যাবেন নাকি?
- তুফান মাজহার খান
- ০৮ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০
রাত সাড়ে ১২টা। অপু গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। সে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে মাওনা যাবে। অফিসের একটা কাজে এসে আটকে গিয়েছিল। সারতে সারতেই এত রাত হয়ে গেল। যা হোক, এখন বাড়ি যাওয়া জরুরি। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও মিলছে না কোনো গাড়ি। মাঝে মধ্যে দু-একটা দূরপাল্লার বাস আসছে কিন্তু অপু উঠতে পারছে না। বলছে কাছের যাত্রী নেবে না। শেষ পর্যন্ত সে হতাশ হয়ে কোনো আবাসিক হোটেলের উদ্দেশে পা বাড়াল। যদিও আবাসিক হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা তার নেই। তা ছাড়া এত রাতে রুম পাওয়া যাবে কি না সেটাও একটা বিষয়। যা হোক, চেষ্টা তো করতে হবে। একটু এগিয়ে যেতেই অপুর একটু সামনে একটা মাইক্রোবাস এসে থামল। ড্রাইভার নেমে ডাকতে লাগলÑ এই মাওনা, ভালুকা ওঠেন ওঠেন। অপু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। দৌড়ে এগিয়ে যেতেই ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, মামা যাবেন নাকি?
অপু বলল, যাব মানেÑ কোনো গাড়িই পাচ্ছি না, কিন্তু এটা কিসের গাড়ি?
ড্রাইভার বলল, এটা স্টাফ বাস, ফাঁকেঝোঁকে ট্রিপ মারি আরকি। আপনি কোথায় যাবেন?
অপু বলল, মাওনা।
ড্রাইভার বলল, উঠে বসেন।
অপু দেখল ভেতরে দুজন যাত্রী বসা আছে। অপুর মনে কিছুটা কুচকুচে ভাব থাকলেও ততটা ভয় লাগছে না। কেননা, বিভিন্ন স্টাফ গাড়িগুলো সুযোগে ভাড়ায় যাত্রী টানে। নিশ্চিন্ত মনে গাড়িতে উঠে বসল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো তিনজন লোক এসে উঠল। সহযাত্রী পেয়ে এবার সে পুরোপুরি স্বস্তি পেল। গাড়ি চলতে শুরু করল। খালি রাস্তা পেয়ে ড্রাইভার ধুমসে টানছে।
সাধারণত গাড়িতে উঠলে একজন অপরজনের সাথে কথা বলে অথবা স্মার্টফোন ব্যবহারে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু এ গাড়িতে কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। কারো হাতে স্মার্টফোনও নেই। সবাই কেমন মূর্তিমান হয়ে আছে। এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখে এবার একটু ইতস্তত বোধ করল অপু। অজানা আতঙ্ক যেন ঘিরে ধরল তাকে। ড্রাইভারকে বলল, ড্রাইভার সাহেব ভেতরের লাইটটা জ্বেলে দিন।
ড্রাইভার বলল, কেন বই পড়বেন?
অপু বলল, না বই পড়ব না।
ড্রাইভার বলল, তাহলে ঘুমান, লাইট বন্ধ না থাকলে ঘুমাতে পারবেন না। জায়গামতো এলে আপনাকে ডেকে দেবো।
অপু বলল, আপনি লাইট জ্বেলে দিন।
এবার অপুর পাশে বসা লোকটি বলল, ওই শালা এত কথা বলিস ক্যান? চুপ করে বসে থাক।
অপু বলল, মানে?
এবার আর কোনো কথা নেই। অপু কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশের লোকটি তার মুখ চেপে ধরল। গাড়ি ডান দিকে মোড় নিয়ে ঘন শালবনে ঢুকে পড়ল। ঘটনা বেগতিক বুঝতে পেরে অপু ছোটার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করল। কোনো কাজ হলো না। আরো দু-তিনজন অপুকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বনের আরো গভীরে নিয়ে গেল। তাকে গাছের সাথে বেঁধে, মুখে টেপ লাগিয়ে তার স্মার্টফোন, মানিব্যাগ কেড়ে নেয়া হলো। মানিব্যাগে খুব বেশি টাকা না পেলেও পাওয়া গেল একটি এটিএম কার্ড। এবার ড্রাইভার এসে অপুর মাথায় একটি পিস্তল ধরল। ড্রাইভার অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলল, বল তোর কার্ডের পিন নাম্বার বল।
অপুর মুখের টেপ খুলে দেয়া হলো। সে পিন বলল। তাদের একজন লোক বুথে টাকা তুলতে চলে গেল। এ দিকে অপুকে চড়-থাপ্পড়, কিল, ঘুষি মারতে থাকল আরেকজন। তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। অপু বলল, ভাই পাসওয়ার্ড তো দিয়ে দিয়েছি তাহলে মারছেন কেন? আমাকে ছেড়ে দিন।
লোকটি বলল, হা হা হা। হাসালি রে বলদ। এত সহজেই তোকে ছেড়ে দেবো? একটা মাল জোগাড় করা বড় কষ্ট।
অপু বলল, আর কী চান?
