জগলুর সিনেবাতিক
- রবিউল ফিরোজ
- ১৮ জুলাই ২০১৯, ০০:০০
লোকটা গেছে আরেক অঞ্চলে কাজ করতে। গৃহস্থ এটা দেখায় সেটা দেখায় কিন্তু বেচারা কামলার কিছুতেই মন ওঠে না। তার মন খুঁতখুঁত করে। অবস্থা দেখে মালিক বলে ওঠে, আরে ভায়ো মাছ বেইচা তোমাকেরে সিনেমা দেখ্যা অভ্যাস। কাম করতে ক্যানে আসোচিন?
সত্যি কথাই বটে। নদীর ধারের মানুষ তাই মাছধরা আর বিক্রি করার অভ্যাস অনেকেরই আছে। যত মাছ বিক্রি হাতে তত বেশি টাকা আর তত বেশি সিনেমা দেখা! কেউ কেউ বলে, আমাদের এখানকার মাটিরই দোষ। জগলুও সেই উপাদানেই তৈরি। তাই সিনেবাতিক রোগ তারও আছে।
বেশ কিছু টাকা হাতে পাওয়া মাত্র জগলু প্যান্ট শার্ট লাগিয়ে ফুলবাবু সেজে রওনা দেয়। ঠোঁটের কোণে একটা সিগারেট গুঁজে তাতে অগ্নিসংযোগ করে পথ চলতে নিজেকে যেন হিরো হিরো লাগে। নিজেকে সিনেমার নায়ক ভাবতে বড়ই ভালো লাগে। দু’একজন নায়িকা তাকে পাবার জন্য ঘুরঘুর করছে, এমন একটা রোমান্টিক কল্পনার মূল্য হাজারো লক্ষ টাকা! আহা কী আনন্দ!
কল্পনাতে যতই সিনেমার নায়ক হোক বাস্তবে সে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে পালিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বলল, বাবারে বাবা বাঁচলাম!
সিনেমা হল থেকে বের হয়ে একাকী হাঁটছে জগলু। স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠে বাড়ি যেতে হবে। মুডি নায়কের মতোই সে পথ চলছে আর সিনেমার রস আস্বাদন করছে। গরুর মতো জাবরকাটা আর কি। পাশের অপরিচিত লোকটি জগলুর গা ঘেঁষে সামনে এগিয়ে গেল। এমনিতেই অসহ্য গরম তার ওপর গা ঘেঁষাঘেঁষি। একদম অসহ্য। দানাপানি পেটে ফেলে পেট ঠাণ্ডা করে সবেমাত্র হাঁটতে শুরু করেছে। আমচকা কথায় ওর ধ্যান ভাঙে- আরে ভাই, তুমি এখানে?
জগলুর সম্মুখে তিন চারটা যুবক দাঁড়িয়ে। পূর্বের বাক্যের সাথে আরো কথা যুক্ত হয়।... কতদিন পর তোমার দেখা। হ্যান্ডশেক করার জন্য হাতখানি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমারে চিনতে পারছ?
জগলুর হাত বাড়িয়ে দেয়ার আগেই সে হাতটি লুফে নিয়ে গভীরভাবে মর্দন শুরু করেছে। জগলু যখন হাতটি ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টায় রত, তখন হাতখানি অন্য দু’টি হাতের মধ্যে লুটোপুটি করছে। এতটা অভিবাদন এই রাস্তার মধ্যে অন্তত আশা করেনি জগলু। শেষের কথার উত্তর দিতে গিয়ে জগলু বলল, ভাই আপনেরে তো ঠিক চিনতে পারনু না। সে অতিশয় বিস্ময়ের ভান করে বলল, আরে বন্ধু তুমি বলছ কী? তোমার বাড়ি তো মান্দা।
মনে মনে জগলু বলে, হালার পো হালায় কয় কি। মুখে বলে, আমার বাড়ি মান্দা হবে ক্যান। আমার বাড়ি আত্রাই।
- ওহ হো বন্ধু ভুলে গেছিলাম। এইবার ঠিক মনে হইছে। থানার তিন মাইল পশ্চিমে তোমার বাড়ি। বাড়ির পাশে একটা পুকুর আছে, তাই না?
