২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বুদ্ধির খেলা

-

রঞ্জু আমার যমজ ভাই। আমার থেকে ওর জ্ঞানবুদ্ধি মোটামুটি ভালো হওয়ার পরও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আম্মা সব সময় রঞ্জুর গুণগুলোর তুলনায় দোষগুলো নিয়ে দারুণ অভিযোগের তীর ছোড়েন। অবশ্য রঞ্জু অনেকটা অলস প্রকৃতির ছেলেও। আম্মা সব সময় শাসনের সুরে রঞ্জুকে বলেন, ‘এত অলস হলে চলে না।’ যদিও নিজের অলসতা নিয়ে রঞ্জুর আহামরী কোনো মাথাব্যথা নেই।
দারুণ গরম পড়ছে এখন। লোডশেডিংয়ের বেশ রাজত্বও চলছে এখন। ঘামে ভিজে জবুথবু হয়ে থাকা রঞ্জু বরাবরই আম্মাকে তাগিদ দিচ্ছে ঘরে আইপিএস কেনার জন্য। ছেলের কথা শুনে আম্মা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলেন, ‘এত বড়লোকি দেখানো ভালো না। ঘরে হাতপাখা আছে।’
আম্মা আলমারি খুলে আস্ত একখানা হাতপাখা বের করে রঞ্জুকে দিয়ে বললেন, ‘গরম লাগলে এটা দিয়ে বাতাস কর।’
সুবোধ বালকের মতো হাতপাখাটা গ্রহণ করে রঞ্জু বলল, ‘ঠিক আছে।’
এবারের গরম সত্যিই কাঠফাটা। বৃষ্টির কোনো নাম-গন্ধ নেই। রঞ্জুর মতো আমিও তীব্র গরম অনুভব করছি। কিন্তু অস্বস্তি লাগলেও ওর মতো ধৈর্য হারাচ্ছি না। রঞ্জু যেহেতু অলস ছেলে, তাই হাতপাখা দিয়ে কষ্ট করে বাতাস খাওয়াটা ওর জন্য কষ্টসাধ্য। বিনয়ী গলায় দু-চারবার আমাকে বলল, ‘ভাই, আমাকে বাতাস করে দে না।’
মাফ চেয়ে মুখের ওপর বলে দিলাম, ‘পারব না।’

