২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মামাশ্বশুর

-

আব্বা আজকাল বেলায় অবেলায় দৃঢ়কণ্ঠে আমাকে অপবাদের সুরে বলেন, ‘তুই অকর্মা।’ যদিও আব্বার এমন অপবাদে আমি শতভাগ রাগতে পারি না। কারণ আব্বার বক্তব্য পুরোপুরি সত্য। অকর্মা হিসেবে পরিবারে বরাবরই আমার একটি বদনাম ছিলই। তাই আব্বার দৃঢ় চেষ্টা তার এই অকর্মা অধম ছেলেকে কর্মঠ আর পরিশ্রমী যুবক বানাবেন। বিষয়টি আমিও ভেবে দেখেছি যে, আমার এই ‘অকর্মা’ বদনাম থেকে এবার মুক্তি পাওয়া দরকার।
আব্বা পুরোপুরি পরিশ্রমী একজন মানুষ। আমাদের ক্ষেত খামার প্রচুর। ক্ষেত খামারে টুকটাক কাজ নিয়ে তিনি বরাবরই ব্যস্ত থাকেন। ক্ষেতে ফসল ফলাতে তার একাগ্রতা বরাবরই প্রশংসনীয়। সে দিন আব্বা বললেন, ‘এবার ছেড়ে দে ফেসবুক। আমার সাথে ক্ষেতে নেমে ফসল রোপণে মন দে।’
আব্বার আবদার আমি ফেলতে পারি না। সত্যি ফেসবুক থেকে এবার আমার অব্যাহতি নেয়া দরকার। যদিও ফেসবুকের আসক্তি আমার সুতপার জন্য। পাশের মহল্লার সুতপার সাথে আমার প্রেম অনেক দিনের। পারিপার্শ্বিক সমস্যার কারণে আমরা দু’জনই এখন ফেসবুক নির্ভর। এখানে যখন তখন আমরা একে অপরের খোঁজ নিতে ও দিতে পারি।

২.
আব্বা বললেন, ‘আয় আমার সাথে ক্ষেতে নেমে ফসলের আগাছা নিধন করবি।’
একবাক্যে রাজি হয়ে আব্বার সাথে নেমে পড়লাম ক্ষেতে। মিনিট পাঁচেক কাজ করার পর কাদা মাটি জলে ভরে গেল আমার সারা আদুল গা। ছোট ছোট ধানের ফসলের আগাছা নিধন করার এক ফাঁকে আব্বা ক্ষেতের আইলে রাখা তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিছু টাকা এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বাজারে যা। সার আনবি। আজ ফসলে সার ছিটাব।’
বাধ্য ছেলে হয়ে বাজারমুখী হলাম কাদাচ্ছন্ন আদুল গায়ে, যদিও তাতে আমার সামান্য অস্বস্তি লেগেছে। দশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম আমিশাপাড়া বাজারে। সার দোকান তালাশ করতে করতে এক বস্ত্রবিতানে একজন ভদ্রলোককে দেখে বেশ চেনা চেনা মনে হলো। কোথায় যেন দেখেছি তাকে। কে যেন ইনি! হঠাৎ মনে পড়লÑ ইনিই তো কামরুল মামা। মানে সুতপার ছোট মামা। গত সপ্তাহে বিলেত থেকে দেশে ফিরেছেন। সুতপা বেশ কয়েক দিন আগে কামরুল মামার অনেক ছবি আমাকে ইনবক্সে পাঠিয়ে কামরুল মামা সম্পর্কে মতামত লিখে জানিয়েছে এই মামার সাথে তার খুব ভাব। বন্ধুর মতো সম্পর্ক। তিনি কোনো কিছুতেই মাইন্ড করেন না এবং আমার সাথে যে সুতপার অনেক দিনের প্রণয়, এটা তিনিও জানেন। এমন কি সুতপা আমার অনেক ছবি তার কামরুল মামার ইমোতে পাঠিয়েছে এবং কামরুল মামা নাকি আমার ছবি দেখে পজেটিভ মন্তব্য করে সুতপাকে বলেছেন, ‘ছেলে তো দারুণ। তোর সাথে মানাবে। চালিয়ে যা।’
সেই কামরুল মামাকে এই আমিশাপাড়া বাজারে এখন দেখব, ভাবতেই পারিনি। সুপতার পাঠানো কামরুল মামার সেসব ছবি থেকেও তিনি বাস্তবে বেশ স্মার্ট। কামরুল মামা বস্ত্রবিতান থেকে জামা কাপড় কেনায় বেশ ব্যস্ত। আচ্ছা আমি কি কামরুল মামার সাথে এখন দেখা করব! তিনি কী আমাকে চিনতে পারবেন! না চিনতে পারলে পরিচয় দেবো। কিন্তু ব্যাপারটি কি ঠিক হবে! এসব ভাবতে ভাবতেই কামরুল মামার শপিং শেষ হলো এবং তিনি বস্ত্রবিতান থেকে বেরিয়ে এলেন।
শপিং ব্যাগ হাতে কামরুল মামা এখন আমার পাশেই দাঁড়িয়ে রিকশার অপেক্ষা করছেন। একবার ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালেনও। আবার চোখও সরিয়ে নিলেন। মনে হয় আমাকে চিনতে পারেননি। না চেনারই কথা। অনেক দিন আগে ইমোতে আমার ছবি দেখেছেন তো, মনেই নেই হয়তো আমার চেহারাটা।
আমি কামরুল মামার একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমার খুব বলতে ইচ্ছে হলো, ‘মামা, আমি রঞ্জু। সুতপা একদিন আপনার ইমোতে যে ছেলের ছবি পাঠাল, আমিই সেই ছেলে।’ কিন্তু দ্বিধার জন্য মুখ থেকে এসব কথা অকপটে বের হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও বলতে পারছি না। তিনি আবারও আমার দিকে তাকালেন এবং আমি যে কিছু বলতে চাচ্ছি, সেটাও বুঝতে পারছেন।
‘কী চাই তোমার?’
‘ইয়ে মানে...
‘বলো।’
‘আপনি ভালো আছেন মামা?’
‘হ্যাঁ। কিছু বলবে?’
‘ই ই ইয়ে, মানে!’
হঠাৎ একটি অঘটন ঘটে গেল। কামরুল মামা তার মানিব্যাগ বের করে একটা বিশ টাকার নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই বয়সে ভিক্ষা করতে লজ্জা হওয়া উচিত। এই নাও বিশ টাকা। আর খালি গা কেনো তোমার! গায়ে এত কাদামাটি। উফ, বাংলাদেশের ভিক্ষুকগুলো এত নোংরা। অথচ বিলেতের ভিক্ষুকরাও যেন একেকটি নায়ক।’
কামরুল মামার কথায় আমি লজ্জা পেলাম। তিনি আমাকে ভিক্ষুক ভেবে ভুল করে বসে আছেন। লজ্জায় আমার এখন কী করা উচিত, জানি না। হঠাৎ একটি রিকশা আসতেই কামরুল মামা রিকশায় চেপে বসে স্থান ত্যাগ করলেন। আর আমার হাতে পড়ে রইল তার দেয়া বিশ টাকার নোট। হবু মামাশ্বশুর আমাকে ভিক্ষুক ভেবে...! আচ্ছা সুতপাকে কি এ ঘটনা জানানো ঠিক হবে!

 


আরো সংবাদ



premium cement