প্রেমের খেতাপুরি!
- মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
- ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
হুদা ভাই একদা কঠিন পণ করে ফেললেনÑ তার থেকে দেড় হাত উচ্চতা বিশিষ্ট কোনো মেয়েকে তিনি বউ করে ঘরে আনবেন, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম তার মতো বেঁটে না হয়। এই পণকে সাফল্যমণ্ডিত করে তুলতে তিনি উত্তর পাড়ার প্রেমার পিছু নিলেন। প্রথম প্রথম প্রেমা ঝারি দিলেও আস্তে আস্তে ভালো ভাবতে শুরু করল। যদিও তখনো ভালোবাসেনি কিন্তু বাসতে কতক্ষণÑ ভাবলেন হুদা ভাই। তিনি প্রতিদিন কলেজে যাওয়ার পথে দোকান থেকে তেঁতুলের প্যাকেট কিনে প্রেমাকে দিতেন।
প্রেমাও সূর্যমুখী মার্কা হাসি উপহার দিয়ে হুদা ভাইয়ের দেয়া তেঁতুলের প্যাকেট ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে ফেলত। এভাবেই প্রেমার জন্য হুদা ভাইয়ের হৃদয়ের এক কোণে বিশাল এক পুকুরের সৃষ্টি হলো। আর সেই পুকুরে পানির পরিবর্তে ভালোবাসা জমতে জমতে টইটুম্বুর হয়ে গেল। একদিন প্রেমাকে নিয়ে কিতা সব স্বপ্নে দেখলেন হুদা ভাই। তিনি ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্বপ্নে দেখা দৃশ্যগুলো মনের আয়নায় দেখে লজ্জায় দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘ইউরেকা।’
সেদিন কলেজে যাওয়ার সময় প্রেমার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলেন হুদা ভাই। এক মুষ্টি গোলাপ ফুল সামনে এগিয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বললেন, ‘লাভ ইউ প্রেমা।’
কিন্তু হায়! হুদা ভাই কী ভেবেছিলেন আর কী হলো। চোখ খোলার আগেই ঠাসঠাস কঞ্চির বারি পড়তে লাগল হুদা ভাইয়ের পিঠে। তিনি ইতোমধ্যে বুঝে গেলেন, নৌকা স্রোতের উল্টো দিতে চলতে শুরু করেছে। তাই তিনি এদিক-সেদিক না তাকিয়েই ধানক্ষেত বরাবর দৌড় লাগালেন। ওই একবারই হুদা ভাইয়ের জীবনে প্রেম এসেছিল। এরপর যদিও ষোলটি শীত বসন্ত গত হয়ে গেছে কিন্তু কোনো প্রেমের দেখা পাননি। গতকাল তিনি দেখলেন দোকানিরা ফুলের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। সামনেই বাংলা নববর্ষ। এ উপলক্ষে অনেক প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ ফুল উপহার দেবে। হুদা ভাইয়ের সুপ্ত ভালোবাসা তপ্ত হয়ে মাথাচারা দিয়ে উঠল। পাশের সেলুনে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। নিজের চেহারাখান আয়নার পেছনে দেখে ভাবলেনÑ ‘বয়স বাড়লেও বয়সের ছাপ কিন্তু চোখে-মুখে একদমই পড়েনি। এমনও তো হতে পারে আমার মতো প্রেমার জীবনেও আর কোনো প্রেম আসেনি। এখনো অবিবাহিত থেকে আমার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। ভালোবাসা তো আর ফেলনা নয় যে প্রতিদিন জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারবে। আচ্ছা, একবার গিয়ে দেখাই যাক না।’
তিনি একগুচ্ছ গোলাপ প্যান্টের পেছনের পকেটে ভরে হাটিহাটি পা পা করে চলে এলেন উত্তরপাড়ায়। কলবেল চাপলেন। এক যুবতি এসে দরজা খুলে দিলো। এই যুবতিকে দেখে তো হুদা ভাইয়ের চোখ কপালে। বললেন, ‘তুমি প্রেমা না!’