২.
পড়ন্ত দুপুর। আজ গরমের শেষ নেই। সূর্য যেন আজ বাংলাদেশের ওপর ক্ষেপেছে। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। রঞ্জুর ঘামে ভিজে যাওয়ার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সে যেন এখনই পুকুর থেকে ডুব দিয়ে এসেছে।
উঠোনের কোণে ডালিম তলায় চেয়ার পেতে বসে রঞ্জু হাতপাখায় বাতাস খাচ্ছে। রসুইঘরে নিরিবিলি রান্নার কাজে নিবেদিত থাকা আম্মাকে ডেকে রঞ্জু বলল, ‘আম্মা, হাত তো ব্যথা হয়ে গেছে। একটু বাতাস করে দাও না।’
বাঘিনী গলায় আম্মা বললেন, ‘গরম কি তোর একার লাগছে! আমার লাগছে না? বদমাশ কোথাকার।’
রঞ্জু প্রতিউত্তর না করে চুপচাপ হাতপাখার বাতাসে গরম নিরাময়ের আপ্রাণ চেষ্টায় ব্যস্ত।
হঠাৎ আম্মার চেঁচামেচি। আম্মা রসুইঘরের রান্নাবাড়া ফেলে দৌড়ে উঠোনের পাশে ডালিম তলায় ছুটলেন আর ব্যাকুল কণ্ঠে বলছেন, ‘রঞ্জুর কী হইছে! রঞ্জুর কী হইছে!’
ছুটে গিয়ে দেখি রঞ্জু মাথা ঘুরে অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ছেলের এই দশা দেখে আম্মার চেঁচামেচি বাড়ছে। সেই চেঁচামেচিতে আশপাশের দু-চার বাড়ি থেকে চাচী-জেঠীরাও ছুটে এসেছে ঘটনা তদন্তে।
অচেতন রঞ্জুকে ঘিরে রেখেছে সবাই। আশিকের মা পুরো ঘটনা বুঝতে পেরে উদাসিনী আম্মাকে শান্ত হওয়ার বয়ান দিয়ে বললেন, ‘ভাবী, শান্ত হোন। আজকের এই কড়া গরমে রঞ্জু মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। ওকে বাতাস করা দরকার। ঘরে হাতপাখা যা আছে, নিয়ে আসেন। আমরা সবাই মিলে বাতাস করি।’
আম্মা ব্যাকুল হয়ে ঘরে ছুটে গেলেন হাতপাখার তালাশে।
ছয়টি হাতপাখার সন্ধান পেলেন আম্মা। চাচী-জেঠীরা অচেতন রঞ্জুকে হাতপাখার বাতাসে শীতল করার অভিযানে নামলেন।
ঘণ্টাখানেক পর বাতাস খেয়ে শীতল হওয়ার পর জ্ঞান ফিরল রঞ্জুর আর আম্মার মুখে ফুটল হাসির রেখা।
চাচী-জেঠীরা রঞ্জুকে ধরাধরি করে ঘরে এনে খাটে শুইয়ে দিয়ে যে যার বাড়ি চলে গেলেন। আম্মা হাতপাখা ঘোরাতে ঘোরাতে রঞ্জুকে প্রশ্ন করেন, ‘এখন কেমন লাগছে বাপ?’
রঞ্জু রুগ্ণ গলায় বলল, ‘ভা-ভা-ভালো। বাতাস করো। খুব গরম লাগছে।’
আম্মার বাতাস করতে করতে মনে পড়ল রসুইঘরের চুলায় বসানো তরকারির পাতিলের কথা। আকুল হয়ে আমাকে বললেন, ‘গরম পাতিল বোধ হয় এতক্ষণে পুড়ে গেছে। তুই রঞ্জুকে বাতাস কর। আমি রসুইঘরে যাই।’
একমনে রঞ্জুকে বাতাস করতে করতে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম রঞ্জু মুখ টিপে হাসছে।
‘কিরে, হাসছিস মনে হচ্ছে।’
‘হি হি হি।’
‘সেকি! হাসছিস কেন?’
‘অভিনয়টা দারুণ হলো না?’
‘কিসের অভিনয়?’
‘জ্ঞান হারানোর অভিনয়।’
‘মানে?’
‘এতক্ষণ যা করেছি, সব ছিল অভিনয়। এমন বুদ্ধির খেলা না খেললে কি আর এত হাতপাখার বাতাস খেতে পারতাম?’
‘রঞ্জু, সব তোর অভিনয় ছিল?’
‘আস্তে বল। আম্মা শুনতে পাবেন।’
না, রঞ্জুর এই কাজটি ঠিক হয়নি। কতগুলো মানুষকে সে হয়রানি করল। জোরগলায় আম্মাকে ডাকতে থাকলাম। রঞ্জু আবার জ্ঞান হারাল ভেবে আম্মা উট পাখির মতো দৌড়ে এলেন।
আম্মাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে না বলতেই রঞ্জু আবার গলায় অসুস্থতার ভান এনে বলল, ‘না মা, ও মিথ্যে বলছে।’
আম্মা আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, ‘এই বিপদে তুই ওর নামে মিথ্যে রটাস? তুই কি মানুষ, না গরু! দূর হ চোখের সামনে থেকে। ও রঞ্জু, এখন কেমন লাগছে বাপ? লেবুর শরবত করে আনি? খাবি! ভালো লাগবে।’
রঞ্জু আবার অসুস্থতার ভান করে রুগ্ণ গলায় বলল, ‘খা-খা-খাবো।’
আম্মা এক দৌড়ে চলে গেলেন লেবুর সন্ধানে। বুঝতেই চেষ্টা করছেন না চালাক রঞ্জুর এই অভিনব বুদ্ধির খেলা। আম্মারই বা দোষ কী! সন্তানের যেকোনো অসুস্থতায় সব মা এমন দিশাহারা নাবিক হয়ে ওঠেন। হ


আরো সংবাদ



premium cement