আবির এবং গরুর লেজ
- আশিক মাহমুদ রিয়াদ
- ০৮ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০
ঈদুল আজহা চলে এসেছে। আমার চাচারা তাদের পরিবার নিয়ে সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠেছেন আজ বিকেলে। বাবা আমাকে বলেছে খুব ভোরে গিয়ে যেন লঞ্চঘাটে যাই। প্রতিবারের মতো চাচাদের লঞ্চঘাট থেকে আনার দায়িত্বটা বাবা আমার ওপর দিলেন। আমাদের এখানে খুব ভোরে ঢাকা থেকে আসা লঞ্চ ভিড়ায়, আবার ছেড়ে যায় বিকেলে। আমার চাচা মোট দুজন। তারা তাদের পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। বড় চাচার দু’টি মেয়েÑ বড় মেয়ের নাম সুজানা আর ছোট মেয়ের নাম ঈশিতা। সুজানা আপু আমার থেকে বয়সে বড়। তিনি এবার মাস্টার্সে পড়ছেন আর ঈশিতা আমার ক্লাসে পড়ে। আমি এবার ইন্টারে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আর ছোট চাচার একটি মাত্র সন্তান। নাম আবির। এবার ক্লাস টেনে পড়ে। বড় চাচা চাকরি করেন ব্যাংকে, আর ছোট চাচা কোম্পানিতে। আমার বাবা আমাদের গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
সবাই ব্যস্ত থাকার কারণে প্রতিবার ঈদুল ফিতরে আমার দুই চাচা বাড়িতে আসতে পারে না বলে কোরবানির ঈদে সবাই একত্র হয়। তাই আমরা কোরবানিতেই দুটো ঈদের আনন্দ একবারে ভাগাভাগি করে নেই।
সেবারের ঘটনা। তখন আমি সিক্সে পড়ি। ঈদে সবাই বাড়িতে এলো। বাবা আর চাচারা মিলে হাটে গেলেন গরু কিনতে। আমি, সুজানা আপু আর ঈশিতা বায়না করলাম আমাদেরও হাটে নিতে হবে। কিন্তু বাবা বললেন, ‘না তোদের নেয়া যাবে না। তোরা এখনো ছোট। এখন হাটে গেলে হারিয়ে যাবি। আর ওখানে সব বড় বড় গরু আছে। সবগুলোর বিশাল বিশাল সাইজ। তারপরে একটা দুর্ঘটনা হয়ে যাবে। কাজেই দরকার নেই। তোরা বাড়িতেই থাক। বাড়িতে বসে খেলাধুলা কর।’
আমাদের সবার মন খারাপ হলো। সুজানা আপু বলল, ‘এখন কী করা যায়?’
কেউ কিছু বলল না। চুপ করে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। এর মধ্যে আমাদের মধ্যে আবির এলো। ছোটবেলা থেকেই ওর মুখে প্রচুর রুচি। সামনে যা পায় গমগম করে খেয়ে ফেলে। তাই শরীরটাও সে রকম মোটাসোটা। আমের বাটি হাতে আম খেতে খেতে আমাদের সামনে এলো। বলল, ‘এই তোমরা কি জানো গরুর কয়টা লেজ?’
আমি সুজানা আপু আর ঈশিতে একে অপরের চোখের দিকে তাকালাম। সুজানা আপু ঠাট্টা করে বলল, ‘না আমরা জানি না। তুমি কি বলতে পারো গরুর কয়টা লেজ?’
আবির সুজানা আপুর কথা হেসে উড়িয়ে দিলো। ব্যঙ্গ করে বলল, ‘তোমরা দেখছি কিছুই জানো না। অথচ তোমরা আমার থেকে কত ওপরের ক্লাসে পড়ো। তাহলে শোনো তোমরা, গরুর দুটা লেজ। আমি বইয়ে পড়েছি।’
আমরা মিটমিট করে হাসলাম। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আবির তুমিও তো জানো না। গরুর পাঁচটা লেজ থাকে।’
আবির কেমন রেগে উঠল। বলল, ‘তোমরা কি আমার সাথে মশকারা করছো?’
