ওগো বিদেশিনী
- জোবায়ের রাজু
- ২৭ জুন ২০১৯, ০০:০০
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমরা নজির খানের প্রকাণ্ড বাড়িতে পৌঁছলাম। ড্রয়িং রুমে আমি আর দুলাভাই বসে আছি। নজির খানের মেয়ে অনন্যাকে দেখতে এসেছি আমরা। পাত্র আমি নিজেই।
নজির খান কানাডা থেকে সপরিবারে এসেছেন মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য। এখানে আসার আগে শুনেছি এ যাবত শ’খানেক পাত্র তারা যাচাই-বাচাই করেছেন। কোনো পাত্রই অনন্যার চয়েস হচ্ছে না। তার চাই স্মার্ট, আন কমন, সুদর্শন যুবক। অনন্যা দেখতে তেমন ভালো না বলে স্মার্ট পাত্ররা তার ধার ধারতে আসে না। কানাডা উন্নত দেশ। সেখানে নাগরিকত্ব পেতে অনন্যার মতো বিদেশিনীকে বিয়ে করতে আমার মতো মধ্যবিত্ত ছেলেরা সানন্দে রাজি। হয়তো এ কারণে আব্বা আমাকে দুলাভাইয়ের সাথে এখানে পাঠিয়েছেন। জানি না আমাকে অনন্যার পছন্দ হবে কি না!
ভেতর থেকে খবর এলোÑ বিদেশিনী ড্রয়িং রুমে আসবে না। তাকে দর্শন করতে হলে তার রুমে যেতে হবে। কি আর করা। কোরবানির গরু দেখার মতো অনন্যার রুমে গেলাম।
বিদেশিনীকে দেখে চমকালাম। বিদেশিনী মুখে গাঢ় মেকআপ মেখে ভুত সেজে বসে আছে। মেকআপে মেয়েদের রূপ দ্বিগুণ বাড়ে, কিন্তু এই বিদেশিনীকে ভূত ভূত লাগছে। বিদেশিনী প্রথমেই আমার দিকে তাকিয়ে তার নাক সিঁটকানোর ভাব দেখে বুঝলাম, সে খুব দেমাগি এবং আমাকে সেই শ’খানেক পরিত্যক্ত পাত্রের কাতারে ফেলেছে। সে আমাকে প্রথমেই তাচ্ছিল্যের সুরে ঠোঁট বাঁকিয়ে যে কথাটি বলল, সেটা হচ্ছেÑ ‘সেলুনে যাও না? চুল এত বড় কেন?’
বুঝলাম আমায় অপমান করা হচ্ছে। আমিও ছেড়ে দেয়ার পাত্র নই। দরাজ গলায় বললামÑ ‘নিয়মিত সেলুনে যাই। তুমি কত বছর হলো দাঁত মাজো না? দাঁতের এ অবস্থা কেন?’
চোখ বড় বড় করে বিদেশিনী বললÑ ‘মানে?’
আমি বললামÑ ‘না মানে, দাঁতের এই অবস্থা কেন? মুখে মেকআপ ঘষে যেখানে ভূত সেজেছ, সেভাবে দাঁত ঘষলে এভাবে দাঁত থেকে বিশ্রি গন্ধ আসত না।’
বিদেশিনী চট করে বললÑ ‘দাঁতের গন্ধ না, আমি বিদেশী চকলেট খাচ্ছি। আচ্ছা তুমি জবটব করো? পেমেন্ট কেমন দেয়? হাতখরচ চলে তো?’
বিদেশিনী সূক্ষ¥ভাবে আমাকে অপমান করছে। আমিও ছেড়ে দেবো কেন? চটজলদি বললামÑ ‘হ্যাঁ জব করি। ৩০ হাজার টাকা মাইনে। তা তুমি কানাডার কোন হোটেলে পেঁয়াজ কাটো? সেখানে বসে বসে তো আর হাওয়া খাও না, নিশ্চই হোটেলে চামচাগিরি করো, নয়তো বাসায় বাসায় গিয়ে থালাবাসন মেজে আসো!’
দাঁতে দাঁত চেপে বিদেশিনী বললÑ ‘শাট আপ! আমাকে দেখে কি সে রকম মনে হয় তোমার?’
পাল্টা জবাব দিলামÑ ‘কড়া মেকআপ মেখে ভূত সেজে আছো বলে তো আসল চেহারা ঢাকা পড়েছে। যাও মুখ ধুয়ে আসো, মেকআপ সরে গেলে প্রমাণ হবে মুখে কি পরিমাণ মেছতার দাগ আছে। কানাডায় রোড সাফ করতে করতে মুখে মেছতা পড়ে গেছে নিশ্চয়ই!’
