২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভিটামিন সিরাপ

-

আমি বাবার একমাত্র সন্তান। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম পাইলট হওয়ার। আকাশে উড়ে বেড়াব। পৃথিবীর বিভিন্ন বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করাব। এমন স্বপ্ন দেখে বড় হতে হতে একদিন জানতে পারলাম বাবা আমাকে নিয়ে আরেক স্বপ্ন দেখাতে মত্ত। তিনি আমাকে ডাক্তার বানাবেন। তাও পশুর ডাক্তার। বাবার এই হাস্যকর পরিকল্পনা শোনে মা অবহেলায় আর তাচ্ছিল্যে বললেন, ‘পশু ডাক্তার! খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই?’
জবাবে বাবা ছোট্ট একটি ইতিহাস শোনালেন। টমির ইতিহাস। টমি ছিল বাবার পোষা একটি কুকুর। সেই টমি বাবার এতটাই প্রিয় ছিল যে, টমির মৃত্যুতে বাবা বড় কষ্ট পেয়েছেন। কী একটা রোগ হয়েছিল টমির। আশপাশের দশ গ্রাম খুঁজেও কোনো পশুর ডাক্তার পাওয়া যায়নি বলে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে টমি অসুস্থতার তিন দিনের মাথায় মারা গেল।
টমির অসুস্থতায় যেহেতু তীক্ষè তল্লাশিতেও পশুর ডাক্তার পাওয়া যায়নি, তাই বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন তার ছেলেকে পশুর ডাক্তার বানাবেন। বড় হয়ে এই তথ্য জেনেও বাবার সিদ্ধান্তে অমত দেয়ার কোনো উপায় ছিল না আমার। কারণ, বাবা এক কথার মানুষ। দুনিয়া ওলটপালট হয়ে যাবে, কিন্তু বাবার সিদ্ধান্ত বদলাবে না।
২.
আজ আমি গঞ্জের একজন পশুর ডাক্তার। রোগীর সংখ্যা এতই নগণ্য যে চেম্বারে বসে বসে বেশির ভাগ সময়ে মশা মারি। সপ্তাহজুড়ে দু-চারটা রোগী মেলতেও কষ্ট হয়।
তবে কোরবানির ঈদ এলে আমার ব্যস্ততা বাড়ে। গরু মোটাতাজা করার থেরাপি দিতে দিতে সকাল-সন্ধ্যা পার হয়। এই মওসুমে গরুর প্রচুর ভিটামিন সিরাপ বিক্রির হিড়িক পড়ে। তাই চেম্বারে তুলনামূলকভাবে বেশিই ভিটামিন সিরাপ রাখা লাগে। গরু বিক্রেতারা এসব ভিটামিন সিরাপ খাইয়ে গরুকে মোটা করে পশুর হাটে নিয়ে লাভবান হওয়ার ধান্ধায় নামে।
আজ আমার চেম্বারে বেশ ভিড়। গরুর ভিটামিন সিরাপ বিক্রির যেন ধুম লেগেছে। ৫০ বছরের এক কৃষক এলেন গরুর জন্য ভিটামিন সিরাপ কিনতে। তার হ্যাংলা-পাতলা গরুটা এবারের পশুর হাটে বিক্রি করে দেবেন। তাই গরুর স্বাস্থ্য উন্নতির জন্য তিনি একসাথে ত্রিশটি সিরাপ কিনলেন। আমার পশু ডাক্তারির ইতিহাসে আজ পর্যন্ত একসাথে এত সিরাপ বিক্রির ঘটনা ঘটেনি। যা হোক, কৃষকের কথাবার্তায় যথেষ্ট সরলতা আছে। পড়ালেখা একেবারে নেই বললে চলে। সিরাপ কিভাবে গরুকে খাওয়াতে হবে, সেই নিয়ম কাগজে লিখে দিতেই কৃষক আপত্তির সুরে বললেন, ‘আমার লেখাপড়া নেই। পড়তে পারব না। নিয়ম মুখে বলে দেন।’
হেসে বললাম, ‘গরুকে ওষুধ সকালে দুই চামচ, রাতে দুই চামচ করে খাওয়াবেন।’
তিনি সিরাপ নিয়ে আনন্দে নাচতে নাচতে চলে গেলেন। দশ মিনিট পর আবার ফিরে এলেন।
‘কী ব্যাপার। আবার এলেন যে?’
‘হ্যাঁ, স্যার।’
‘কিছু বলবেন?’
‘বলব।’
‘সিরাপটা কিভাবে যেন খাওয়াব?’
‘সকালে দুই চামচ, রাতে দুই চামচ করে।’
‘কিন্তু স্যার, আমার গরু তো জন্মের পর থেকে চামচে নয়, গামলায় করে খেতে শিখেছে। তো দিনে কয় গামলা করে খাওয়াব?’
কৃষকের কথা শুনে কী বলব বুঝতে পারছি না। ইচ্ছে করছে উচ্চৈঃস্বরে কতক্ষণ হাসি। গ্রামের মানুষ এত সহজ সরল কেন!

 


আরো সংবাদ



premium cement