লোকটি বলল, এই নে ফোন। তোর বাড়ির নাম্বারে কল দে। বলবি তোকে খুব মারছি। যেন দুই লাখ টাকা পাঠায়। টাকা পাঠালে তোকে ছেড়ে দেবো।
এবার অপু হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে বলল, ভাই আমরা নিম্নবিত্ত মানুষ। একটা এনজিওতে চাকরি করি। যা টাকা ছিল তা ব্যাংকে। কার্ড তো দিয়েই দিয়েছি। বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোর মতো কেউ নেই। আমায় ছেড়ে দিন।
এবার অপুর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। কিন্তু জানোয়ারদের সেগুলো ভাবার বিষয় না। তারা টাকা চাওয়ার জন্য আরো মারধর করছে তাকে। মার সহ্য করতে না পেরে কয়েকবার জ্ঞান হারাল সে। জ্ঞান ফেরার পর আবার অত্যাচার। এবার চাকু দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে পোঁচ মারতে থাকল। আর অপু বাবা গো, মাগো বলে বলে চিৎকার করছে। এত গহিন বনে অবশ্য তার চিৎকার কেউই শুনবে না। বনের এত গহিনে ফরেস্ট অফিসের গার্ডও সচরাচর আসে না। আর সে সুযোগ বুঝেই এরা এরূপ অপকর্মগুলো করে।
অপু অত্যাচার আর সহ্য করতে না পেরে তার স্ত্রীর নাম্বারে কল দিতে বাধ্য হয়। গত রাতে বাসায় ফেরেনি অপু, আজ প্রায় বিকেল হয়ে গেল তখনো কোনো খোঁজ ছিল না। এ দিকে অপুর স্ত্রী ফোনে ট্রাই করতে করতে ধৈর্যের সীমা হারিয়ে ফেলেছিল। হঠাৎ এমন সময় স্বামীর কল পেয়ে মহাখুশি হয়ে কল রিসিভ করতেই ভারী, কাতর একটা কণ্ঠ, ওরা আমাকে জঙ্গলে আটকে রেখেছে। দুই লাখ টাকা দিলে ওরা আমায় ছাড়বে।
এটুকু বলতেই অপুর কান থেকে ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে গেল অপহরণকারীর এক সদস্য। সে কথা বলতে শুরু করল অপুর স্ত্রীর সাথে। সে বলছে, তুই যদি তোর স্বামীকে জীবিত ফেরত পেতে চাস তাহলে দুই লাখ টাকা অমুক জায়গায় রেখে যা। তবে সাবধান! যদি কোনো ছল-চাতুরী করিস অথবা পুলিশকে জানাস তাহলে তোর স্বামীর লাশ পাবি, লাশ। এটুকু বলেই ফোনটা রেখে দিলো।
অপুর স্ত্রী বাবার বাড়িতে গিয়ে ঘটনা খুলে বললে তারা আইনের আশ্রয় নেয়ার কথা বলে। অপুর স্ত্রী তাতে অসম্মতি জানায় এবং বাবার পায়ে ধরে টাকার ব্যবস্থা করতে বলে। অবশেষে বহু ধারদেনা করে অপুর শ্বশুর টাকার ব্যবস্থা করে জায়গামতো রেখে দেয়। তখন ফোন দিয়ে অপুর শ্বশুর বলে বাবা, টাকা রেখে এসেছি। এবার তোমরা আমার জামাইকে ছেড়ে দাও।
ওপাশ থেকে এক লোক বলে, তোরা বাসায় চলে যা, গিয়ে দেখবি তোদের জামাই বাসায় চলে গেছে।
এ কথা বলে ফোন কেটে দিলো। তারপর আর এক মুহূর্তের জন্যও নাম্বারটা খোলা পেল না তারা। অপারগ হয়ে বাড়িতে চলে গেল।
আর এসব ঘটনাই অপুর সামনে ঘটল। এবার অপু বলল, এবার তো আমায় ছেড়ে দাও। আমি আর পারছি না। মনে হচ্ছে মারা যাবো। খুব কষ্ট হচ্ছে। এবার সেই গাড়ির ড্রাইভারটা এসে হাজির। ঠিক আছে তোকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি। বলেই অপুর গলাটা চেপে ধরল। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হলো।
পরদিন অপুর স্ত্রী, শ্বশুর তার কোনো সন্ধান না পেয়ে থানায় গিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলল। আর পুলিশ তো শোনেই অবাক! আপনারা এখন থানায় এসেছেন? যখন টাকা চেয়েছিল তখনই আসা উচিত ছিল, যা হোক, আপনারা যান, আমরা দেখছি। পুলিশ কয়েকটি ফোর্স পাঠিয়ে সারা বন খুঁজে শেষ পর্যন্ত অপুকে পেল ক্ষতবিক্ষত অবস্থায়। ময়নাতদন্তের পর খবর জানা গেল অপুর চোখ, লিভার, কিডনি, হৃৎপিণ্ড এসব নিয়ে গেছে। তার স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে। অপুর স্ত্রী, শ্বশুর, আত্মীয়স্বজনের কান্নায় ভারী হয়ে উঠল চারপাশের পরিবেশ।