মেয়ে কোনো কথা না বলে মুচকি হেসে চলে গেল। হুদা ভাই ডাইনিং টেবিলের পাশে বসে মনে মনে বলছেন, ‘প্রেমার বয়স তো বাড়েইনি বরং আরো কমেছে মনে হচ্ছে। ঠিক আমার মতো।’
তিনি মনের সুখে ডাইনিং টেবিল দিয়ে তবলা বাজাচ্ছেন। এমন সময় রুম থেকে একজন মহিলা বের হলেন। মুখে মেছতার দাগ, বয়সের ছাপÑ সব মিলিয়ে যেন সদ্য বসন্ত রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। মহিলা হুদা ভাইকে দেখে বললেন, ‘আরে হুদা যে, কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। তুমি তো আগের মতোই তাগড়া জোয়ানই আছো।’
হুদা ভাই আশ্চর্য হলেন। বললেন, ‘প্রেমার মা আমাকে কী করে চিনে ফেলল! আবার আমার নামও জানে!’
মহিলা ডাকলেন, ‘প্রিয়া, হুদার জন্য একগ্লাস সরবত করে আন তো মা। তা হুদা, তোমার ছেলেমেয়ে কয়জন?’
হুদা ভাই লাজুক হাসলেন। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, ‘বিয়েটা এখনো করা হয়নি।’
‘নিশ্চয় কারো প্রেমে পড়েছ। আর তার জন্য অপেক্ষায় আছ। এ বিষয়ে লজ্জা পেয়ো না, কাউকে পছন্দ থাকলে মুখ ফুটে বলে ফেলো, দেখবে সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।’
মহিলা হুদা ভাইয়ের পেছনের পকেটের দিকে উঁকিঝুঁকি মেরে বললেন, ‘আরে, তোমার পকেটে দেখছি গোলাপ। এই ফুলগুলো নিশ্চয় তোমার প্রিয় মানুষকে দেয়ার জন্য কিনেছ। ঠিক করেছ। দিয়ে দাও, দিয়ে দাও।’
মহিলার মুখে এত সব প্রশংসা শুনে হুদা ভাইয়ের বুক সাহসে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, ‘কেমন দরদি মা, ঠিকই বুঝে গেছেন যে আমি তার মেয়েকে ভালোবাসি।’
এমন সময় প্রেমা এসে তার মায়ের পাশে দাঁড়াল। হুদা ভাই ভাবলেন, এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। ঘটনাটা ডিসমিস করা যাক তাহলে। তিনি পেছনের পকেট হতে ফুলগুলো হাতে নিয়ে বললেন, ‘খালা, আসলে আমি আপনার মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসি। ওর জন্যই ফুলগুলো কিনেছি।’
মহিলা হাঁ করে রইলেন। বললেন, ‘তাই নাকি?’
হুদা ভাই বললেন, ‘ওর জন্য জীবন যৌবন সবকিছুই দিতে প্রস্তুত খালা।’
মহিলা মেয়েকে বললেন, ‘প্রিয়া, একটা ঝাঁটা নিয়ে আয় তো।’
হুদা ভাই বিব্রত বোধ করলেন। বললেন, ‘খালাম্মা, ঝাঁটা কেন?’
মহিলা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘ঝাঁটা কেন বুঝতে পারোনি, একটু দাঁড়াও বুঝাচ্ছি। আমাকে ফুল দেয়ার অপরাধে সেদিন কঞ্চির বারি খেয়েছিলে, আজ আমার মেয়েকে ফুল দেয়ার অপরাধে ঝাঁটার বাড়ি খাবে। আমাকে কি না বলে খালাম্মা।’
হুদা ভাই এত ক্ষণে বুঝে গেছেন, আসলে ওই মহিলাই সেই প্রেমা আর এই যুবতি মেয়েটি প্রেমার মেয়ে। সে হুমড়ি খেয়ে দরজার ওপারে এসে হাঁপ ছেড়ে বললেন, ‘প্রেমের খেতাপুরি।’