আমি বললাম, ‘না। আমিও বইতে পড়েছি।’
সুজানা আপু আর ঈশিতা হাসল মিটমিট করে। আমি আবিরের সাথে মজা করছি, ওরা তাই দেখে খিলখিল করে হাসছে। আবিরের সাথে কিছুক্ষণ করুর লেজ সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক হলো। আবির কোনোভাবেই মানতে রাজি নয় যে গরুর পাঁচটি লেজ আছে। সে ঠিকই জানে গরুর দু’টি লেজ থাকে। ক্লাসের বইয়ে পড়েছে, দ্য কাউ ইজ ডোমেস্টিক এনিমেল। ইট হ্যাজ এ পেয়ার টেইলস। আবির ভীষণভাবে রেগে গেল। ছোটবেলা থেকেই সে খুব জেদি। খপ করে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ছোট কাকির কাছে।
আবির ছোট কাকিকে বলল, ‘মা! দেখো। রেদোয়ান ভাইয়া বিশ্বাস করছে না যে গরুর দুটি লেজ থাকে।’
আবির রাগে ফুঁসছে। আরেকটু হলেই কেঁদে দেবে। ও কাঁদলে ওকে ঠাণ্ডা করা অনেক কষ্টের ব্যাপার। কেউ ওর কাছে গেলেই এটা ওটা ছুড়ে মারে। এটা সেটা ভেঙে ফেলে। তাই ভয়ে ওকে কেউ রাগায় না। ছোট কাকী আমাকে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন আবির কথা মেনে নিতে। কারণ, এখন আবিরকে কোনোভাবেই রাগানো যাবে না। ওর রাগ আর কান্না থামাতে খবর হয়ে যাবে। আমি মেনে নিলাম আবিরের কথা। আবির আমার সাথে এলো সুজানা আপু আর ঈশিতার কাছে। ওরা দু’জন ঠাট্টা করল আবিরের সাথে। তারা বিশ্বাস করেনি আবিরের কথা। আবিরের মুখ কালো হয়ে এলো শ্রাবণ মাসের আকাশের মতো। এখনই ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলবে এরকম অবস্থা। আমি বললাম, ‘আচ্ছা আমরা কালকে সকালেই সবার নিজের চোখে দেখব আসলে গরুর লেজ কয়টা থাকে?’
আবিরকে বোঝালাম। আবির মেনে নিলো আমার কথা। রাতে বাবারা যখন গরু নিয়ে ফিরেছে তখন আমরা সবাই ঘুমে মগ্ন। রাতে যাওয়া হলো না গরুর কাছে।
২.
পরের দিন সকালে আমি সুজানা আপু আর ঈশিতা গেলাম গরুর কাছে। আবিরকে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো ঘুমোচ্ছে। গরুকে দেখভাল করার জন্য একজন লোক রেখেছেন বাবা। গরুটা সাইজে মোটামুটি। বেশি বড় না আবার বেশি ছোট ও না। আমাদের সবার গরু পছন্দ হলো। আমরা হাত বুলালাম গরুর গায়ে। খড়কুটো খাওলাম গরুটাকে। গরুকে খড়কুটো খাওয়ানোর পরে গরু থেকে দূরে সরে এসে দাঁড়ালাম। গরুকে দেখভাল করার লোকটা গরুকে খুব ভালোভাবেই দেখভাল করছে।
কিছুক্ষণ পর আবির এলো। এসে গরু দেখল। ভয়ে ভয়ে গরুর গায়ে হাত রাখল। গরুটা নড়েচড়ে উঠল। আবির ভয়ে হাত সরিয়ে ফেলল। ঈশিতা বলল, ‘আজ কিন্তু আমাদের গরুর লেজ কয়টা সেটা দেখার কথা ছিল। কিরে আবির গরুর লেজ তো ছয়টা। আবির রাগী রাগী চেহারায় তাকাল ঈশিতার দিকে। এতক্ষণে বোধহয় ভুলেই গিয়েছিল গতকালের বোকামির কথা।
না আবির হারতে রাজি না। আবার তর্ক শুরু করল ঈশিতার সাথে। সে বলল, ‘গরুর লেজ দুটাই। একটি চামড়ার মতো দেখতে আর একটি দেখতে চুলের মতো।
আবিরের এই অর্থহীন যুক্তি শুনে আমরা তিনজন অট্টহাসি দিলাম। আবিরের এবার প্রচণ্ড রাগ হলো। রাগের মাথায় গরুর লেজ ধরে টান দিতে গেল, কিন্তু ভুলক্রমে আবির গরুর দড়ি ধরে টান দিলো, গরু ছুটে গিয়ে পালাতে লাগল।
আমরা ভয়ে দিলাম ভোঁ-ছুট। পেছন থেকে আবিরের ভেউ ভেউ করে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আবিরও আমাদের পেছছ পেছন দৌড়াচ্ছে। সাথে গরুটাও।