- পশ্চিমে হবে ক্যান। বলেন পূর্বে।
- সেইতো সেইতো। শালা কিচ্ছু মনে থাকে না। তোমার সাথে কত ঘুরে বেড়ালাম সেবার।
জগলুর কিছুই মনে পড়ছে না। হালার পো শয়তানির আর জায়গা পেল না। জগলু বলে, রাস্তা ছাড়েন ভাই। আমার ট্রেন ধরা লাগবি।
- আরে বন্ধু থামো। যাবে তো অবশ্যই। তার আগে এসো নাস্তা করি। সেবার তুমি কত্ত আদর-যতœ করলে। এতদিন বাদে তোমার দেখা পেয়েও খালিমুখে যেতে দেবো? তা হয় না, তা হয় না।
- না নাস্তা করব না, যেতে দাও।
বন্ধু বাহিনী ঘিরে রেখেছে জগলুকে। ইচ্ছে হলেই দৌড় লাগানো সম্ভব নয়।
- বন্ধু তুমি আমায় সিগারেট টানতে দিছিলে সেটাও বুঝি মনে নাই?
- চেনা নেই, জানা নেই অপরিচিত মানুষকে এভাবে নাজেহাল করার মানে কী ভাই?
- মানে বুঝবে? এসো তাহলে আমার সাথে এসো।
মানে বোঝার চার পয়সার কৌতূহলও জগলুর মধ্যে নেই। তাহলে কি হবে, ওদের মধ্যে তো আছে। তাই জগলুল হায়দারকে মানে বুঝিয়েই ছাড়বে। রূপালী পর্দায় নায়কের অ্যাকশন দৃশ্য বেমালুম ভুলে গেল জগলু। একটু আগের মুডি নায়ক হয়ে গেল সুবোধ বালক। তদুপরি ক’জন ছেলে প্রায় জোরজবরদস্তি করেই বদ্ধঘরে টেনে নিয়ে গেল। বন্ধুত্ব রক্ষার্থে নাস্তার আয়োজন। আদি স্বরূপ উন্মোচন করে গর্জে উঠে বলল, তোর কাছে যা কিছু আছে সব বের কর।
- সামান্য কয়ডা ট্যাকা আছে লিও না ভাই।
- সামান্য টাকা? এতবড় মিথ্যা বললি? নাশতা তো ঝাড়িইনি। এই কদমা কই গেলি? মনে হচ্ছে বন্ধুকে নাশতা দিতে হবে।
ওদের সঙ্গী কদমা বাহাদুর এগিয়ে আসছে দেখে ভয় বেড়ে গেল জগলুর। চোখের অনুনয় হয়তো ওদের নজরে পড়েছে। বলল, মাফ করলাম। পকেট থেকে বের করে দ্যাখ, তোর কাছে সাত শ’ পয়ষট্টি টাকা পঞ্চাশ পয়সা এখনো অবশিষ্ট আছে।
জগলু বের করে দেখল কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। সত্যি সত্যি ওকে ওস্তাদ বলে মনে ধরল। পয়সাকড়ির হিসাবটাও কড়ায়গণ্ডায় ঠিক রেখেছে। অথচ পকেটটা আমার। ওর মতো এত সূক্ষ্ম হিসাব জানলে তো আর ম্যাট্রিকে তিন-তিনবার ডাব্বা মারতে হতো না। তারা মাস্টারের কথাও হজম করা লাগত না। এরা কখন পিছু নিয়েছে আর কতবার যে টাকা গুণে পকেটে রেখেছে উপরওয়ালাই জানে। এত কিছু করেছে অথচ ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। মুখ ফুটে জগলু বলল, ভাইসাব, আপনারা কোন বিদ্যার বলে জানলেন আমার পকেটে ট্যাকাগুলান আছে?
বিজয়ীর হাসি হেসে বলল, টেকনিক, টেকনিক। সিনেমা হল থেকে তোর বের হওয়ার পর থেকেই জানি।
জগলুর স্মরণ হলো। হল থেকে বের হওয়ার পর গা ঘেঁষ লাগার কথা। তখন ব্যাপারটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পথখরচা বলে একটা কথা আছে। এভাবে শূন্য হাতে বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব নয়। ওদের বস আর জগলুর পরমবন্ধু জানালেন, জীবনটা নিয়ে যাচ্ছিস সেটাই তো অনেক বড়। অতঃপর জগলুর সেই বন্ধু আরেকটা হাঁক ছেড়ে বললেন, কই গেলি রে শালা কদমা? এই শালার পকেটে দশটা টাকা ঢুকিয়ে দে।
বাইরে বের হতেই জগলুর দেহ টলতে লাগল। পকেট থেকে ১০ টাকার নোটখানি বের করে হস্তপরশ বুলিয়ে আবার পকেটে রাখে। মাঝে মধ্যে পকেটে হাত দিয়ে স্পর্শ করে। সান্ত্বনা খোঁজে। স্টেশনে পৌঁছার আগেই জগলু গান ধরে, গাড়ি চলে না.. চলে না.. চলে না রে...