বিদেশিনী এবার নরম গলায় বললÑ ‘তোমাকে আমার ভদ্র মনে হচ্ছে না। কয়টা মেয়ে পটিয়েছ?’
বললামÑ ‘এসব স্বভাব আমার নেই। বরং কয়টা প্রেমপত্র পেয়েছি সেটা দেখবে? আচ্ছা তোমাকে কয়টা ছেলে ‘হাফ টিকিট’ বলেছে?’
বিস্ময় নিয়ে বিদেশিনী বললÑ ‘কেন , হাফটিকিট বলবে কেন?’
সুযোগ পেয়ে বললামÑ‘ইয়ে মানে, এত উঁচু হিল জুতা পরে টল ফিগার দেখাচ্ছ, আমি তো এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। তুমি সাইজে এত খাটো।’
লজ্জা পেয়ে বিদেশিনী খানিক চুপ থেকে বললÑ ‘তোমার গায়ের শার্টটা ভালো ব্র্যান্ডের মনে হচ্ছে না।’
এই দেমাগি বিদেশিনীর প্রতিটি বাক্য আমাকে ইনসাল্ট করা। আমিও বললামÑ ‘তোমার গায়ের জামাটা খুব দামি হলেও তোমাকে মোটেও মানায়নি। মনে হচ্ছে, আমার সামনে ধানক্ষেতের একটা কাকতাড়–য়া হিল জুতা পরে দাঁড়িয়ে আছে।’
বিদেশিনী ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে বললÑ ‘এটা বসুন্ধরা সিটি থেকে কেনা। জানো এটার দাম কত?’
বিদেশিনী দাম বলার আগেই বললামÑ ‘কানাডা থেকে পেঁয়াজ কেটে এলে আমি আরো দামি শার্ট কিনতাম।’
আমার কথা শেষ না হতেই বন্ধু রনির কল। এই মুহূর্তে আমি বিদেশিনীর মুখোমুখি বলে লাইন কেটে দিতেই বিদেশিনী প্রশ্ন করলÑ ‘তোমার ফোনে এটা কি ধরনের গানের রিংটোন?’
বললামÑ ‘এটা রবীন্দ্র সঙ্গীতের টোন।’
বিদেশিনী তার বোঁচা নাক দুই বিঘা উপরে উঠিয়ে বললÑ ‘আমি এসব গান লাইক করি না। আমার পছন্দ মাইকেল জ্যাকসন। সে আমার ফেভারিট সিঙ্গার।’
বিদেশিনী দেখি গানবাজনা নিয়েও বড়াই করে। দাঁড়াও ধরা দিচ্ছি। বললামÑ ‘বলো তো, মাইকেল জ্যাকসনের জন্ম কত সালে?’
বিদেশিনী আমতা আমতা করে বললÑ ‘ইয়ে মানে। জানতাম, এখন ভুলে গেছি।’
কড়া গলায় বললামÑ ‘ভুলে গেছ? না? পণ্ডিতির আর জায়গা পাও না? সবার সাথে পণ্ডিতি করবে না আজ থেকে।’
আমার কথা শুনতেই পায়নি, এমন ভঙ্গিমায় বিদেশিনী বললÑ ‘সোজা হয়ে দাঁড়াও, তোমার ছবি তুলি। আমাকে যেসব পাত্র বিয়ে করতে এসে ব্যর্থ হয়েছে, সবার ছবি আমি আমার এই ৮০ হাজার টাকা দামের মোবাইলে তুলে রেখেছি। এই দেখো, সবার ছবি।’
তাচ্ছিল্যে বললামÑ ‘মোবাইলের দাম ৮০ হাজার, এটা আমাকে না শোনালেও চলতো। দেখি তোমার পাত্রের অ্যালবাম!’
ছবিতে যে ছেলেগুলোর ছবি দেখলাম, এরা আমার চেয়েও বেশ স্মার্ট। বিদেশিনী এদের কেন বহিষ্কার করল, বুঝলাম না। বললামÑ‘এরা সবাই বেশ সুন্দর। পছন্দ করছ না কেন? তোমার মনে হয় আফ্রিকান নিগ্রো পছন্দ!’
আমার কথায় বিদেশিনী চিৎকার দিয়ে বললÑ‘স্টপ ইউর মাউথ।’
ক্ষেপে বললামÑ ‘এত জোরে চিৎকার করছ কেন? পেটে সুতাকৃমি আছে নাকি? থাকলে বসে বসে সুতাকৃমির বড়ি খাও। আমি আপাতত আসি। তোমাকে বিয়ে করলে আমাকে বাকি জীবন সুতাকৃমির বড়ি খেতে হবে। দরকার নেই বাবা। বাই। ’
আমার কথা শুনে বিদেশিনী সাপের মতো ফোঁস করে উঠল।