শান্তিতে এবার নোবেল পেল কছর আলী!
- মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
- ২৪ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
এবার শান্তিতে নোবেল পেয়েছে উত্তর পাড়ার রইছ আলীর ছেলে কছর আলী। এ খবর শুনে দক্ষিণ পাড়ার শান্তিসঙ্ঘের সব সদস্য ঘাড় ছেড়ে দিয়েছে। ঘাড় ছাড়েনি শুধুমাত্র মোখলেছ। সে মাথার সাথে ঘাড়টাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। আসলে সহজে দমে যাওয়ার পাত্র নয় মোখলেছ। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার একমাত্র দাবিদার তাদের শান্তিসঙ্ঘ। অথচ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেল হাবাগোবা কছর আলী! নিশ্চয়ই এখানে গাপলা আছে। এর একটা বিহিত সে করেই ছাড়বে। বিকেলে সব সদস্য নিয়ে জরুরি মিটিংয়ে বসল মোখলেছ। মোখলেছের সারা ঘাড় ও মাথায় ধবধবে সাদা প্লাস্টার দেখে সবাই হতবাক। মোখলেছ সামনে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে মূর্তির মতো বসে আছে। চোখ দু’টি বড় বড় করে ডানে-বামে তাকাচ্ছে।
-মোখলেছ ভাই আপনের এ অবস্থা হলো ক্যামনে? বুকে এক দলা থুথু দিয়ে ভয়কে জয় করল আতর আলী এবং প্রশ্ন করল।
-উত্তর পাড়ার কছর আলী নোবেল প্রাইজ পেয়েছে, এমন আচমকা খবরে যখন আমাদের সঙ্ঘের সবারই ঘাড় ছেড়ে দিয়েছে তখন আমার ঘাড় খাড়া না রাখলে এর বিহিত করবে কে শুনি? তাই ঘাড় খাড়া রাখতে আগেভাগেই প্লাস্টার করে ফেলেছি। চোখ দু’টি সাদা ডিমের মতো করে উত্তর দিলো মোখলেছ।
-ভাই ঠিকই বলেছেন, খবরটা যখন আমি শুনলাম, তখন মনে হলো কে যেন আমার বুকে হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। ব্যথায় দুই হাতে বুক চেপে ধরে বসে পড়লাম। পল্টু দাঁড়িয়ে বলল।
-খবরটা শোনার সাথে সাথে আমার মাথায় যেন ঠাটা এসে পড়ল। ভাগ্যিস মাথায় গামছা প্যাঁচানো ছিল, নতুবা ঠাটাটা ঠিকই মস্তক বরাবর প্রবেশ করত। মুখ বাঁকা করে বলল পলাইশ্যা।
সভার যে সিদ্ধান্ত তা বাস্তবায়ন করতে কছর আলীর চাকরিস্থল উত্তরায় গিয়ে উপস্থিত মোখলেছ। ম্যানেজারকে যথাযথ সম্মানের সাথে কুর্নিশ করে রুমে প্রবেশ করল সে।
-স্যার, আমি একটা ইনফরমেশনের জন্য এসেছি।
-কী ইনফরমেশন চান বলেন।
- আমাদের উত্তর পাড়ার কছর আলী আপনার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। সে নাকি এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। কথাটা কি আদৌ সত্য, সিকি পরিমাণ সত্য, নাকি একদমই সত্য না?
এমন প্রশ্ন শুনে ম্যানেজার যেন তালগাছ থেকে পড়ল। বলল, ‘কী বলেন? নোবেল পুরস্কার? শান্তিতে? আজিব তো!’ তিনি চোখ বড় বড় করে বাম পাশ থেকে খাতা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ম্যানেজারের এহেন না জানার ভাব দেখে মোখলেছের মুখে রাজ্য জয়ের হাসি। মনে মনে বলছে, ‘যা ধারণা করেছিলাম তাই। খবরটা আস্ত ভুয়া। মাছ পানির নিচে বাতাস ত্যাগ করলে যেমন বুঁদবুঁদ ওঠে, এমন বুঁদবুঁদ ছাড়া বাতাস ত্যাগ করে ম্যানেজার এক ঠিক এক মিনিট হেসে নিলো। তারপর বলল,
-অহ, হ, এই কথা। কছর আলী, পিতা-রইছ আলী, গ্রাম-উত্তর মাইজ পাড়া। তাই না?
