেন?’
‘ফেসবুকের মানুষের সাথেও দেখা করা লাগে?’
‘লাগে।’
‘আমাকে নিবি?’
‘যাবি?’
‘যাবো।’
প্রথমে আমি ভেবেছি রঞ্জু তামাশা করে বলছে। পরে দেখি সে সত্যি সত্যি আমার সাথে যেতে রাজি আছে। ভালো হলো। ওর তো ধারণা ফেসবুক খারাপ জিনিস। আজ ভদ্রলোক আতিক সাহেবকে দেখে ওর অন্ধ ধারণা বদলালেও বদলাতে পারে।
রঞ্জু আমার সাথে যেতে প্রস্তুত হয়ে গেল।

৩. আতিক সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর রঞ্জু। চশমা পরা আতিক সাহেবের ভদ্রসুলভ আচরণে রঞ্জুর মুগ্ধতার শেষ নেই। ও সবচেয়ে মুগ্ধ হলো আমার জন্য আনা আতিক সাহেবের একব্যাগ গিফট সামগ্রী দেখে। গিফটের ব্যাগে চকোলেট, পারফিউম, হাতঘড়ি, মানিব্যাগ, চুইংগাম, বিদেশী পেস্তা বাদাম, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছসহ আরো কী কী দেখে রঞ্জু আমাকে ফিসফিস করে বলল, ‘ফেসবুক তো খুব ভালো জিনিসরে। এই বেটা তোর জন্য এতে কিছু আনছে!’ রঞ্জুর কথায় আমি মুচকি হাসি।
রঞ্জু সবচেয়ে অবাক হলো রাজমহল রেস্তোরাঁয় আমাদের লাঞ্চের মোটা অঙ্কের বিল পুরোটাই আতিক সাহেব দিয়ে দিলেন দেখে। খাসি, মুরগির রোস্ট, ইলিশ মাছসহ হরেক পদের ভর্তার খরচ এসেছে ১৫৭০ টাকা। আতিক সাহেব সব টাকা নিজের দায়িত্বে নিলেন। রঞ্জু আবারো ফিসফিস করে বলল, ‘কে রে এই দিলদরদি? ফেসবুকে বুঝি এসব দিলদরদি থাকে? দেখ, বেটা কী জব্বর খানা খাওয়াইল।’ আমি দম ফাটানো হাসি চাপা দিয়ে নিচুস্বরে বলি, ‘এখন বলিস না। বাড়ি গিয়ে বলিস।’

৪. বাড়িতে এসে রঞ্জু আতিক সাহেবকে ভুলছে না। আতিক সাহেবের প্রশংসায় মুখর হয়ে সে বলল, ‘আমাকেও একটি ফেসবুক আইডি খুলে দে। আমার জীবনেও কিছু ভালো মানুষের দরকার।’
সত্যি সত্যি রঞ্জুকে একটা ফেসবুক আইডি খুলে দিলাম। ফেসবুক ব্যবহারের নিয়মকানুন শিখিয়ে দিতেই সে বেশ দক্ষতার সাথে অল্প দিনে আড়াই হাজার ফ্রেন্ড বানিয়ে ফেলল। রঞ্জু এখন আমার চেয়েও বেশি সময় ফেসবুকের পেছনে ব্যয় করে। শুনেছি ওখানে নাকি ওর ভালো কিছু ফ্রেন্ড জুটেছে।

