আব্বা এবং কৈ মাছ
- জোবায়ের রাজু
- ২০ জুন ২০১৯, ০০:০০
কিশোরবেলায় ভূতপ্রেতের গল্পের বইয়ের প্রতি আমার এক ঘোর ছিল। ফলে ওই বয়সেই ভূতের গল্পের অনেকগুলো বই পড়ে ফেলেছি। কিন্তু এসব বই পড়ার পর যে সমস্যাটি নিয়মিত হতো, তা হলোÑ ভয়। ভূতের বই পড়ার পর বাস্তবেও ওসব কল্পনার তৃতীয় চোখে দেখা ভূতদের যেন আমি স্পষ্ট দেখতাম আর ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। ফলে একা একা কোথাও যাওয়া থেকে বিরত থাকা, ঘরের চালে গাছের পাতা পড়লেও সেটাকে ভূতে ঢিল ছুড়েছে বলে দাবি করা, সন্ধ্যায় ভালো করে জানালা বন্ধ করে পাঠ্যবইয়ে মন দেয়াÑ এসব টুকটাক ব্যাপারে আমাকে খুব ভয় জেঁকে বসতে শুরু করে। আমার মধ্যে এই ব্যাপারগুলো দেখে আব্বা কড়াগলায় হুকুম জারি করলেন, ‘আজ থেকে এসব বই পড়া বন্ধ।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা! প্রয়োজনে একবেলা না খেয়ে থাকব, কিন্তু একবেলা ভূতের গল্প পড়ব না, এটা মানা যায় না। আব্বা যখনই ভূতের গল্প পড়তে বারণ করতেন, প্রতিবারই তাকে বলতাম, ‘কৈ মাছ কিনে আনলে আর কখনো ভূতের গল্প পড়ব না।’ আমার আবদার রক্ষা না করে আব্বা বলতেন, ‘কখনো কৈ মাছ কিনব না।’
কোনো এক অদ্ভুত কারণে আব্বা কৈ মাছ পছন্দ করতেন না এবং আমাদের ঘরে কখনো কৈ মাছ রান্না হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। বড় খালার বাড়িতে একবার কৈ মাছ খেয়ে সেই যে আমার প্রিয় মাছের তালিকায় কৈ মাছও যুক্ত হয়েছে, আজো কৈ মাছের তীব্র লোভ থেকে আমি রক্ষা পাইনি। ইলিশ, বোয়াল, টাকি, পুঁটি, সব মাছ আব্বা মহানন্দে কিনলেও কখনো কৈ মাছ কেনেন না। ফলে মনে মনে আব্বার প্রতি আমার অভিযোগের শেষ নেই।
মনে আছে, সেই ছিল এক সূর্যজ্বলা ঝলমলে সকাল। হাবিব স্যারের বাসা থেকে প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিলাম। পথিমধ্যে আব্বার সাথে দেখা। আব্বা হাট থেকে ফিরছিলেন বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে। আমার হাতে সেই ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা বাড়ি নিয়ে যা। আলু কিনতে ভুলে গেছি। আবার যেতে হবে হাটে।’
বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম ব্যাগের ভেতর কী যেন কিছুক্ষণ পর পর নড়ে চড়ে ওঠে। কী হতে পারে ব্যাগে! ভূত! হ্যাঁ ভূতই! সেদিন ভূতের গল্পে পড়েছি ব্যাগের ভেতরেও ভূত তার আস্তানা গড়ে। এটা নিশ্চয়ই সেই আলামত। ওমা, এখন কী হবে! ভূতশুদ্ধ ব্যাগ হাতে নিয়ে আমি বাড়ি যাচ্ছি! ভয়ে আমার গা হিম হয়ে আসছে। খেয়াল করলাম বাজারের ব্যাগের ভেতরে ভূত আরো দ্বিগুণ জোরে নড়ছে। নিশ্চয়ই ভূত এখন ব্যাগ থেকে বের হয়ে তার ধারালো হাত দিয়ে আমার গলা টিপে ধরবে। না না, ভূতকে এই সুযোগ দেয়া যায় না। তার আগে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। পাশে যে ডোবা দেখতে পাচ্ছি, সেখানে বাজারের ব্যাগটি ঢিলের মতো ছুড়ে ফেলে দিয়ে দিলাম ভোঁ-দৌড়। এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে এসে মনে হলো বড় বাঁচন বাঁচলাম আজ।
মা এই ঘটনা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে বললেন, ‘বাজারের ব্যাগে ভূত আসবে কোথা থেকে!’
দুপুরে আব্বা এসে কাহিনী শুনে বললেন, ‘ব্যাগে তো জলজ্যান্ত কৈ মাছ ছিল। তোমার ছেলে কৈ মাছ পছন্দ করে। ওর জন্য কিনেছি। কৈ মাছ নড়ছে, আর তোমার ছেলে ভেবেছে ভূত...। ছেলেটা এত বেকুব কেন?’
সব শুনে আমার যখন লজ্জায় মরি মরি অবস্থা, আব্বা তখন পাশে এসে চেঁচিয়ে বললেন, ‘ভূতের বই পড়তে পড়তে ভূতও তোর মধ্যে ভর করেছে। আজ সব ভূতের বই নিয়ে যাচ্ছি।’
আব্বা সত্যি সত্যিই আমার সব ভূতের গল্পের বই নিয়ে বন্দী করে রাখলেন তার আলমারিতে। কিন্তু ভূতের গল্পের বই ছাড়া যে আমি অচল। কী পড়ব এখন! মনটাই খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ নিয়ে ডুবে গেলাম গভীর ঘুমে।
মধ্যরাতে মা ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললেন। আমি নাকি না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। শিয়রে বসে মা বললেন, ‘উঠ খোকা। ভাত খাবি।’
ঘুম চোখে মাকে বললাম, ‘না, খাবো না। ঘুমাব।’
তবু মা বিনয় গলায় বললেন, ‘খেতে হবে। তোর বাবা তোর জন্য আবার কৈ মাছ কিনে এনেছেন। আয় খাবি।’
কৈ মাছ! কৈ মাছের কথা শুনে চোখ থেকে ঘুম পালাল।
মা ভাত বেড়ে দিলেন। প্লেটে কী সুন্দর দুটো কৈ মাছ ভাজা। কত দিন পর আমি কৈ মাছ খেতে যাচ্ছি। আব্বা সম্ভবত তার জীবনে আজই প্রথম কৈ মাছ কিনেছেন, তাও আমার জন্য। এটা ভাবতে গিয়ে আমার চোখে পানি চলে এলো। বাবারা এত ভালো হয় কেন?