আম চোর
- তুফান মাজহার খান
- ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০
পাড়ার সব ছেলেপুলে বিকেলে একসাথে খেলে। এলাকায় খেলার মাঠ নেই। তবে শুকনো মওসুমে যখন ক্ষেতের সব ধান কেটে নিয়ে যাওয়া হয় তখন ক্ষেতই মাস ছয়েকের জন্য মাঠ হয়ে যায়। পাড়ার সবাই ক্ষেতেই খেলাধুলা করে। দূর-দূরান্ত থেকে চলে আসে কেউ কেউ। সময়টা ছিল বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি। আমের ভেতর সবেমাত্র আঁটি শক্ত হতে শুরু করেছে। কিন্তু সে বছর তুলনামূলক আম ছিল নগণ্য। বেশির ভাগ আমের মুকুলই কুয়াশায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই প্রতিটি ঝাঁকে ঝাঁকে আমধরা গাছে ধরেছিল গুটিকয়েক করে। আবার কোনো কোনো গাছে আমই ধরেনি। তাই গাছের মালিকও বেশ সতর্ক থাকত। একটি আম যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখত সব সময়। অথচ প্রতি বছর গ্রামের ছেলেমেয়েরা ইচ্ছেমতো আম খেত এ গাছ, ও গাছ থেকে। এবার যেহেতু আমের আকাল যাচ্ছে তাই সবারই আমের প্রতি লোভটা ছিল বেশি।
প্রতিদিনের মতো সেদিন বিকেলে তারা তাদের অস্থায়ী মাঠে খেলছিল। আর্দ্র আর এমদাদ তাদেরই দলে। খেলতে খেলতে হঠাৎ আর্দ্র দেখল, তাদের মাঠের পাশে একটা আমগাছে একটা আম দেখা যাচ্ছে। যেটা পাতার আড়ালে ছিল। হঠাৎ বাতাসের তোড়ে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। আর্দ্র দেখানোর সাথে সাথে এমদাদ দৌড়ে চলে গেল আমগাছের ওখানে। পেছনে পেছনে গেল সবাই। এমদাদ সুরসুর করে উঠে গেল গাছে। কিন্তু আমটা এমন একটা চিকন ডালে ধরেছে যে সেখানে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার মোটা ডালে বসেও সেটা নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর যখন আর আমটা পাড়াই সম্ভব হচ্ছিল না তখন নিচের সবাই চলে গেল। কিন্তু আর্দ্র আর এমদাদ থেকে গেল। তারা পণ করেছে এটা পেড়েই ছাড়বে। আর্দ্র গাছে উঠতে পারে না। তাই সে নিচ থেকেই এমদাদকে বলছে, আরেকটু সামনে, টান দে, টান দে, ধর, ঝাঁকি দে। তারপরও আমটা পাড়া সম্ভব হলো না। শেষ পর্যন্ত এমদাদ গাছ থেকে নেমেই গেল। আর্দ্রকে বলল, না রে, ঢিল মেরে চেষ্টা করতে হবে। হাতে পাড়া সম্ভব নয়। তারপর আর্দ্র আর এমদাদ ক্রমাগত ঢিল ছুড়তে থাকল। এদিকে মাঠ থেকে ডাক এলো, এই তোরা খেলতে আয়। কিন্তু আর্দ্র আর এমদাদ কোনো প্রতি উত্তর না করে তাদের কাজ করতেই থাকল। হঠাৎ দুজনে একসাথে ঢিল মারল আর আমটা পড়েও গেল। তবে কার ঢিলটা আমে লাগল সেটা ঠিক বোঝা গেল না। আর্দ্র দৌড়ে আমটা নিয়ে ছুট লাগাল। পেছনে পেছনে ছুটল এমদাদ। কাটা ধানক্ষেত দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে প্রায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে চলে গেল আর্দ্র কিন্তু এমদাদ পিছু ছাড়ল না। তারা একটা জনমানবহীন জায়গায় চলে গেল। আর্দ্র অবশ্য এর আগে এখানে কখনো আসেনি। এত রাস্তা দৌড়ে আসার পর আর্দ্র হাঁপিয়ে উঠল। তার সারা শরীর যেন অবশ হয়ে এলো। আর এগোতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে বসেই পড়ল সে। এমদাদ খপ করে আর্দ্রর হাত থেকে আমটা নিয়ে বলল। ওই পাগলা, এটা নিয়ে দৌড় দিলি ক্যান? দুজন মিলে খেতে পারতাম না?
