২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভণ্ড জ্যোতিষ

-

অনেক দিন আগের কথা। এক গ্রামে মতিলাল নামে একজন হাতুড়ে ডাক্তার বাস করত। গ্রামবাসী ছিল শিক্ষিত ও সচেতন। তাই ডাক্তারি পেশায় সেই গ্রামে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। যা রোজগার করত তা দিয়ে তার সংসার চলত না। সে মনে মনে ভাবলÑ এখন কম্পিউটারের যুগ। বেঁচে থাকতে হলে আমাকে কম্পিউটার শিখতেই হবে। কম্পিউটার শিখে অন্য কোথাও চলে যাবো।
ঠিকই মতিলাল শহরে গিয়ে কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ নিলো। তারপর সে কালা মিয়া নামে তার এক বন্ধুকে নিয়ে পাহাড়ি এলাকার কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করল। সে যে ঘরে থাকত তার বারান্দার একটা বিশেষ স্থানে ডিজিটাল ক্যামেরা লাগিয়ে রাখল। এটি তার বন্ধু ছাড়া কেউ জানত না। নতুন গ্রামটি খুব ছোট ছিল। গ্রামবাসী ছিল সহজ-সরল ও মূর্খ। তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। গ্রামবাসীর সরলতা ও মূর্খতার সুযোগ নিয়ে সে ভণ্ডামির সব কৌশল প্রয়োগ করতে শুরু করল।
মতিলালের কাছে ছিল ছোট্ট একটি কম্পিউটার। সে তার বন্ধুর সহযোগিতায় কৌশলে যত দূর সম্ভব গ্রামবাসীর ছবি, আঙুলের ছাপ ও ঠিকানা সংগ্রহ করতে শুরু করল। এসব তথ্য সে কম্পিউটারে অ্যান্ট্রি দিলো। তার বন্ধু কালা মিয়া ধীরে ধীরে গ্রামবাসীর কাছে মতিলালকে একজন জ্যোতিষী বলে প্রচার করতে থাকল। সে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে মানুষের নাম-ঠিকানা বলে দিতে পারে। বিভিন্ন রোগের সমস্যা নিয়ে যখন কেউ মতিলালের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসত তখন সে ঘরের ভেতরে চুপ করে বসে থাকত। কালা মিয়া বুঝিয়ে দিত যে সে ধ্যানে মগ্ন রয়েছে। কালা মিয়ার সাহায্যে তারা মতিলালের সাথে সাক্ষাৎ করত। কালা মিয়া তাদের নির্দিষ্ট একটা চেয়ারে বসতে দিত। তারপর সে একটা ডিভাইসের ওপর হাতের আঙুল রাখতে বলত। ডিজিটাল ক্যামেরা ও ডিভাইস ব্যবহার করে মতিলাল রোগীর সব তথ্য জেনে নিতো। কম্পিউটারের মনিটরে ভেসে ওঠা জীবনবৃত্তান্ত দেখে মতিলাল যখন রোগীর নাম-ঠিকানা বলে দিত তখন তারা খুব অবাক হতো। এতে গ্রামবাসী খুব সহজেই বিশ্বাস করত। সে যেহেতু হাতুড়ে ডাক্তার ছিল, তাই সে কিছু কিছু রোগের চিকিৎসা করতে পারত। রোগীদের ওষুধের পাশাপাশি ঝাড়ফুঁক, পানিপড়াও দিত। তার কেরামতি দেখে গ্রামের সহজ-সরল মানুষ তাকে একজন আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী বুজুর্গ জ্যোতিষ বলে মনে করতে শুরু করল। এভাবে তার নাম ধীরে ধীরে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল।
একদিন গ্রামের একজন গেরস্তের বাড়ি থেকে কিছু মালামাল চুরি হলো। কিন্তু কে চুরি করেছে? কোনোভাবেই তাকে ধরা গেল না। সেই গেরস্থ মতিলাল জ্যোতিষীর কাছে গেল পরামর্শের জন্য। মতিলাল সব কিছু শুনে গেরস্তের বাড়িতে গেল। সে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখল, কোথায় কোনো হাতের ছাপ রয়েছে কি না। সে কিছু হাতের ছাপের নমুনা সংগ্রহ করল। তারপর সে ল্যাপটপের সাহায্যে হাতের ছাপটি পরীক্ষা করল। পরিশেষে মতিলাল সেই চোরকে শনাক্ত করতে সমর্থ হলো। এভাবে মতিলালের নামডাক গ্রামের সর্বত্র ছড়িয়ে গেল। গ্রাম থেকে চুরি-ডাকাতি, হানাহানিসহ সব ধরনের অপকর্ম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামবাসী সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকল। কেউ কেউ মতিলালকে জাদুকর বলে অভিহিত করল। নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে তার বাড়িতে সব সময় লোকজনের ভিড় থাকত। সবাই তার জন্য টাকা নিয়ে আসত। এর ফলে মতিলালের কোনো অভাবই থাকল না। দিন দিন তার আয়রোজগার বাড়তেই থাকল।
