কেরামত মাস্টারের ছেলে
- আজম সিদ্দিক রুমি
- ১০ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
বিজয়নগর উচ্চবিদ্যালয় সম্পর্কে সাহালের অজানা কিছুই নেই। কারণ এখানে তার বাসা। সে তার মামার জন্য ভিন দেশে পড়াশোনা করত। সাহাল পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। গেল কিছু দিন আগে সমাপনী পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কতই না তার মনে আনন্দ। বোঝাতে পারবে না। পরীক্ষা শেষ। খুব খুশি। সাহালের মামারও যাওয়ার সময় হলো। তিনি স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনার জন্য পাড়ি দেবেন। ভাওয়াল গড়ে সাহালের আর থাকা হবে না। মনটা খুব খারাপ। বন্ধুবান্ধব সবাইকে ছেড়ে ভাওয়াল গড় ত্যাগ করা সাহালের জন্য কষ্টকর। কিন্তু বিধিবাম, কিচ্ছুটি করার থাকে না। সাহালের আর ভাওয়াল গড় থেকে পড়াশোনা করা হবে না। সাহালকে বিজনগর তার গ্রামের বাসায় পাঠিয়ে দিলো। রেজাল্ট হলো। ভালো রেজাল্ট করেছে। সব বিষয়ে এ+ পেয়েছে একটি বিষয় বাদে, সেটা হচ্ছে ইংরেজি। সাহাল ইংরেজিতে একটু-আধটু নয়, ভালোই কাঁচা। তবুও পরিবারে সবাই মহাখুশি। সাহালকে ভালো একটি স্কুলে ভর্তি করাবে। কিন্তু বাইরে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার বাবা কেরামত মাস্টার। ছেলেকে খুব কাছাকাছি রাখবে। প্রায় তিন বছর থেকে পৃথক। দূরে পড়াশোনা করে। এখন আর দূরে নয়। আমাদের বাড়ির পাশে বিজয়নগর উচ্চ বিদ্যালয় আছে। এখানে ভর্তি করে দিলে খুব একটা মন্দ হবে না। দেখাশোনা ভালো হবে। ছেলেকে দূরে একা একা রাখলে ছেলেটা আমার থেকে আরো দূরে চলে যাবে। গভীর দূরত্ব তৈরি হবে। সে জন্য আমি কোনো আশার দিক না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত। বরং এখানে পড়বে সবসময় চোখে চোখে থাকবে। পিতামাতার শাসন হলো একজন ছাত্রের প্রাথমিক ভূষণ। জীবনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সাহাল বাইরে থাকলে সেটা আর হয়ে উঠবে না। এসএসসি পর্যন্ত থাক না আমাদের কাছে। তারপর না হয় চলে যাবে। কেরামত মাস্টারের বড় ইচ্ছে তার ছেলে সরকারি একজন ডাক্তার হবে। মানুষের সেবায় তার প্রতিটি রক্তবিন্দু নিয়োজিত থাকবে। কতই না ভালো হবে। আর আমি সেটাই করব। কেরামত মাস্টার অন্য একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। অনেক ভালো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ছেলেমেয়েকে খুব আদর করেন। একদমই মারধর করেন না। ব্যবহার আচার আচরণে মিষ্টভাষায় সব ছাত্রছাত্রীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।
ছাত্রছাত্রীরাও জানে কোনো বিষয়ের আবেদন করলে একজনই পারবে তাদের আবেদন অধ্যক্ষর কাছে মঞ্জুর করাতে। অন্য কোনো শিক্ষকের কাছে না গিয়ে সোজা কেরামত মাস্টারের কাছে সবার শুভাগমন হয়। যদিও কেরামত মাস্টার ইদানীং একটু বিজি সময় পার করেন। ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের দায়দায়িত্ব পালন করছেন।
২.