আর্দ্র বলল, ঠিকই তো। শুধু শুধুই কেন দৌড়ালাম। ক্ষেতের আইলে বসে দুজনে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলো। এমদাদ কাঁচা আমটাকে আছাড় মেরে ভেঙে অর্ধেক আর্দ্রকে দিলো আর অর্ধেক নিজে খেল। আমটা কাঁচা হলেও বেশ মিষ্টি ছিল। সাধারণত কাঁচা আম টক লাগে। কিন্তু এটা খেয়ে যেন তাদের তৃপ্তিই মিটছে না। কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। সূর্যটা লাল হয়ে ঢলে পড়েছে। আর্দ্র আর এমদাদ বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা দিলো। হঠাৎ এমদাদ বলল, চল উপরের বাগান দিয়ে চলে যাই। শর্টকাটে যাওয়া যাবে। আর্দ্র বলল, আমি তো চিনি না। তুই চিনিস? এমদাদ বলল, না চিনলে আর বলছি? চল।
যেতে যেতে হঠাৎ এমদাদ বলল, ঐ দেখ। আর্দ্র তাকাতেই দেখল, ছোট্ট একটা আমগাছে বড় বড় অনেক আম ঝুলে আছে। এমদাদ বলল, আশপাশে লোকজন নেই। চল কয়েকটা নিয়ে যাই। আর্দ্র বলল, না। ধরা খেলে পরে খবর আছে। এমদাদ বলল, আরে না। কেউ দেখবে না। তুই শুধু আমার সাথে আয়। আর্দ্র ভয়ে ভয়ে গেল। এমদাদ বড় দেখে চারটা আম ছিঁড়ল গাছ থেকে। এমদাদ তখনো গাছে। এদিকে আর্দ্র দেখল, একটা বৃদ্ধ লোক এদিকেই আসছে। আর্দ্র চাপাস্বরে বলল, এমদাদ, কে যেন এদিকে আসতেছে। এমদাদ শুনে বলল, তুই দৌড় দে। আমি আসতেছি। কিন্তু আর্দ্রর মন সায় দিচ্ছে না। সে দৌড় না নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বৃদ্ধ লোকটি এসে আগে আর্দ্রকে ধরল, তারপর এমদাদকে। অবশ্য এমদাদ দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু পেরে ওঠেনি। লোকটি দু’জনকে দুই হাতে ধরে তার বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগল আর বলতে থাকল, চোর ধরেছি, চোর ধরেছি। আর্দ্র লজ্জায় যেন মরে যাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটিকে আর্দ্র চিনতে পেরেছে। উনি আর্দ্রর দূর সম্পর্কের দাদা হয় কিন্তু লোকটি আর্দ্রকে চিনতে পারেনি। লোকটি তাদের দু’জনকে ধরে বাড়িতে নিয়ে গেল। দু’জনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে আশপাশের লোকজনকে খবর দিলো। আর্দ্র যতটুকু না ভয় পাচ্ছে তার চেয়ে বেশি পাচ্ছে লজ্জা। আশপাশের কয়েকজন এসে তো আর্দ্রকে ঠিক চিনে ফেলল। যদিও এমদাদকে কেউই চিনল না প্রথমে। আশপাশের লোকেরাই আর্দ্রকে পরিচয় করিয়ে দিলো বৃদ্ধ লোকটিকে। আর এমদাদকে জিজ্ঞেস করে তার বাবার নাম জেনে তাকে চিনেছে। বৃদ্ধ লোকটি আর্দ্রকে বলল, নাতি, তুই এমন কাজ কেমনে করলি? তোকে তো আমরা সবাই ভালো জানি। আর্দ্র বলল, আমি তো করতে চাইনি। এমদাদই সব করেছে। এদিকে সন্ধ্যা নেমেছে। বৃদ্ধর বড় ছেলে বাড়িতে এসে ঘটনা শুনে তার বাবাকেই উল্টো কথা শুনিয়ে দিলো। দুইটা বাচ্চা গাছ থেকে ক’টা আমই তো ছিঁড়েছে। এজন্য এভাবে আটকে রাখা লাগে? তুমি যে কী কর। আর্দ্র আর এমদাদকে দুটো আম দিয়ে ছেড়ে দেয়া হলো। রাস্তায় এসে আর্দ্র তার আমটা এমদাদকে দিয়ে বলল, নে, তোর আম তুই নে। আমার আম লাগবে না। এমদাদ বলল, যা তোর জন্যই তো ধরা খেলাম। তুই খা আম। তারপর দুজনই আম ফেলে দিয়ে যার যার বাড়িতে চলে গেল। কিন্তু আর্দ্রর মনে মনে একটাই ভয়। যদি তার পরিবার জানতে পারে তাহলে আর্দ্রর আর মান-সম্মান থাকবে না। বকাও খেতে হবে প্রচুর। পরদিন সকালে তাই ঘটল। আর্দ্রর চাচা এসে বলল, কী রে আর্দ্র তুই নাকি অমুকের আম চুরি করেছিস? আর্দ্র যেন ভাষা হারিয়ে ফেলল। নিশ্চয়ই চাচার কাছে ওই বুড়া বিচার দিয়েছে। আর্দ্রর মা শুনে তো রেগে আগুন। আর্দ্রর মা বলে, লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতেছি তোকে চুরি করার জন্য! দাঁড়া তোর বাবা আজ আসুক বাড়িতে।
আর্দ্র কোনো কথা বলে না। সে মনে মনে জানত যে এমন কিছু একটাই হবে। কিন্তু তার মনে একটাই কষ্ট, যে সামান্য আমের জন্য তাকে এ বয়সে চোর অপবাদ পেতে হলো।