-জি স্যার। ঘাড়টাকে জিরাফের মতো লম্বা এবং কান দু’টি খরগোশের মতো খাড়া করে বলল মোখলেছ।
-আরে, ও তো অসম্ভব শান্তি প্রিয় ছেলে। ম্যানেজার বলল, ‘হয়েছে কী, কয়েক দিন আগে নরওয়ে থেকে আমাদের ফ্যাক্টরির মালিক তার কয়েকজন বন্ধুবান্ধবসহ আমাদের ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করতে এসেছিল। মালিকের উপস্থিতিতে কর্মীরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করল। ইটপাটকেল যে হাতের কাছে যা পেল নিক্ষেপ করতে থাকল। ঠিক সেই উত্তাল মুহূর্তে এই কছর আলী টেবিলের নিচে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। ঘটনাটা মালিকের বিজ্ঞ চোখ এড়ায়নি। নরওয়ের সেই টিম কছর আলীর শান্তিপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়। দুই দিন আগে এক জমকালো অনুষ্ঠান করে কছর আলীকে নোবেল প্রাইজ তুলে দেয়। ওই ঘটনা শুনে মোখলেছ এতটাই আহত হলো যে তার হাঁ করা মুখ দিয়ে লালা গাড়িয়ে পড়ছিল টেবিলের ওপর, কিন্তু সে তা টেরই পায়নি।
উত্তর পাড়ায় সাজ সাজ রব। বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আজ রাতে কছর আলীর নোবেল প্রাইজ প্রদর্শন হবে। মঞ্চে অনেক গণ্যমান্য লোক অবস্থান নিয়েছে। এদিকে শান্তিসঙ্ঘের সদস্যরা রানিক্ষেত রোগে ভোগা মুরগির মতো ঝিমাচ্ছে। কেউ লেপ-তোশক নিয়ে ঘরে শুয়ে কাতরাচ্ছে, কেউ লোকলজ্জার ভয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে মঞ্চের সামনে বসে আছে। দীর্ঘ ভাষণের পর মঞ্চে উঠে এলো ইয়া বড় এক বাক্স। এই বাক্সেই রয়েছে মহামূল্যবান ও সম্মানের প্রতীক নোবেল। একটা বাক্সের ভেতর থেকে আরেকটা বাক্স বের হয়ে এলো। বাক্সটি চকচকে কাগজ দ্বারা মোড়ানো। চকচকে কাগজে বৈদ্যুতিক আলো প্রতিফলিত হয়ে সবার চোখ ঝলসে দিচ্ছে। বিড়ালের চোখের মতো সবার চোখ ঝলমল করছে। কারো মুখ সম্পূর্ণ হাঁ হয়ে রয়েছে। হাঁ হওয়া মুখে কখন মশা ঢুকছে-বেরোচ্ছে, বুঝতে পারছে না। কারণ এই বাক্সটার মধ্যেই রয়েছে মহামূল্যবান নোবেল প্রাইজ, যা দর্শনে তাদের তৃষিত প্রাণের পিপাসা লাঘব হবে। কছর আলীর বাবা রইছ আলী চকচকে কাগজের ভেতর থেকে বের করে আনলেন একটি জিনিস। সবাই মুগ্ধ নয়নে দেখলÑ একটি বই, একটি উপন্যাস। রইছ আলী পাতা উল্টাতে উল্টাতে নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকলেন এবং পেট ফাঁকা করা দম ছাড়লেন। এ দিকে মঞ্চের নিচে শান্তিসঙ্ঘের সদস্যরা দুয়ো ধ্বনি দিতে লাগল। তারা বললÑ এ তো দেখছি উপন্যাস। নোবেল প্রাইজ কোথায়? রইছ আলী এবার হুঙ্কার ছাড়ল। বললÑ এই মিয়ারা, চেঁচামেচি থামাও। তোমরা বোঝোটা কী শুনি? উপন্যাসের ইংরেজি কি জানো মিয়ারা? উপন্যাসের ইংরেজি হলো নভেল। তার মানে কী দাঁড়াল, আমার ছেলে শান্তির জন্য উপন্যাস মানে নভেল পুরস্কার পেয়েছে। শান্তিসঙ্ঘের সদস্যদের ঘাড় এবার খাড়া হয়ে গেল। তারা নেতানো ঘাড় খাড়া করে হাসতে হাসতে শান্তিসঙ্ঘে ফিরে গেল।