একদিন হঠাৎ গ্রামে একজন খুন হলো। থানায় এ নিয়ে মামলাও হলো। গ্রামের লোকজনও কাউকেই সন্দেহ করল না। খুনের আলামত হিসেবে এক জায়গায় একটি ছুরিও পাওয়া গেল। কিন্তু কে এই খুন করেছে? তাকে খোঁজাই এখন পুলিশের প্রধান কাজ। থানার পুলিশ তদন্ত করেও মামলার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পেল না। এ দিকে গোপনে মতিলালও খুনের রহস্য উদঘাটন করার জন্য চেষ্টা করতে থাকল। প্রাপ্ত ছুরিতে লেগে থাকা হাতের ছাপ পরীক্ষা করে সেই খুনি এবং খুনির সহযোগীদের চিহ্নিত করল। কিন্তু সে এ বিষয়টি কাউকে বলল না। যখন কেউই এই খুনের রহস্য উদঘাটন করতে পারল না, ঠিক তখন গ্রামের কিছু লোক থানার পুলিশ অফিসারদের অনুরোধ করল মতিলাল জ্যোতিষীর সাহায্য নিতে। এরপর থানার পুলিশ অফিসার মামলার রহস্য উদঘাটনের জন্য মতিলালের শরণাপন্ন হলো। মতিলাল প্রথমে রাজি হলো না। পরে সবার অনুরোধে মতিলাল পুলিশদের সম্ভাব্য খুনিদের নাম-ঠিকানা জানিয়ে দিলো। এভাবে মতিলালের সাহায্যে পুলিশ সেই খুনি এবং খুনির সহযোগীদের চিহ্নিত করল। এতে গ্রামের লোকজন যেমন খুশি হলো তেমনি মতিলালের ক্ষমতা ও সুনামের কথা গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল।
কিছু দিন যেতে না যেতেই শহরে আরো একটি খুনের ঘটনা ঘটল। এ ঘটনায় থানায় একটি মামলা হলো। অনেক দিন গত হলো তবু খুনের কোনো রহস্য উদঘাটন করা গেল না। পুলিশ কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে তারা মতিলাল জ্যোতিষীর সাহায্য নেবে। পুলিশের কর্মকর্তারা মতিলালের সাথে দেখা করে সব কথা খুলে বলল। তারা খুনের যেসব আলামত সংগ্রহ করেছিল তাও জ্যোতিষীর কাছে পেশ করা হলো। মতিলাল সব কথা শুনে বলল, আমার পক্ষে সম্ভব নয় এ খুনের রহস্য উদঘাটন করা। দয়া করে আমাকে মাফ করে দিন। আমি পারব না। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা ছিল নাছোড়বান্দা। তারা কিছুতেই তা ছাড়ল না। তারা বলল, আপনাকে খুনের রহস্য উদঘাটন করতেই হবে। প্রয়োজনে আপনি জনগণের বৃহৎ স্বার্থে পুনরায় আপনার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ব্যবহার করেন। এ ধরনের প্রশ্ন করায় মতিলাল খুব ঘাবড়ে গেল। কোনো উপায় না পেয়ে অবশেষে মতিলাল পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে এক সপ্তাহ সময় চাইলো।
মতিলাল বাড়ি গিয়ে চিন্তা করল, আমি যদি কেরামতির সত্যি কথা বলে দিই তাহলে আমি প্রতারণার অভিযোগে ফেঁসে যাবো। সেই সাথে আমার নিশ্চিত জেলের ভাত খেতে হবে। তার চেয়ে ভালো হয় গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া। সত্যি সত্যিই সে একদিন রাতের আঁধারে বন্ধুকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল। আর কখনো ফিরে আসেনি। শত চেষ্টা করেও কেউ তাকে খুঁজে পায়নি।

 


আরো সংবাদ



premium cement