৫. রঞ্জুকে দেখে মনে হচ্ছে সে কোথাও বের হবে। কোট প্যান্ট টাই আর মানিব্যাগসুদ্ধ টাকা ভরে আয়েশি ভঙিমায় আমার পাশে এসে দাঁড়াল।
‘কোথায় যাচ্ছিস রঞ্জু?’
‘আমজাদের সাথে দেখা করতে।’
‘আমজাদ কে?’
‘ফেসবুক ফ্রেন্ড। খুব ভালো ছেলে। তোর আতিক সাহেবের মতো। অনেক দিন ধরে আমজাদ আমার সাথে দেখা করতে মরিয়া। আজ সে সদরে আসছে শুধু আমার সাথে দেখা করতে।’
‘বাহ। ভালো তো।’
‘যাবি?’
‘না। আজ শীত বেশি। হাঁড় কাঁপানো শীত। এই শীতের মধ্যে বের হবি?’
‘হবো। শীতের চেয়ে আমজাদ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে তুই যাবি না?’
‘না।’
‘ওকে। আমি গেলাম তবে। আমার কেন জানি মন বলছে আতিক সাহেবের মতো আমজাদও আমার জন্য দুনিয়ার গিফট এনে হাজির হবে।’
‘আনলে তো ভালোই।’
রঞ্জু ফেসবুকের আমজাদের সাথে দেখা করতে নাচতে নাচতে চলে গেল। মনে মনে বলি, ‘ফেসবুকের মজা তাহলে বুঝতে পারছ!’

৬. সেই সকালে বের হলো রঞ্জু, এখনো ফিরছে না। এত দেরি কেন? রঞ্জুর ফোনও বন্ধ। ওর ফোনতো সাধারণত বন্ধ থাকে না। কী হয়েছে রঞ্জুর!
সন্ধ্যায় রঞ্জুর আগমন ঘটল। কিন্তু ওর পরিস্থিতি দেখে আমরা আকাশ থেকে পড়লাম। এ অবস্থা কেন রঞ্জুর! খালি গা, খালি পা, সন্ধ্যার ভয়াবহ শীতে কাঁপছে সে।
ঘটনা জানাল রঞ্জু। ফেসবুকের যার সাথে দেখা করতে গেছে, সেই আমজাদ রঞ্জুকে আজ ছক্কা মেরে দিয়েছে। সুবোধ বন্ধুর নাটক করে আমজাদ নামের ওই ইয়াবা আসক্ত বদ ছেলেটা রঞ্জুর সাথে দেখা করার ফন্দি করেছে বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে। রঞ্জুর সাথে জেলা সদরে দেখা করতে এসে কোনো এক চিপা গলিতে নিয়ে মলম লাগিয়ে দেয়ার পর রঞ্জু জ্ঞান হারালে তার পরনের প্যান্ট ছাড়া সব কিছু নিয়ে গাঢাকা দেয়। ৪ ঘণ্টা পর রঞ্জুর জ্ঞান ফিরলে সে চিপা গলি থেকে ঝিমুতে ঝিমুতে বেরিয়ে আসে। সেলিম নামের এক দয়াবান সমস্ত ঘটনা রঞ্জুর মুখে শুনে তাকে বাড়ি আসার ভাড়া দিয়ে বড় উপকৃত করেছে।
রঞ্জুর মুখে এসব বর্ণনা শোনে আম্মা কেঁদে বললেন, ‘কেন এসব ফেসবুক চালাস? তোকে যদি ওই ইতর মেরে ফেলত?’ রঞ্জু শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘জ্ঞান ফিরে দেখি আমার প্যান্ট ছাড়া আর কিছু নেই। ওই শয়তান আমার টাকা ভরা মানিব্যাগ, কোট, শার্ট, টাই, পায়ের জুতাসহ দামি মোবাইলটা নিয়ে ভেগেছে। অরে আমি ভাবছি মানুষের জাত!’
রঞ্জুর কথায় আমার হাসি পেল। রঞ্জু সেটা বুঝতে পেরে ঝাড়ি মেরে বলল, ‘এসবের জন্য তুই দায়ী। ফেসবুক আইডি তুই খুলে দিয়েছিস।’ আমি বললাম, ‘আসলে ফেসবুকে ভালোমন্দ সব মানুষ আছে।’ রঞ্জু কোনো কথা না বলে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে চলে গেল শীতের কাপড় পরতে।

 


আরো সংবাদ



premium cement