সাহাল নতুন স্কুলে ভর্তি হলো। নিজের এলাকা অথচ সাহালের কেন যেন এখানে ভালো লাগছে না? অনেক বন্ধুবান্ধবের শোকে মন মরা হয়ে একা একা থাকে। প্রায় এক মাস কেটে গেলে এখনও মনে পড়ে তাদের। সাহালও খুব ভালো ছেলে। গুরুগম্ভীর যাকে বলে। এখানেও তার অনেক বন্ধুবান্ধব হয়ে গেল। এখন ভালোই চলছে সাহালের পড়ালেখা। সাহালের স্কুলে আজ একটি তালিকা তৈরি করেছেন মিঠু স্যার। যারা গরিব অসহায়, নি¤œবিত্ত স্কুল ড্রেস বানাতে পারে না। তাদের একটি করে স্কুলড্রেস দেয়া হবে। মিঠু স্যার জানত না তার বাবাও শিক্ষকতা করে। তাদের পরিবার সচ্ছল। দশজনের মাঝে সাহালেরও নাম লিখেছেন। আর বাবার নাম লিখেছে কেরামত কসাই। বিজয়নগরে কেরামত কসাইও আছে। মিঠু স্যার কেরামত মাস্টারকে চেনেন না। সাহাল তার বাবার নাম ভিন্ন দেখেও চুপ করে বসে থাকল। কিচ্ছু বলল না। পরদিন দশজনকে স্কুলড্রেস দিয়ে দিলো। সাহালও একটি পেল। সাহাল ভালোই খুশি হলো। সাহাল লেখাপড়ায় ভালো।
নিয়মিত সাহালের খোঁজখবর নিতে লাগল মিঠু স্যার থেকে শুরু করে স্কুলের প্রিন্সিপাল পর্যন্ত। তাকে সবাই চিনতো। প্রায় একমাস পার হয়ে গেল। সব স্যারের ভালো ফোকাসিং হয়ে উঠল। মিঠু স্যার প্রায় বলে, কেরামত কসাইয়ের ছেলে এসেছে কি? সে ভালো পড়ালেখা করে। সাহালের একসময় কসাই নামটি পীড়াদায়ক মনে হতে লাগল। দোষটা তার। তখন যদি স্যারকে সংশোধন করে দিত, তাহলে আজ আর কসাইয়ের ছেলে বলে ডাকতেন না স্যার।
সাহাল এখন লজ্জা নিয়ে স্কুলে যায়। কারো সাথে তেমন কথা বলে না, চুপচাপ থাকে। অনেকেই সাহালের এই বিষয়টা লক্ষ করল। সবাই ভাবে, হঠাৎ কী হলো সাহালের? কিন্তু কেউ কোনো উত্তর বের করতে পারে না।
একদিন সাহালের খুব কাছের বন্ধু রফিক জিজ্ঞেস করল। কিন্তু সাহাল কিছু বলল না। সে ঠিক করল, মিঠু স্যারকে আজ সব খুলে বলবে। বলবে, আমরা সচ্ছল পরিবার। আমার বাবা মাস্টার। আমি আর এই পীড়া নিতে পারছি না।
সত্যি সত্যি সাহাল স্যারের রুমে চলে গেল। অনেক শিক্ষক থাকার কারণে সে কিছুই বলতে পারল না। চুপ করে পিছু হটে গেল। খেয়াল করল, মিঠু স্যার কখন একা হন! ছোট মনে যা আসছে সাহাল তাই করছে। আজাদ স্যারের ক্লাস পরে, অফিসে চোখ বুলাতে দেখল মিঠু স্যার একা। ঠিক তখনই দৌড়ে অফিস রুমে গেল ব্যাগ কাঁধে করে। মিঠু স্যার বললেন, তুমি কেরামত কসাইয়ের ছেলে না।
জ্বি স্যার। সাহালের হৃদয় মনে হচ্ছে ভেঙে ভেঙে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে। মিঠু স্যারকে সাহাল সব কিছু খুলে বলল। সাহাল এই পীড়া থেকে আধটু হলেও উদ্ধার হলো। মিঠু স্যার সাহালকে বুকে জড়িয়ে নতুন প্রণয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করলেন।
তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ। এ জন্য আমি গর্ববোধ করছি। সাহালকে তার মতো ও সততার জন্য মিঠু স্যার পুরস্কৃত করলেন। সেই স্কুলড্রেসটি ফেরত না নিয়ে তাকে দিয়ে দিলেন। সাথে আরো কিছু বই উপহারস্বরূপ দিলেন। সাহাল এখন কেরামত মাস্টারের ছেলে! হ